সংকটকালে আকাশবাণী নীরব, বন্ধ মৈত্রী চ্যানেল
৪ এপ্রিল ২০২০অল ইন্ডিয়া রেডিও বা আকাশবাণী ভারতের একটি প্রাচীন গণমাধ্যম৷ টেলিভিশনের দাপটে বেতারের জনপ্রিয়তা অনেকটা কমে গেলেও প্রযুক্তির পরিবর্তন ঘটিয়ে এখনো টিকে রয়েছে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামাঙ্কিত আকাশবাণী৷ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কিংবা চীন-ভারত লড়াই, অতীতে এমন বিভিন্ন আলোড়ন তোলা ঘটনাপ্রবাহের সময় আকাশবাণীর সাহসী ভূমিকা দেখা গিয়েছে৷ কিন্তু, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের জেরে লকডাউন ঘোষিত হওয়ায় যেন এই বেতার প্রতিষ্ঠানেও তালা পড়ে গিয়েছে৷ অথচ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দেশবাসীর কাছে নিজের কথা তুলে ধরতে বেছে নিয়েছেন আকাশবাণীকেই৷ গত রবিবারও তাঁর ‘মন কি বাত' অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়েছে বেতারে৷ কিন্তু, তার আগে থেকেই দেশের বিভিন্ন শহর থেকে প্রচারিত আকাশবাণীর কেন্দ্রগুলি নীরব হয়ে গিয়েছিল৷ যদিও লকডাউন চলাকালীন গণমাধ্যমের মতো জরুরি পরিষেবাকে এর আওতার বাইরে রাখা হয়েছে৷
মার্চের শেষ সপ্তাহে আকাশবাণী কলকাতাসহ বিভিন্ন শহরের শ্রোতারা কী শুনলেন? তাঁরা রেডিও টিউন করতেই শুনলেন, শুধু হিন্দি গান বাজছে৷ মুম্বই থেকে প্রচারিত বিবিধভারতীর সঙ্গে কলকাতাসহ অন্যান্য শহরের কেন্দ্রগুলিকে জুড়ে দেওয়া হয়েছে৷ এমনকি বাতিল করে দেওয়া হলো সংবাদও৷ আকাশবাণী কলকাতার সংবাদ বিভাগ তাদের ফেসবুক পোস্টে জানালো, পরবর্তী নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত দিনের অধিকাংশ বুলেটিন বন্ধ থাকবে৷ এর সঙ্গে সকালের প্রাত্যহিকী থেকে শুরু করে গানের ভেলা কিংবা মহিলা মহলের মতো অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেল৷ দিনে নামমাত্র সংবাদ ও করোনা সচেতনতার অনুষ্ঠান দিয়ে কেটে গেল মার্চের শেষ সপ্তাহ৷
আকাশবাণীর এই রহস্যজনক পরিবর্তনে বিভিন্ন মহলে সমালোচনা শুরু হয়৷ এই সংকটকালীন সময়ে মানুষকে সচেতন করতে যখন আরো বেশি সক্রিয়তা প্রত্যাশিত, তখন নীরব কেন দেশের এই ঐতিহ্যশালী প্রতিষ্ঠান? প্রশ্ন উঠে যায়, প্রসার ভারতীর অধীনস্থ দূরদর্শন যেখানে পুরনো জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ফিরিয়ে এনে ঘরবন্দি মানুষের বিনোদনের চেষ্টা করছে, তখন একই ছাতার তলায় থাকা আকাশবাণীর সমস্যা কোথায়? এই প্রশ্নের উত্তর মেলেনি৷ ভিন্ন সূত্রে শুধু আভাস পাওয়া যাচ্ছে, লকডাউনের ফলে প্রতিদিনের স্বাভাবিক কাজকর্ম চালিয়ে যাওয়া সম্ভব না হওয়ায় অনুষ্ঠানসূচিতে ব্যাপক কাটছাঁট করতে হয়েছে৷ এতে শ্রোতারা আশাহত হয়েছেন৷ আকাশবাণীর একনিষ্ঠ শ্রোতা, বেতার নাটকের গবেষক, অধ্যাপক নিখিলরঞ্জন প্রামাণিক বলেন, ‘‘কলেজ বন্ধ থাকায় বাড়িতেই সারাক্ষণ আটকে আছি৷ এই সময় ভেবেছিলাম কত নাটক শুনবো৷ আকাশবাণীর ভাণ্ডারে অতীতের কত অনুষ্ঠান আছে, সেগুলি নিশ্চই বাজানো হবে৷ কিন্তু, গীতাঞ্জলি টিউন করলেই শুনছি, হিন্দি গান বাজছে৷ দূরদর্শন পুরনো সিরিয়াল দেখাচ্ছে, আকাশবাণী কেন পারলো না?’’
