রাষ্ট্রধর্ম রাখা মুক্তিযুদ্ধের পরিপন্থি
২২ মার্চ ২০১৬ঐ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে সে সময়েই, অর্থাৎ জুন মাসেই সাবেক প্রধান বিচারপতি কামাল উদ্দিন হোসেনসহ ১৫ জন বিশিষ্ট নাগরিক হাইকোর্টে রিট করেন৷ দীর্ঘ ২৩ বছর যাবৎ আবেদনটি হাইকোর্টে বিচারাধীন রয়েছে৷ এ সময়ের মধ্যে রিটকারী ১৫ বিশিষ্ট নাগরিকের মধ্যে ১০ জন মারাও গেছেন৷ তখন রিটের আবেদনকারীদের আইনজীবী ছিলেন সুব্রত চৌধুরী৷ বর্তমানেও রিটকারীদের আইনজীবী হিসেবে লড়ছেন সুপ্রিম কোর্টের সেই সিনিয়র আইনজীবী৷ ডয়চে ভেলের সঙ্গে তাঁর আলাপচারিতায় উঠে এসেছে কোন প্রেক্ষিতে তাঁরা রিটটি করেছিলেন, সেই কথা৷ এই আইনজীবীর মতে, ‘‘সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম রাখা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থি৷'' কিন্তু বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আমলে পঞ্চদশ সংশোধনীতেও রয়ে গেছে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম৷
ডয়চে ভেলে: কোন প্রেক্ষিতে আপনারা রিটটি করেছিলেন?
সুব্রত চৌধুরী: ১৯৮৮ সালে জেনারেল এরশাদ যখন সংবিধানে আর্টিকেল ২(এ) সংযোজন করে রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে আসেন, তখন আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ সকল রাজনৈতিক দল এর বিরোধিতা করেছিল৷ এমনকি তারা একদিন হরতালও ডেকেছিল৷ তারা বলেছিল, কোনোদিন যদি তারা রাষ্ট্রক্ষমতায় আসতে পারে তাহলে এরশাদের এ সব কাজকে অবৈধ ঘোষণা করা হবে এবং আর্টিকেল ২(এ)-টিও বাতিল করা হবে৷ এমনটা তখন সকলেরই অঙ্গীকার ছিল৷ তারপরও সে সময়কার ১৫ জন বুদ্ধিজীবী মিলে একটি রিট আবেদন করেন, ১৯৮৮ সালের জুন মাসে৷ তখন অষ্টম সংশোধনীতে দু'টি অংশ ছিল৷ একটা হলো, হাইকোর্টকে পাঁচটি শহরে নিয়ে যাওয়া৷ সেটার একটা রিট হয়৷ আর অন্য রিটটা হয় এই রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে৷ তখনকার সিনিয়র আইনজীবীরা বলেছিলেন, আগে হাইকোর্টের রিটটা ধরি, তারপর রাষ্ট্রধর্ম রিটটা ধরব৷
হাইকোর্ট নিয়ে যে রিটটা হলো, সেটা আপিল বিভাগ পর্যন্ত গেল এবং বাতিল হয়ে গেল৷ আর রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে যে রিটটা হলো, সেটা করেছিলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি কামাল উদ্দিন হোসেন, সুফিয়া কামাল, কে এম সোবহান, বিচারপতি দেবেশ চন্দ্র ভট্রাচার্য, কলিম শরাফী, অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদসহ ১৫ জন৷ এঁদের মধ্যে ১০ জন মারা গেছেন৷ অর্থাৎ আর মাত্র পাঁচজন এখন জীবিত আছেন৷ সে সময় আইনজীবীরা বলেছিলেন, ‘এই মামলাটার জন্য আরো কিছুদিন সময় নেই, দেখি আস্তে-ধীরে কী করা যায়৷' আমি ঐ রিটের ফাইলিং ল'ইয়ার ছিলাম৷ ফয়েজ আহমেদ সকলের পক্ষ থেকে এফিডেফিট করেছিলেন৷ এরপর ২০০৯ সালে আমরা মনে করলাম আর দেরী করা যাবে না৷ তাছাড়া সে সময়কার জজ সাহেবরা মামলাটা শুনতেও চাননি৷ তাঁরা বলেছেন, ‘এটা থাক, এটা থাক৷' ২০১১ সালে অষ্টম সংশোধনীর আর্টিকেল ২(এ) ওপর রুল ইস্যু হলো৷ প্রশ্ন উঠলো, এটা কেন বেআইনি এবং কেন এটা বাতিল ঘোষণা করা হবে না৷ এরপর পঞ্চদশ সংশোধনীতে আর্টিকেল ২(এ) আবারো সন্নিবেশিত করা হলো৷ এরশাদের ওটা একটু মডিফাই করে আওয়ামী লীগ সরকার আবার এটা করল৷ এটার ওপর আবার সাপ্লিমেন্টারি রুল ইস্যু হলো৷ পঞ্চদশ সংশোধনীতে শুধু আর্টিকেল ২(এ) চ্যালেঞ্জ করা হলো৷ অর্থাৎ ১৯৮৮ সালের মামলাতে দু'টো রুল পেন্ডিং হয়ে গেল৷ এই দু'টি রুলই এ মুহূর্তে শুনানির জন্য একটি বৃহত্তর বেঞ্চে অপেক্ষাধীন আছে৷
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে যে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম৷ তারপরও এই রিট চলে কি? কারণ আপিল বিভাগের রায়ের প্রেক্ষিতেই তো পঞ্চদশ সংশোধনী হয়েছিল?
