সংক্রমণের মুখে কতটা নিরাপদ করোনা যোদ্ধারা
১৬ জুলাই ২০২০পশ্চিমবঙ্গে করোনায় মৃত্যু হাজার ছাড়িয়েছে৷ প্রতিদিন নতুন সংক্রমিতের সংখ্যা আগের দিনের হিসেব ছাপিয়ে যাচ্ছে৷ সাধারণ মানুষের সঙ্গে এই তালিকায় রয়েছেন সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন ক্ষেত্রের কর্মীরা, যাঁরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিভিন্ন জনপরিষেবার সঙ্গে যুক্ত৷ সম্প্রতি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট দেবদত্তা রায়ের মৃত্যুতে শোরগোল পড়ে গিয়েছে৷ শুধু তিনি নন, সরকারি হিসেবে মোট ১২ জন করোনা যোদ্ধার মৃত্যু হয়েছে৷ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই এই তথ্য দিয়েছেন বুধবার৷ তিনি বলেছেন, এখনো পর্যন্ত ৪১৫ জন যোদ্ধার মধ্যে করোনা ভাইরাস পাওয়া গিয়েছে৷ এঁদের মধ্যে ২৬৮ জন পুলিশকর্মী, ৩০ জন স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছেন৷ আক্রান্ত নার্সের সংখ্যা ৪৩৷ অন্যান্য সরকারি কর্মীর সংখ্যা ৬২ জন৷
মুখ্যমন্ত্রীর দেওয়া তথ্য থেকে স্পষ্ট, কতটা বিপদের মধ্যে রয়েছেন সরকারি ও বেসরকারি পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত কর্মীরা৷ পরিযায়ী শ্রমিকদের বিষয়টি দেখভাল করছিলেন দেবদত্তা৷ তারপর তাঁর করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু ঘটে৷ এর পরে এসেছে ব্যাংককর্মী সুদীপ্ত দাসের মৃত্যুর খবর৷ স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার এই আধিকারিক নিয়মিত ব্যাঙ্কের শাখায় কাজ করছিলেন৷ স্বাস্থ্যকর্মী ও নার্সরা সরাসরি রোগীর সংস্পর্শে আসেন বলে তাঁদের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি৷ তবে করোনা যোদ্ধাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন পুলিশকর্মীরাই৷ ট্র্যাফিক গার্ড থেকে থানার কনস্টেবল, কর্মীদের মৃত্যুতে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে৷ পরিষেবার বিভিন্ন ক্ষেত্রে আরও কত মানুষ জড়িয়ে৷ পুরসভার কর্মী থেকে বাসের কন্ডাক্টর, কে নয়! দক্ষিণ দমদম পুরসভার ১২ জন কর্মীর করোনা পজিটিভ হওয়ায় কয়েকদিন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে গোটা পুরসভাই৷ পুরসভার একজন কর্মীর বক্তব্য, ‘‘রোজ কত মানুষ আমাদের কাছে কাজের সূত্রে আসেন৷ তাঁদের ফিরিয়ে দেওয়া যায় না৷ তাই ঝুঁকি নিয়েই কাজ করতে হচ্ছে৷’’ ব্যাংকের প্রতিটি শাখার সামনে লম্বা লাইন৷ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যাংককর্মী বলেন, ‘‘ছফুট দূরত্ব রাখা গেলে ভালো৷ কিন্তু সেটা পারছি কই! এত গ্রাহকের ভিড়৷ ছুটি নিয়ে বসে থাকারও উপায় নেই৷’’
এই যদি হয় পুরসভা কিংবা ব্যাংকের অবস্থা, তাহলে কোথায় দাঁড়িয়ে আছেন চিকিৎসক আর নার্সরা? সত্যিই যে আতঙ্ক আছে, সেটা স্বীকার করে নেন বাঁকুড়ার ডেপুটি সিএমওএইচ, চিকিৎসক সজল বিশ্বাস৷ একেবারে তৃণমূল স্তরে কাজ করতে হচ্ছে তাঁদের৷ এই চিকিৎসকের বক্তব্য, ‘‘নিজেকে সুরক্ষিত রাখার সামগ্রী আমাদের কাছে ঠিকঠাক সরবরাহ করা হচ্ছে না৷ অথচ আমাদেরই সবচেয়ে বেশি সংক্রমণের ভয়৷ হাসপাতালের রোগী পরিষেবা থেকে দপ্তরের কাজে যুক্ত কর্মী, সকলের জন্যই পর্যাপ্ত সুরক্ষার সামগ্রী দরকার৷’’
সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অংশুমান মিত্র খুবই উদ্বিগ্ন৷ তাঁর বক্তব্য, ‘‘স্বাস্থ্য পরিষেবাকে কর্পোরেটের হাতে তুলে দিলে যা হয়, তাই হচ্ছে৷ আমরা খুবই ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছি৷ মে মাসের গোড়া থেকে পিপিই দেওয়ার কথা বলা হয়েছে৷ তার আগে পর্যন্ত কোনো সুরক্ষা ছাড়াই কাজ করেছি৷ অথচ ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীরা আক্রান্ত হলে সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়বে৷’’ করোনা রোগীর সংস্পর্শে আসা স্বাস্থ্যকর্মীদের যেভাবে কোয়ারান্টিনে রাখা হয়েছে, তারও সমালোচনা করেন অংশুমান৷
ইতিমধ্যে মুখ্যমন্ত্রী ক্ষতিপূরণের ঘোষণা করেছেন৷ সরকারি পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত মৃত করোনা যোদ্ধার পরিবারকে ১০ লক্ষ টাকা দেওয়ার পাশাপাশি একজনের কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে৷ যোদ্ধাদের মধ্যে করোনা আক্রান্তরা পাচ্ছেন এক লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ৷ যদিও টাকার পরিবর্তে আগাম সুরক্ষাতেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন যোদ্ধারা৷ চিকিৎসক সজল বিশ্বাসের দাবি, যাঁরা করোনার বিরুদ্ধে লড়ছেন, তাঁদের জন্য আলাদা হাসপাতাল করা হোক৷ আগাম রক্ষাকবচের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি আক্রান্ত হলে চিকিৎসার নিশ্চয়তা থাকা প্রয়োজন৷