সংখ্যালঘু নির্যাতনে সংবাদমাধ্যমের আচরণ নিয়ে প্রশ্নগুলো
২২ অক্টোবর ২০২১এবার কুমিল্লার পূজা মণ্ডপের ঘটনার পর সংবাদ প্রকাশে বাংলাদেশের মূল ধারার সংবাদমাধ্যম ‘দায়িত্বশীলতার’ পরিচয় দিয়েছে বলে অনেকেই দাবি করছেন৷ তারা সংবাদ চেপে রেখেছে৷ হামলার খবর প্রকাশ ও প্রচারে ‘সংযমী ছিলেন৷ কিন্তু আমি এর বিরোধিতা করি৷
আমি মনে করি এটা করে তারা নির্যাতন, আগুন, হামলা, ভাঙচুরের ঘটনা পাশ কাটিয়ে গেছেন৷ আর তাতে নির্যাতনের শিকার যারা তারা আরো বেশি নির্যাতনের মুখে পড়েছেন৷ তাদের রক্ষায় রাষ্ট্রের যে পদক্ষেপ নেয়া দরকার ছিলো তা নিতে দেরি হয়েছে৷ হামলাকারীরা এই সুযোগে তাদের হামলা বাড়িয়ে দিয়েছে৷ আর ছড়িয়েছে গুজব৷ সেই গুজবে পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে৷
আমার বিবেচনায় ঘটনাকে চেপে যাওয়া নয়, দায়িত্বশীলতার সাথে প্রকৃত ঘটনা তুলে ধরাই সংবাদমাধ্যমের কাজ৷ যদি তা করা না হয় তাহলে দুর্বৃত্তরা আরো সাহসী হয়ে উঠে৷ হয়েছেও তাই৷ আর একটি চক্র ই সুযোগে গুজবের পর গুজব ছড়িয়ে ফায়দা নিতে শুরু করে৷
আমি কুমিল্লার ঘটনার পর সংখ্যালঘুদের ওপর ধারাবাহিক হামলার বিষয়ে টেলিভিশন, প্রিন্ট এবং অনলাইন সাংবাদিকতার বেশ কয়েকজন নীতি নির্ধারকের সঙ্গে কথা বলেছি৷ তাদের মতে কুমিল্লার মন্দির, মণ্ডপ এবং বাড়ি ও দোকানপাটে যে তাণ্ডব চালানো হয়েছে তার অনেক কিছুই তখন সংবাদমাধ্যম প্রকাশ করেনি৷ ধর্মীয় স্পর্শকাতর বিবেচনায় তারা এমন করেছে৷ কিন্তু তাতে কি হামলা থেমেছে? চাঁদপুরে চারজন নিহত হওয়ার ঘটনা কোন প্রেক্ষাপটে ঘটেছে তাও প্রকাশ করা হয়নি৷ বিভিন্ন স্থানে হামলায় আরো যে চারজন মারা গেছেন তারও বিস্তারিত এবং ধারাবাহিক তথ্য প্রকাশ করা হয়নি৷
নোয়াখালী আর রংপুরে বর্বতার চিত্রও সংবাদমাধ্যম তখন তেমনভাবে প্রকাশ করেনি৷ এখন অবশ্য সাত-আট দিন পর কোনো কোনো সংবাদমাধ্যম তা সরেজমিন প্রতিবেদনের মাধ্যমে প্রকাশ শুরু করেছে৷ তাতে ভয়াবহ বর্বরতার কথা জানা যাচ্ছে৷ কিন্তু শুরুতেই প্রকাশ করা হলে এই ঘটনা বাড়তে পারত না বলে আমার বিশ্বাস৷ সরকার দ্রত ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হত৷
নোয়াখালীর একজন সাংবাদিক আমাকে জানিয়েছেন তারা এখন নির্যাতিত সংখ্যালঘুদের তোপের মুখে পড়ছেন সরেজমিন প্রতিবেদন করতে গিয়ে৷ আমরা মনে হয়েছে এই ক্ষোভ স্বাভাবিক৷ কারণ যখন ঘর পুড়ল, মন্দির ভাঙল, দোকানপাটে লুটপাট হলো তখন তথ্য প্রকাশ না করে এখন সব কিছু শেষ হয়ে যাওয়ার পর কেন এই মায়া কান্না! বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলোর উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত প্রতিনিধি আছে৷ জেলায় তো আছেই৷ আর শুনি এখন নাকি সবখানেই শত শত সাংবাদিক৷ মোবাইল, ইন্টারনেটসহ যোগাযোগ ব্যবস্থাও উন্নত৷ তাহলে তারা একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের চরম সংকটে তারা কী সাংবাদিকতা করলেন? আর আমরা যারা নিউজ ম্যানেজার তারাই বা কী করলাম?
