সব আমলেই আক্রান্ত সংখ্যালঘুরা
৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এসেই সংখ্যালঘুদের নির্যাতন শুরু করে৷ বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেয়া, জমি দখল করা, মারধোর, এমনকি সংখ্যালঘু পরিবারের নারীদের ধর্ষণের মতো অপরাধেও জড়িতে পড়ে তারা৷ এরপর ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ৷ প্রথমদিকে সংখ্যালঘুদের ওপর খুব একটা নির্যাতন না হলেও, বছরখানেক যাবৎ নির্যাতনের ভয়াবহ মাত্রা যুক্ত হয়েছে৷ আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপিরা সংখ্যালঘুদের জমি দখল করে নিচ্ছে, ভয়ভীতি দেখিয়ে অনেককে দেশত্যাগেও বাধ্য করা হচ্ছে৷ অথচ সরকারের তরফ থেকে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না৷''
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর যেখানে অমুসলিমদের সংখ্যা ছিল ২৯ দশমিক ৭ শতাংশ, সেখানে বর্তমানে এ সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৯ দশমিক ৭ শতাংশে৷ রানা দাশগুপ্তের কথায়, ‘‘সংখ্যালঘুদের প্রতি মানবতাবিরোধী অপরাধ রোধ করা না গেলে, তা হবে ১৯৭১-এ অর্জিত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের জন্য একটি জাতীয় লজ্জা৷ তাই সরকারকে এখনই দৃশ্যমান ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে৷''
সর্বশেষ নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার বনপাড়ায় গত বৃহস্পতিবার রাতে এক খ্রিষ্টান দম্পতিকে মারধর করে অচেতন অবস্থায় ফেলে রেখে যায় অজ্ঞাত দুর্বৃত্তর৷ সাবেক স্কুলশিক্ষক গ্যাব্রিয়েল কস্তা ও তাঁর স্ত্রী বীণা পিরিসের ঘরে ঢুকে তাঁদের পিটিয়ে অচেতন করা হয়৷ ঘটনার পর কয়েকদিন চলে গেলেও পুলিশ সন্দেহভাজন কয়েকজনকে আটক করে দায় সেরেছে৷ কিন্তু মারধোরের কারণই এখনও তারা শনাক্ত করতে পারেনি৷ পুলিশ শুধু বলছে, ঘটনাটি রহস্যজনক৷
ঠাকুরগাঁওয়ের সংসদ সদস্য দবিরুল ইসলামসহ আওয়ামী লীগের কয়েকজন সংসদ সদস্য ও নেতার বিরুদ্ধে সংখ্যালঘুদের জমি দখলের অভিযোগ অনুসন্ধান করেছে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র, ব্লাস্ট, পূজা উৎযাপন পরিষদ, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদসহ ৮টি সংগঠনের প্রতিনিধিরা৷ গত ৮ জানুয়ারি অনুসন্ধান দলটি এক সাংবাদিক সম্মেলনে তাদের প্রতিবেদন উপস্থান করে৷ সেখানে ৮টি সংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন৷
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল প্রতিবেদন উপস্থাপন অনুষ্ঠানে বলেন, ‘‘ঠাকুরগাঁওয়ের ঘটনাতে এমপি দবিরুল ইসলাম সরাসরি জড়িত থাকার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে৷ এছাড়া ফরিদপুরে ঘটনাতেও একজন মন্ত্রীর নামও এসেছে৷ পিরোজপুরের এমপি একেএমএ আউয়ালও একইভাবে সংখ্যালঘুদের নির্যাতন করছে৷ দিনাজপুরের পার্বতীপুরে ক্ষত্রিয় পরিবারের ৫৫টি পরিবারের ওপর অত্যাচার ও নির্যাতন হচ্ছে৷ এর সঙ্গে জড়িত এমপি মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার৷ এরা সবাই সরকারি দলের মন্ত্রী ও এমপি৷''
সেখানে লিখিত বক্তব্যে অভিযোগ করা হয়, ‘জোরপূর্বক ভূমিদখল, সহিংস হামলা ও নির্যাতনের ঘটনা একাধিকবার ঘটছে৷ পুলিশ এ সব বিষয় জানলেও, এখন পর্যন্ত এ সব ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি৷ কোনো নির্যাতনকারী গ্রেপ্তার হয়নি৷ স্থানীয় প্রশাসনের ভূমিকাও বিস্মিত করছে৷ শুধু ঠাকুরগাঁও নয়, সারা দেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সম্পত্তি দখলের একের পর এক একই ধরণের ঘটনা এবং তাতে প্রশাসনের নীরব ভূমিকা দেখে আমরা হতবাক হচ্ছি৷'