না, না৷ আপিল বিভাগের রায় কিন্তু রাষ্ট্রধর্মের কোনো বৈধতা দেয়নি৷ পঞ্চম সংশোধনীর রায়ে জিয়াউর রহমান সাহেব যে কাজগুলো করেছেন, সংবিধানকে একটা সাম্প্রদায়িক আবহে এনেছেন, সেটাকে সম্পূর্ণ অবৈধ ঘোষণা করেছে আদালত৷ যে কারণে পঞ্চদশ সংশোধনীতে আমাদের চার মূলনীতি আবারো বহাল করলাম৷ আর্টিকেল টুয়েলভে বলা আছে, রাষ্ট্র কোনো ধর্মকে বিশেষ মর্যাদা দেবে না৷ ধর্মের ভিত্তিতে কারো প্রতি বৈষম্য হবে না৷ ১৯৭২ সালের সংবিধানে ছিল যে আমাদের চারটি জাতীয় মূলনীতি আমরা পুনর্বহাল করলাম৷ সেখানে আর্টিকেল ২(এ) পুনর্বহালর আর তো কোনো সুযোগ নেই৷ এটা সম্পূর্ণ কন্ট্রাডিকটরি এবং রায়ের খেলাপ৷ পঞ্চম সংশোধনীর রায়ে এমনভাবে বলা হয়েছে যে, সেখানে কোনো ধরনের ধর্মীয় আবহ রাখার কোনো সুযোগ ছিল না৷
পঞ্চাদশ সংশোধনী যখন উচ্চ আদালতের রায়ের প্রেক্ষিতে হয়, তখন সরকার একটি কমিটি করেছিল৷ ঐ কমিটি বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষের সঙ্গে কথা বলেছে৷ তখন এই বিষয়টা আপনারা তোলেননি কেন?
হ্যাঁ, অবশ্যই আমরা তুলেছি৷ কামাল হোসেন, আমিরুল ইসলাম ও মাহমুদুল ইসলাম সাহেব তখন আইনজীবীদের পক্ষ থেকে ঐ কমিটিতে গিয়েছিলেন৷ সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত সেই কমিটি তো তখন একমতই হলো যে, রাষ্ট্রধর্ম রাখা যাবে না৷ এই যে মামলাটা পেন্ডিং আছে, সেটাও তাদের বলা হয়েছে৷ সংবিধান সংশোধন কমিটি তো রাষ্ট্রধর্ম না রাখার পক্ষেই বক্তব্য দিয়েছে৷ এটা তো সিদ্ধান্তেই আছে৷ কিন্তু কিভাবে যেন অনেক কিছুই বদলে গেল৷
স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটির এ ধরনের রিট আবেদন করার এখতিয়ার কি আছে?
অবশ্যই আছে৷ কারণ তারা সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ৷ শুধু সংগঠন হিসেবে নয়, তারা ব্যক্তি হিসেবেও ১৫ জন আবেদন করেছেন৷ ১৯৭২-এর মূল চেতনায় ফিরে যাওয়ার জন্য আবেদন করেছেন৷ রাষ্ট্রধর্ম থাকলে সংবিধানের মূল চেতনা ধ্বংস করে দেয়৷ আদর্শ, মূল্যবোধ আর থাকে না৷
সরকার বলছে, তারা ৭২-এর সংবিধানে ফিরে গেছে৷ কিন্তু সেই সংবিধানে তো রাষ্ট্রধর্ম ছিল না৷ পঞ্চদশ সংশোধনীতে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল রাখা হয়েছে৷ এর প্রেক্ষিতে ৭২-এ ফিরে যাওয়ার যে কথা বলা হচ্ছে, তা কতটা যৌক্তিক?
এটা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়৷ আমি মনে করি, এটা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থি, আদর্শের পরিপন্থি বক্তব্য দিচ্ছে সরকার৷ এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না৷
রাষ্ট্রে তো বিভিন্ন ধর্মের মানুষ বাস করে৷ সেখানে সংবিধানে কোনো ধর্মের অন্তর্ভুক্তির প্রয়োজন আছে কি?
আমরা যে বাংলাদেশ চেয়েছিলাম এবং বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে বাংলাদেশ সৃষ্টি হলো – সকল শহিদদের স্বপ্ন, যে সকল মুক্তিযোদ্ধা, মানে যারা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, তারা তো সকলে বলবেই যে, আমরা সেই চেতনা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করিনি৷ আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, পাকিস্থানে এটা এসেছে জেনারেল জিয়াউল হকের সময়৷ আর বাংলাদেশে এটা নিয়ে আসল আরেকজন জেনারেল, একেবারে হুবহু, আর্টিকেল ২(এ)-তে৷ মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের সরকার এটা বহাল রাখবে, সেটা ১৬ কোটি মানুষের আশা-আকাঙ্খার একেবারেই পরিপন্থি৷
আপনি কিভাবে এই মামলার সঙ্গে সম্পৃক্ত হলেন?
১৯৮৮ সালে ঐ যে ১৫ জন শীর্ষ বুদ্ধিজীবী মামলাটা করল, আমার সৌভাগ্য হয়েছিল এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার৷ যখন পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হলো, তখন অনেক বেশি উৎসাহিত হলাম৷ আমার মনে হয়, পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হওয়ায় আমরা যা অর্জন করলাম, তা পরিপূর্ণ করতে হলে সংবিধানে কোনোভাবেই রাষ্ট্রধর্ম রাখা যাবে না৷
‘সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম রাখা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থি' – আপনি কি সুব্রত চৌধুরীর এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত? জানান মন্তব্যের ঘরে৷