সারোগেসির মহত্বের দিকটাও দেখুন
১ মে ২০১৭পর্ব ১
ছোটবেলা থেকেই মা হওয়ার স্বপ্ন দেখতো সোনাটা৷ তখন বছর দশেক বয়স হবে৷ ছোট্ট ডায়েরিটাতে গোটা গোটা অক্ষরে নিজের প্রশ্নের জবাবগুলো সে দিয়েছিল এভাবে:
বিশ্বের সবচেয়ে বড় শিল্পী কে? – প্রকৃতি
সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য কী? – সন্তানের মুখের হাসি
বড় হয়ে কী হতে চাও? – মা
এখন সোনাটার বয়স ৪১৷ একটি মেয়ের জীবনে সন্তান যে আবশ্যক নয়, সেটা আজ জানে সোনাটা৷ মানেও৷ কিন্তু সব মেয়ের স্বপ্ন তো এক হয় না! বড় চাকরি, চাকরির পাশাপাশি নাটক, লেখালেখি – এতকিছু তো সে চায়নি৷ ও শুধু চেয়েছিল কোল আলো করা একটা সন্তান, সন্তানের মুখের হাসি, তার মুখের ‘মা' ডাক৷ কিন্তু তিন-তিনবার সন্তানধারণ করেও ‘মা' হতে পারেনি সোনাটা৷ অসংখ্য অপারেশন, তিনখানা ‘ইন-ভিট্রো-ফার্টিলাইজেশন' বা আইভিএফ, গাদা গাদা টাকা খরচ করেও ওর পেটে সন্তান আসেনি, এলেও থাকেনি৷ বরং দীর্ঘ ১৫ বছর পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ধরা পড়ে, সোনাটার ডিম্বাণুগুলোতে জিনগত সমস্যা রয়েছে৷
প্রথমদিকে সত্যিটা মেনে নিতে কষ্ট হয়েছিল সোনাটার৷ নিজেকে গর্ভবতী কল্পনা করে আয়নার সামনে পেট ফুলিয়ে তাকিয়ে থাকতো সে, তারপর কাঁদতো৷ কিন্তু জার্মানিতে ‘এগ ডোনেশন', মানে অন্যের ডিম্বাণুর সাহায্যে সন্তানের জন্ম দেওয়া বেআইনি৷ আর দেশের বাইরে গিয়ে এটা করালে বাচ্চাটা যদি জার্মানিতে ঢোকার সুযোগ না পায়? হয়ত বলবেন, কেন সন্তান দত্তক নিলেই তো হয়? অবশ্যই হয়৷ সোনাটা সে চেষ্টাও করেছিল৷ কিন্তু জার্মানি থেকে দক্ষিণ এশীয় বাচ্চা দত্তক নেওয়া শুধু খরচসাপেক্ষ নয়, অনন্তকাল অপেক্ষা করার পর আপনি যে একটি সুস্থ বাচ্চার মুখ দেখতে পারবেন, এমন গ্যারান্টিও নেই৷ তার ওপর সোনাটা আর তার বরের বয়সও কম নয়!
সোনাটা মেনে নেয় তাঁর জীবন, ডুবে থাকে কাজের মধ্যে৷ বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মী, আশেপাশে যাঁদেরই বাচ্চা আছে, তাঁদের কাছাকাছি থাকতে চায় সোনাটা৷ বাচ্চা জন্মের আগে মায়ের সাধ দেওয়া থেকে শুরু করে বাচ্চা হলে তাদের জন্য উপহার কেনা, আদর করা, খেলা করা – অফিসের বাইরে সোনাটার দিন এভাবেই কাটে৷ ‘মামনি', ‘সোনা মা', ‘সোনাটা আম্মু', ‘মিষ্টি মা', ‘ওমা' – সোনাটার আজ কত নাম, কিন্তু ‘মা' ডাকটা ওর আর শোনা হয়ে ওঠে না৷ সোনাটা তাই ধীরে ধীরে স্বপ্ন দেখা বন্ধ করে দেয়...৷
ঠিক এমনই একটা সময়, পরিচালক সোফিয়া স্টেপ্ফ-এর ফোন আসে৷ ‘‘সোনাটা, ভারতে বাণিজ্যিক সারোগেসি নিয়ে নতুন একটা বিল পাস হতে চলেছে৷ বিদেশিদের জন্য এই সেবা ইতিমধ্যেই বন্ধ করেছে সরকার৷ তুমি তৈরি হয়ে নাও, আমরা মাস খানেকের মধ্যেই ভারতে যাচ্ছি৷''
পর্ব ২
‘ওয়ার্ল্ড সারোগেসি ফোরাম'-এর প্রধান কর্মকর্তা ক্রিস্টাল ট্রাভিস-এর দৌলতে সহজেই ভারতে সারোগেসির পিঠস্থান আনন্দের ডা. নয়না প্যাটেলের একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেয়ে যায় সোনাটা৷ আকাঙ্খা ক্লিনিকে সারোগেসি, আইভিএফ'সহ নানা ধরনের চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে৷ আছে শুক্রাণু ব্যাংক, ‘এগ ডোনার' ব্যাংক, এমনকি সন্তান প্রসবের পর সদ্যোজাতকে যথেষ্ট পরিমাণ দুধের জোগান দিতে ‘মিল্ক ব্যাংক'-ও৷ সেই ক্লিনিকের একতলায় ৬২ জন ‘সারোগেট মাদার'-এর দেখা পায় সোনাটা৷ একদিন দুপুরে তাদের মধ্যে সাত-আট জনের সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে একসময় সে ভুলেই যায় যে সে সাংবাদিক, সে নাট্যকর্মী....সে কাজে এসেছে৷ নিজের অভিজ্ঞতা থেকে সোনাটা জানে আইভিএফ-এর কত কষ্ট৷ আর ময়ূরীকা, শীবানী, শাবানা, দাকশা – এরা কিনা টাকার জন্য নিজের শরীরের ওপর এমনটা হতে দিচ্ছে? অন্যের সন্তান ধারন করে নয় মাস তাকে বয়ে বেড়াচ্ছে? হবু সন্তানের জন্য নামাজ পড়ছে, পুজো করছে, গায়ত্রী মন্ত্র-হনুমান চল্লিশা জপ করছে....তারপর সন্তান জন্মের পর নিজের কোল খালি করে অন্য এক প্রায় অপরিচিতা নারীর হাতে তুলে দিচ্ছে সদ্যোজাত সন্তানকে? কেমন করে করছে?
