শুধু কার্বন নির্গমন নয়, নাইট্রোজেনও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ
২৩ সেপ্টেম্বর ২০১১নির্মল বাতাসের কারণ হাইড্রক্সিল ব়্যাডিক্যাল
বুকভরে নির্মল বাতাস টানতে কার না ভালো লাগে? কিন্তু সেই বাতাসই দূষিত হলে দম বন্ধ হয়ে আসে৷ এর এক বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে৷ অক্সিজেন ও হাইড্রোজেনের একটি করে পরমাণু নিয়ে তৈরি যে পদার্থ, তার নাম হাইড্রক্সিল ব়্যাডিক্যাল যার সংক্ষিপ্ত পরিচয় ওএইচ৷ অত্যন্ত স্পর্শকাতর এই পদার্থ৷ সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গেই আশেপাশের পদার্থের কারণে প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করে৷ ফলে নিমেষের মধ্যেই তা ধ্বংস হয়ে যায় – বিশেষ করে ক্ষতিকারক পদার্থের সংস্পর্শে এলে৷ ওএইচ আছে বলেই আমরা নির্মল বাতাস টানতে পারি৷
জার্মানির মাইনৎস শহরে মাক্স প্লাঙ্ক ইন্সটিটিউট'এর ভূ-রসায়নবিদ উলরিশ প্যোশল তাই এই পদার্থকে বায়ুমণ্ডল শোধনের সাবান বলে থাকেন৷ কারণ এই পদার্থ বাতাস থেকে প্রায় সব কিছুই শুষে নিতে পারে – যেমন পেট্রোলের ধোঁয়া বা মিথেন৷ এমনকি মারাত্মক বিষাক্ত কার্বন মোনক্সাইড'কেও রেহাই দেয় না এই হাইড্রক্সিল ব়্যাডিক্যাল৷ অথচ কারখানার অনেক প্রক্রিয়ায় কার্বন মোনক্সাইড'এর নির্গমন ঘটবেই৷ বায়ুমণ্ডল সংক্রান্ত গবেষণার শুরুর দিকেই বিজ্ঞানীদের মনে হয়েছিল, এত ক্ষতিকারক পদার্থ সত্ত্বেও আমরা যে দিব্যি বেঁচে আছি তা যেন এক অলৌকিক ঘটনা৷
ওএইচ'এর গুণগান এখানেই শেষ হচ্ছে না৷ বৃষ্টির সময় প্রায়ই যে ক্ষতিকারক পদার্থ আকাশ থেকে মাটিতে নেমে আসে, তারও জন্য দায়ী এই ওএইচ৷ এই সব ভাসমান পদার্থকে তরল অ্যাসিডে পরিণত করে এই হাইড্রক্সিল ব়্যাডিক্যাল৷
জলবায়ু পরিবর্তন ও নাইট্রোজেনের ভূমিকা
শুনতে জটিল মনে হলেও এই গবেষণার সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে৷ পরিবেশ দূষণ সংক্রান্ত যাবতীয় বিতর্কের ক্ষেত্রে শুধু কার্বন নির্গমন বা বড়োজোর মিথেনের ভূমিকার উল্লেখ করা হয়৷ কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন ও আমাদের ইকো সিস্টেমের জন্য নাইট্রোজেনের পরিবর্তনের প্রক্রিয়াও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ অর্থাৎ কার্বন নির্গমনের ক্ষেত্রে মানুষের যে ভূমিকা রয়েছে, তার থেকে অনেক বেশি ভূমিকা রয়েছে নাইট্রোজেনের প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে৷ সেটা ঠিকমতো জানতে পারলে আমরা আরও সচেতনভাবে জমির ব্যবহার করতে পারবো, বলেন উলরিশ প্যোশল৷
হাইড্রক্সিল ব়্যাডিক্যাল'কে ঘিরে রহস্য