আনাচে কানাচে শুধু সাংবাদিকই নয় এখন জেলায় জেলায় পত্রিকা আর অনলাইনের ছড়াছড়ি৷ উপজেলায়ও আছে৷ তাদের সামনেই তো ঘটনা ঘটেছে৷ খোঁজ নিয়ে দেখেছি সেসব এলাকায় হামলা হয়েছে সেখানকার স্থানীয় সংবাদমাধ্যমও চেপে যাওয়ার নীতিতেই ছিলো৷ তারাও যদি প্রকাশ করতেন তাহলে এই অনলাইনের যুগে সবাই প্রকৃত তথ্য পেতেন৷
প্রকৃত তথ্য যখন পাওয়া না যায় তখন গুজব শক্তিশালী হয়৷ মূল ধারার সংবাদমাধ্যম যখন ‘ধরি মাছ না ছুই পানি’ ধরনের সাংবাদিকতা করে তখন এই যুগে মানুষ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা ফেসবুকে তথ্য পেতে চাইবে৷ তাই কুমিল্লার ঘটনার পর যখন মানুষ মূল ধারার সংবাদমাধ্যমে পর্যাপ্ত তথ্য পায়নি তখন ফেসবুকেই ভরসা করেছে৷ এই সুযোগ নিয়েছে দুর্বৃত্তরা৷ তারা সংঘবদ্ধভাবে গুজব ছড়িয়েছে৷ আর তা ভাইরাল হয়েছে দ্রুততম সময়ে৷ গুজবের কাউন্টার দিতে গিয়ে আরেকটি সংঘবদ্ধ গ্রুপ কাউন্টার গুজব ছড়িয়েছে৷ ফলে যা হয়েছে গুজবে গুজবে সয়লাব হয়েছে৷ যে যার অবস্থান অনুযায়ী গুজবের পিছে ছুটেছে৷ শেয়ার করেছে৷ আর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী গুজবের বিরুদ্ধে যখন তৎপর হয়েছে তখন গুজব সৃষ্টিকারীরা ফসল ঘরে তুলে নিয়েছে৷
আসলে গুজব চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে যত সময় লাগে সেই সময়ের মধ্যে যা ঘটার ঘটে যায়৷ এখন ধরা যাবে৷ ব্যবস্থা নেয়া যাবে৷ কিন্তু ঘটনা তো ঘটে গেল৷ ডে ওয়ান থেকেই যদি সংবাদমাধ্যম দায়িত্বশীলতার সাথে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরত তাহলে আমার বিশ্বাস হামলার ছড়িয়ে পড়ত না৷ এখন তো সংবাদমাধ্যম তাৎক্ষণিকভাবে সংবাদ প্রকাশ করতে পারে৷ ২৪ ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয় না৷ ফলে দেশের মানুষও আসল ঘটনা জানতে পেরে সচেতন হত৷ গুজবে কান দিত না৷ রাষ্ট্র এবং সরকারের অর্গানগুলো চাপে পড়ত৷ হামলা ঠেকাতে দ্রুত ব্যবস্থা নিত৷
ধর্মীয় বিষয়সহ আরো অনেক বিষয় আছে যা স্পর্শকাতর৷ সেখানে খবর পরিবেশনে অবশ্যই দায়িত্বশীল হতে হয়৷ কিন্তু দায়িত্বশীলতা মানে খবর ব্ল্যাক আউট করা নয়৷ দায়িত্বশীলতা মানে নির্যাতনের খবর হালকাভাবে প্রকাশ করা নয়৷ সাংবাদিকতায় তথ্য পরিবেশনে অর্ধ সত্যের কোনো জায়গা নেই৷ দুর্বৃত্তদের প্রতি সদয় হওয়ার কোনো বিষয় নেই৷ যদি তাই হয় তাহলে তা দুর্বৃত্তদের পক্ষে যায়৷ নির্যাতিতের কান্না আরো বাড়িয়ে দেয়৷ তাই প্রশ্ন তোলাই যায়, এবার কি বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমও তাহলে সংখ্যালঘুদের সাথে সংখ্যাগুরুর আচরণ করেছে?