‘‘হ্যাঁ, আমাদের টাকা দরকার৷ নইলে যে আমার নিজের সন্তানগুলো না খেয়ে মরবে৷ ওদের খাওয়াতেই পারি না, পড়াবো কী? কিন্তু না, শুধু এ জন্য নয়৷ একজন সন্তানহীনার কোলে যে আমরা একটি ফুটফুটে শিশুকে তুলে দিতে পারছি, তার মুখে হাসি ফোটাতে পারছি – এটাই বা কম কিসে?'' – কথাগুলো একজন ভারতীয় সারোগেট মায়ের৷ এরা গরিব৷ ভীষণ গরিব৷ সোনাটা নিজের চোখে এদের বাড়ি-ঘর, পরিবার, সংসারের অবস্থা দেখেছে৷ তারপরও....সোনাটা অবাক৷
এ ঘটনার ক'দিন পর একজন মার্কিন সারোগেট মাদারও ঐ একই কথা বলে সোনাটাকে৷ নাম মেলিসা হোলমান৷ স্কাইপে নেহাত গল্পের ছলেই সে বলে, ‘‘সারোগেট মাদার হওয়াটা খুব কষ্টের, আবার অসম্ভব আনন্দেরও৷''
গুজরাটের আনন্দ শহরের ঐ ক্লিনিকের পর মুম্বই, দিল্লি, কলকাতা – শহরে শহরে একটার পর একটা হাসপাতাল, সারোগেসি হোম, এজেন্ট, ডাক্তারদের সঙ্গে দেখা করে সোনাটা৷ কথা বলে৷ কথা বলে আরো ডজনখানেক সারোগেট মাদার ও এগ ডোনারদের সঙ্গেও৷ জানতে পারে কীভাবে একেক শহরে একেকভাবে সারোগেসি হয়, সারোগেট মায়েদের, এগ ডোনারদের গ্রাম-গঞ্জ থেকে খুঁজে আনা হয়, এমনকি যে টাকাটা সারোগেট মায়েরা এ কাজের জন্য পান, সেটাও একেক জায়গায় একেক রকম৷ কিন্তু একটা জিনিস কোথাও বদলায় না – বদলায় না মা হিসেবে নিজের সন্তানের প্রতি দায়িত্ব, তার জন্য সবকিছু করার অদম্য ইচ্ছা আর আরেকটি মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে পারার আনন্দ৷
সোনাটা কোথায় যেন এই গরিব, হতভাগ্য অথবা অসম্ভব শক্তিশালী মেয়েগুলোর সঙ্গে একাত্ম বোধ করে৷ ওদের সঙ্গে গান করে, হাঁটে, একে-অন্যের নখ কেটে দেয়৷ ওঁরা সোনাটাকে বলে, ‘‘দিদি, টাকাটা সব না৷ তুমি চাইলে আমরাই তোমাকে সন্তান দিতে পারি৷'' সোনাটার চোখে জল আসে৷ তার যে উপায় নেই৷ সে জার্মান নাগরিকত্ব নিয়েছে সেই কবে....তাই সে ভারতের মাটিতেও বিদেশি৷ বিদেশিদের ভারতে বাণিজ্যিক সারোগেসি করার আজ আর কোনো পথ নেই৷ তাহলে কি অন্য কোনো দেশে...?