হাইড্রক্সিল ব়্যাডিক্যাল যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদার্থ, এবিষয়ে বিজ্ঞানীদের মনে কোনো সন্দেহ নেই৷ কিন্তু কোথা থেকে এত পরিমাণ ওএইচ- ব়্যাডিক্যাল আসছে, সেবিষয়ে তাদের কোনো ধারণা ছিল না৷ অথচ বায়ুমণ্ডলে বিশাল পরিমাণ ক্ষতিকারক পদার্থের মোকাবিলা করতে যথেষ্ট পরিমাণ ওএইচ'ও কাজ করে৷ চীনের তরুণ বিজ্ঞানী হাং সু মাইনৎস'এ উলরিশ প্যোশল'এর সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে এই রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করছেন৷ তাঁর ধারণা, বায়ুমণ্ডলে নাইট্রোজেন'এর যে বিবর্তন ঘটে, তার সঙ্গে এই প্রক্রিয়ার নিশ্চয় একটা সম্পর্ক রয়েছে৷ এটা অবশ্য আগেই জানা ছিল, যে নাইটার বা সল্টপিটার অ্যাসিড সূর্যের অতি-বেগুনি রশ্মির সংস্পর্শে এলে হাইড্রক্সিল ব়্যাডিক্যাল তৈরি হয়৷ হাং সু বিষয়টি আরও বুঝিয়ে বললেন, ‘‘দিনের বেলায় সল্টপিটার অ্যাসিড খুব তাড়াতাড়ি ক্ষয়ে যায়৷ সূর্যের আলোর ফলে ফটোলিসিস প্রক্রিয়ার কারণেই এটা ঘটে৷ কিন্তু ওএইচ- ব়্যাডিক্যাল সৃষ্টি হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তা উবে যাওয়ার কথা৷ কিন্তু বাস্তবে তেমনটা ঘটে না৷ ভালো করে অঙ্ক কষলেই টের পাওয়া যায় যে কোথাও একটা সল্টপিটার অ্যাসিড'এর বড় উৎস থাকতেই হবে৷''
অনেক বিজ্ঞানী মনে করেছেন যে বায়ুমণ্ডলের নাইট্রোজেনই সল্টপিটার অ্যাসিড'এর উৎস৷ কিন্তু হাং সু'র সন্দেহের তীর অন্য এক দিকে৷ তিনি বললেন, ‘‘আমার হঠাৎ মনে পড়ে গেলো, যে মাটিতেই তো বিশাল পরিমাণ নাইট্রোজেন রয়েছে৷ অর্থাৎ বাতাস থেকে নাইট্রোজেনের তো প্রয়োজনই নেই৷ দেখলাম, মাটির মধ্যেই অতিরিক্ত মাত্রার সল্টপিটার অ্যাসিড রয়েছে৷ কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত অ্যাসিড থাকলে তা তো আবার বাতাসে মিশে যাওয়া উচিত৷''
মাটির ব্যবহার সম্পর্কে জ্ঞানের প্রয়োজন
মাটিতে যে সল্টপিটার অ্যাসিড রয়েছে, তার উৎস আবার নাইট্রাইট৷ মাটিতে অতিরিক্ত সার ব্যবহার করলে বিষাক্ত এই পদার্থ দেখা দেয়৷ একটা ছোট বন্ধ ঘরে সেই মাটি রেখে শুদ্ধ বাতাস ঢুকিয়ে দিলে সেই বাতাস যদি সল্টপিটার অ্যাসিড শুষে নেয়, তাহলেই এই তত্ত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়৷ হাং সু এই সহজ উপায়ে রহস্যের সমাধান করতে পেরেছেন, এক্ষেত্রে গবেষণায় অনেক দূর এগিয়েছেন, মাটির জটিল চরিত্র সম্পর্কে অনেক নতুন তথ্য জানতে পেরেছেন৷ তার ফলে যা জানা গেছে, তা হলো, মাটিতে বেশি সার ব্যবহার করলে এবং তার উপর অ্যাসিড বৃষ্টি হলে সেই প্রক্রিয়া যেন এক ‘সেফটি ভাল্ভ' হিসেবে কাজ করে৷ তখন অতিরিক্ত সল্টপিটার অ্যাসিড বাতাসে মিশে যায়৷ সব মিলিয়ে বিজ্ঞানীরা মাটি ও বায়ুমণ্ডলের মধ্যে আদান-প্রদানের প্রক্রিয়া সম্পর্কে আরও স্পষ্ট ধারণা অর্জন করেছেন৷ মাক্স প্লাঙ্ক ইন্সটিটিউট'এর ভূ-রসায়নবিদ উলরিশ প্যোশল এবিষয়ে বললেন, ‘‘বায়ুমণ্ডলে প্রতিনিয়ত হাজার-হাজার প্রক্রিয়া ঘটে চলেছে৷ এসব সম্পর্কে সঠিক পূর্বাভাষ দিতে হলে বা বিরাজমান অবস্থা সম্পর্কে জানতে হলে শুধু এটা জানলেই চলবে না, যে কোন পদার্থ অন্য কোন পদার্থের সংস্পর্শে এলে তার প্রতিক্রিয়া কী হবে৷ সম্পূর্ণ ধারণা পেতে এই সব পদার্থের সঠিক পরিমাণও জানা জরুরি৷''
প্রতিবেদন: সঞ্জীব বর্মন
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক