নারীর সিদ্ধান্তকে সম্মান দিতে হবে
১৩ জানুয়ারি ২০১৬আপনি হয়ত বলবেন – এ আবার কী প্রশ্ন? বিয়ের পর বনিবনা না হলে, ‘ডিভোর্স' বা বিবাহবিচ্ছেদ তো আর আমাদের সমাজে নতুন কিছু নয়৷ এমনকি আইনেও পুরুষ তো বটেই, নারীকেও বিবাহবিচ্ছেদের অধিকার দেয়া হয়েছে!
হ্যাঁ, অধিকার দেয়া হয়েছে৷ মুসলিম বিবাহবিচ্ছেদ আইন ১৯৩৯ অনুযায়ী, বেশ কয়েকটি কারণে স্ত্রী আদালতের মাধ্যমে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটাতে পারেন৷ কারণগুলো হলো – ১. যদি চার বছর ধরে স্বামীর ঠিকানা অজ্ঞাত থাকে ২. যদি দু'বছর ধরে স্বামী তার স্ত্রীর ভরণপোষণের সংস্থান করতে ব্যর্থ হয় ৩. স্বামীর যদি সাত বছরের কারাদণ্ড হয় ৪. যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া স্বামী যদি তার বৈবাহিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয় ৫. স্বামী পুরুষত্বহীন হলে ৬. স্বামীর মস্তিষ্ক বিকৃত হলে ৭. বিবাহ অস্বীকার করলে ৮. স্বামী যদি নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করে আর ৯. অনুমতি ছাড়া স্বামী দ্বিতীয় বিবাহ করলে৷
এরপর মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ ১৯৬১-র মাধ্যমে পুরুষের বহুবিবাহের ক্ষেত্রে সালিশি পর্ষদ এবং বর্তমান স্ত্রীর অনুমতি বাধ্যতামূলক করা হয়৷ এর ব্যতিক্রম হলে এক বছরের কারাদণ্ড ও দশ হাজার টাকা অর্থদণ্ড হয়৷ শুধু তাই নয়, এই আইনের ৭ ধারায় বিবাহবিচ্ছেদ বা তালাকের ক্ষেত্রে পুরুষের একতরফা ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করার একটা চেষ্টাও করা হয়েছে, যাতে করে সালিশি পর্ষদের কাছে নোটিশ না দিয়ে কোনো পুরুষ যদি তার স্ত্রীকে তালাক দেয়, তবে তাকে এক বছরের কারাদণ্ড এবং পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড ভোগ করতে হবে৷ ৯ ধারায় বলা হয় যে, তালাকের পর ভরণপোষণের জন্য স্ত্রী আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন৷ এছাড়া ১০ ধারা অনুসারে, দেনমোহর কিভাবে আদায় হবে সেটা আগে নির্ধারণ করা না থাকলে স্ত্রী চাওয়া মাত্রই তা আদায় করতে পারবেন৷
ভারতীয় আইনেও হিন্দু নারীকে বিবাহবিচ্ছেদের সম্পূর্ণ সুযোগ দেয়া হয়েছে, দেয়া হয়েছে সঠিক ভরণপোষণ দাবি করার কার্যকরি আইনি প্রক্রিয়া৷ কিন্তু এ তো গেল আইনের কথা৷ আমাদের সমাজের বাস্তব পরিস্থিতি কী বলছে? বলছে একেবারে অন্য কথা, তুলে ধরছে একেবারে ভিন্ন একটা ছবি৷
আজও বাংলাদেশ অথবা ভারতে অধিকাংশ বিয়েই হচ্ছে বাবা-মা বা পরিবারের পছন্দে বা তাঁদের চাপে৷ মেয়েটির ইচ্ছা-অনিচ্ছা, ভাব-ভালোবাসার তোয়াক্কা না করে৷ প্রেম, প্রেমের বিয়ে অথবা সহবাসকে এই শতাব্দীতেও মেনে চলতে হচ্ছে নানা রাখ-ঢাক৷ আর বিবাহবিচ্ছেদ হলে তো কথাই নেই৷ ‘ডিভোর্সি' (মানে যার ‘ডিভোর্স' বা বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে গেছে) – এই বিশ্লেষণটা আজকের দিনেও যেন একটা গালির নামান্তর, বিশেষ করে মেয়েদের ক্ষেত্রে৷
তোমার ডিভোর্স হয়ে গেছে – মানেই তুমি স্বামীর সঙ্গে ঘর করার অযোগ্যা৷ তোমার ধৈর্য্য নেই৷ তুমি শেষ চেষ্টাটুকু করোনি৷ তুমি খারাপ মেয়ে৷ অর্থাৎ তুমি দুশ্চরিত্র৷ – না, এটা আমার কথা নয়, সমাজই বারংবার নারীর দিকে আঙুল তুলে এ কথাগুলো মনে করিয়ে দিয়েছে, দিচ্ছে৷
আর নারীরা ছোট থেকে যেমন বুক লুকাতে শেখে, শেখে পা ফাঁক করে নয় পা দুটো জোড়া লাগিয়ে বসতে, তেমনই বিবাহবিচ্ছেদের পর মাথাটা হেট হয় তাঁদেরই৷ পুতুল খেলা দিয়ে শিক্ষার শুরু তো, তাই ঘর ভেঙে গেলে নিজের কাছেই যেন ছোট হয়ে যায় নারী৷ যেটা স্বামী-স্ত্রী দু'জনের পরাজয় – সেটাকে বারে বারে নিজের পরাজয়, নিজের ভুল বলে মনে হতে থাকে৷ সমাজ, বাবা-মা, পরিবার, সহকর্মী, এমনকি বন্ধু-বান্ধবও তাঁদের সে কথাই বলে বার বার৷
পুরুষরা যখন এক কথায়, একক হঠকারিতায় স্ত্রীকে ত্যাগ করে অথবা ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেয় বা দ্বিতীয়বার বিয়ে করার কথা ভাবে – তখন কিন্তু সমাজের শত-সহস্র কটাক্ষ তাঁর দিকে ধাবিত হয় না৷ বউটার নিশ্চয়ই কোনো দোষ আছে, বউটা হয়ত বন্ধ্যা বা ‘বাঁজা' – এমন কত কথা বলেই না সমাজ তখন পুরুষের সিদ্ধান্তের পক্ষপাত দেখায়৷ অথচ শত চেষ্টার পর নারী যখন বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেয়, সিদ্ধান্ত নেয় একা থাকার, একাই সন্তানকে মানুষ করার, তখন সমাজের কি উচিত নয় তাঁর পাশে এসে দাঁড়ানো? শুধু অর্থ বা আইন নয়, তাঁদের যে তখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সহমর্মিতা, বন্ধুতা৷ এটুকু কি তাঁরা পেতে পারেন না? এতটুকু সম্মান তাঁদের কি দিতে পারি না আমরা?
আপনি কি দেবারতির সঙ্গে একমত? জানান নীচের ঘরে৷ জানান আপনার নিজের অভিজ্ঞতাও৷