পর্ব ৩
ভারত তো বটেই, বিশ্বের সর্বত্রই সারোগেসির ‘বাণিজ্যিক' দিকটা তুলে ধরা হয়৷ হবে না-ই বা কেন? এজেন্ট থেকে শুরু করে বড় বড় হাসপাতাল – সব জায়গাতেই সারোগেসিকে কেন্দ্র করে চলছে বড় অঙ্কের টাকার খেলা৷ তাই সারোগেসি আইনে একটা ‘রেগুলেশন' অবশ্যই দরকার, যাতে সারোগেট মাদারদের সুবিধা-অসুবিধা, আইনি অধিকারগুলোকে নিশ্চিত করা যায়৷ কারণ সারোগেসি বন্ধ হয়ে গেলে, এই মেয়েগুলো খাবে কী? খাওয়াবেই বা কী? তখন হয়ত ওদের গৃহকর্মী, দিনমজুর বা যৌনকর্মী হওয়া ছাড়া আর কোনো পথ থাকবে না....ভাবতে থাকে সোনাটা৷
ভাবে, সারোগেসির মাধ্যমে সন্তান লাভের বিরুদ্ধে অনেক যুক্তি আছে৷ এটা প্রকৃতিবিরুদ্ধ, এতে সারোগেট মা এবং হবু সন্তানের জীবনের ঝুঁকি থাকে, ইত্যাদি, ইত্যাদি৷ কিন্তু আমাদের সমাজে তো নারীকে দ্বিতীয় লিঙ্গ হিসেবেই ধরা হয়৷ কন্যা সন্তানকে এখনও দেখা হয় ‘বোঝা' হিসেবে৷ কন্যা ভ্রুণ হত্যা বা পুত্র সন্তানের সামনে মেয়ে সন্তানটিকে অবহেলা করার সময় কি কারো মনে থাকে না তার জীবন, তার স্বাস্থ্যের কথা? মনে থাকে থাকে না যে, নারীরা শুধু গর্ভধারণ করতে বা পুরুষের বাসনা চরিতার্থ করার জন্য জন্মগ্রহণ করেনি? তাছাড়া প্রাকৃতিক নিয়মে সন্তান জন্মানোর সময় কি মা ও সন্তানের জীবনের ঝুঁকি থাকে না? যে দম্পতি তাঁদের নিজেদের শুক্রাণু ও ডিম্বাণু দিয়ে আইভিএফ-এর মাধ্যমে সন্তান লাভের চেষ্টা করছে – সেক্ষেত্রে কি বিপদ কোনো অংশে কম রয়েছে? ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের ২০১১ সালের রেজুলিউশন অনুযায়ী, সারোগেসি হচ্ছে ‘নারীর দেহ ও তাঁর প্রজনন অঙ্গের শোষণ'৷ তা পুরুষতন্ত্র কি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ঠিক এই কাজটাই করেনি? করছে না?
বিশ্বায়নের এই যুগে কোন জিনিসটা বিক্রি হচ্ছে না? তাহলে সোনাটার মতো কেউ যদি এক দশকের কষ্ট, বাঁজা হওয়ার গঞ্জনা, লাঞ্ছনার পর নিজের শরীরটাকে একটু রেহাই দিয়ে এগ ডোনেশেন অথবা সারোগেসির দ্বারস্থ হন, আর তাঁকে সাহায্য করতে অন্য এক নারী যদি স্বেচ্ছায়, একটু সচ্ছলতার মুখ দেখার জন্য সারোগেট মা হতে চান, তাহলে কেন আমরা এর শুধু ‘বাণিজ্যিক' দিকটাই দেখবো? প্রতিটি নারীর নিজস্ব চাহিদা, ইচ্ছে, স্বপ্নকে সম্মান না দিয়ে কেন আমরা এঁকে দেবো লক্ষ্মণরেখা?
সত্যিই তো....এই মেয়েরা যদি তাদের লক্ষ্যে স্থির থাকতে পারে, তাহলে কীভাবে হাল ছাড়বে সোনাটা বা সোনাটার মতো সন্তানহীনারা? নাটকের ‘রিসার্চ' তো হলো, এবার যে তার জীবনের ‘রিসার্চ' শুরু করতে হবে৷ আর এ কথাটাই তো সোনাটাকে বার বার মনে করিয়ে দিয়েছে এই সারোগেট মায়েরা৷ সত্যি, ক'দিন আগেও নিজেকে নারীবাদী বলে মনে হতো সোনাটার৷ কিন্তু ওঁদের সাথে কথা বলে সোনাটা বুঝতে পারে যে, আসল নারীবাদী কারা৷ তা না হলে বিশ্ববিদ্যালয় তো দূরের কথা, স্কুল-কলেজের গণ্ডি না পেরিয়ে, পিতৃতন্ত্রের বোঝা মাথায় নিয়েও নিজের সন্তান-সংসারের জন্য এরা কী না করতে পারে!
আজও ওদের কথা ভাবলে নিজের অপারগতাকে অনেক ছোট বলে মনে হয় সোনাটার, আর ওঁদের মহত্বটা ফুটে ওঠে পূর্ণিমার চাঁদের মতো – উজ্জ্বল আর বিশালাকার হয়ে...৷
বিশেষ দ্রষ্টব্য: ‘সোনাটা' লেখকেরই আরেকটি নাম৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