ঐ অনুষ্ঠানে ঠাঁকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী থেকে আসা ভুক্তভোগী জিতেন চন্দ্র সিং এমপি দবিরুলের ছেলে মাজহারুল ইসলামের নেতৃত্বে তার ছোট ভাই ভাকারাম সিংয়ের উপর হামলার বর্ণনা দেন৷ তিনি বলেন, ‘‘তারা জমি দখল করতে এসেছিল৷ এক পর্যায়ে তারা ভাকারামকে পায়ে-পিঠে চাপাতি দিয়ে কোপায়৷'' ওই হামলার পর তাঁর ছেলে অভিলাল সিং পালিয়ে দিল্লি চলে গেছে বলেও জানান জিতেন চন্দ্র সিং৷
মহানগর পূজা উৎযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নারায়ণ সাহা মনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘১৯০৮ সালে ঢাকেশ্বরী মন্দিরের জমি ছিল ২০ বিঘা৷ বিভিন্নভাবে দখলের পর এখন ঢাকেশ্বরী মন্দিরের জমি আছে মাত্র ৬ বিঘা৷ ঢাকেশ্বরী মন্দিরের জমিই যদি এভাবে দখল হয়ে যায়, তাহলে সাধারণ হিন্দু বা সংখ্যালঘুদের অবস্থা কত কঠিন? সারাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের পুরো চিত্র মিডিয়ায় আসে না৷ কিছু আসে, কিছু লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যায়৷ কিন্তু একটি ঘটনায়ও কোনো আসামী গ্রেপ্তার বা বিচার পাওয়ার কোনো নজির এই সরকারের আমলেও নেই৷''
সাম্প্রদায়িক নির্যাতন বন্ধে সরকারের পদক্ষেপ দাবি করে সংখ্যালঘু কমিশন গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি৷ একই সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মতো সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠনের আহ্বান জানানো হয়েছে৷ সম্প্রতি আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে বৈঠক করে সংগঠনটির নেতারা এই দাবি জানান৷ আইনমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘‘আমরা সংখ্যালঘু কমিশন গঠনের দাবি তুলে ধরেছি৷ মন্ত্রী আমাদের প্রস্তাবকে নীতিগতভাবে সম্মতি জানিয়েছেন৷'' আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেন, ‘‘বিষয়টি নিয়ে নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে আলাপ-আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নেয়া হবে৷''
ডয়চে ভেলের অপর এক প্রশ্নের জবাবে অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘‘সরকার ও সব রাজনৈতিক দলকে দ্রুততার সঙ্গে সংখ্যালঘু সেল গঠন করে বিশেষ বিবেচনায় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছি৷ একদিকে স্বাধীনতাবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তির ছত্রচ্ছায়ায় ঠিক পাকিস্তানি আমলের মতোই সংখ্যালঘুদের দেশ থেকে বিতাড়নের চেষ্টা চালানো হচ্ছে, অন্যদিকে ক্ষমতাসীন জোটেরও কেউ কেউ অনাকাঙ্খিতভাবে সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি দখলের প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছেন৷''
শুধু তাই নয়, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে প্রকাশিত নির্যাতনের ক'টি সচিত্র খবরের ভিত্তিতে অত্যন্ত উদ্বেগ জানান হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের এই নেতা৷ ২০১০ সালের শেষের দিকে গঠিত ‘শাহাবুদ্দিন কমিশন'-এর সুপারিশ বাস্তবায়নের তাগিদও দিয়েছেন তিনি৷
২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত সাতটি সাম্প্রদায়িক ঘটনার কথা উল্লেখ করে রানা দাশগুপ্ত বলেন, ‘‘১৫ জন আদিবাসীকে হত্যা, ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনসহ সাতজন আদিবাসী নারীকে হত্যা, ১২৬ জন আদিবাসীকে শারীরিক নির্যাতন, ৫৪টিরও বেশি বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া এবং উত্তরবঙ্গে ৬০টি পরিবারের ৩০০ জন আদিবাসীকে ভয়ে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে৷ নির্যাতনের কারণে ক্রমাগত এমন দেশত্যাগের ফলে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু জনসংখ্যা উদ্বেগজনক হারে কমছে৷
বন্ধু, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু জনসংখ্যা হ্রাস পাওয়ার প্রধান কারণ কী বলে আপনার মনে হয়? জানান নীচের ঘরে৷