কয়েকদিন একটানা হিন্দি গান-বাজানোকে অনেকে ভাষার আগ্রাসন বলছেন৷ একাংশের মতে, আকাশবাণীকে গুরুত্বহীন প্রমাণ করে এই প্রতিষ্ঠানকে সঙ্কুচিত করার বার্তা দিলো কেন্দ্রীয় সরকার৷ আকাশবাণীর প্রাক্তন কর্মী গৌতম সেনগুপ্ত ডয়চেভেলেকে বলেন, ‘‘সংকটের সময় আকাশবাণীর ভূমিকা বরাবরই প্রশংসনীয়৷ কিন্তু, এবার অনুষ্ঠান ঠিকঠাক হচ্ছে না৷ ওদের কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে চলতে হয়৷ কী নির্দেশ এসেছে, সেটা বলতে পারবো না৷ যদিও বিষয়টি অন্য মাত্রা পেয়েছে শীর্ষস্থানীয় দৈনিক সংবাদপত্র টাইমস অফ ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত একটি খবরে৷ তারা সেখানে কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী প্রকাশ জাওড়েকরকে উদ্ধৃত করে লিখেছে, সরকার আকাশবাণীর কর্মকর্তাদের এই আচরণে ক্ষুব্ধ৷ এমনকী মন্ত্রী প্রশ্ন তুলেছেন, কোন নির্দেশের বলে বেতার অনুষ্ঠানে কাটছাঁট করা হলো? এই সংবাদ প্রকাশের পরপরই আকাশবাণীর নীরবতা একটু একটু করে কাটছে৷ দিন দুয়েক ধরে আকাশবাণী কলকাতায় কিছু নিয়মিত অনুষ্ঠান শোনা যাচ্ছে৷ সঙ্গে রয়েছে চলমান পরিস্থিতি সম্পর্কে বিশেষ বুলেটিন ও সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান৷
মুক্তিযুদ্ধের সময় সংবাদ পরিবেশনে আকাশবাণীর ভূমিকা এই প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে জুড়ে রেখেছে৷ বর্তমানে যথেষ্ট জনপ্রিয় মৈত্রী চ্যানেল৷ সম্প্রতি দুই দেশের সরকারের মধ্যে চুক্তির মাধ্যমে স্থির হয়েছে, বাংলাদেশ বেতারে শোনা যাবে আকাশবাণীর অনুষ্ঠান৷ একইভাবে ঢাকার অনুষ্ঠান প্রচারিত হবে কলকাতা থেকে৷ তাই আশা ছাড়তে রাজি নন অনেকেই৷ আকাশবাণীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মী, দূরদর্শনের প্রাক্তন সংবাদপাঠক দেবাশিস বসু ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘অনুষ্ঠান যখন শুনতে পাইনি, তখন ধরে নিয়েছে কোনো কারণ রয়েছে এর পিছনে৷ শুনতে পেলে ভালো লাগত৷ ধীরে ধীরে আকাশবাণী স্বাভাবিক হচ্ছে, এটা আশার কথা৷’’
দেখুন ৩১ মার্চের ছবিঘর...