‘সংরক্ষণ করে কোনো ভাষাই টিকিয়ে রাখা যায় না'
১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ডয়চে ভেলে : আদিবাসীদের কতগুলো ভাষা?
অধ্যাপক ড. সৌরভ সিকদার : গত তিন বছর, বিশেষ করে ২০১৫ ও ২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনষ্টিটিউটের পক্ষ থেকে আমরা একটা জরিপ করি৷ ওই জরিপে আমি নিজে প্রধান উপদেষ্টা ও প্রধান গবেষক ছিলাম৷ সেটা করতে গিয়ে আমরা বাংলাসহ ৪১টি ভাষা পেয়েছি৷ বাংলা বাদ দিয়ে যে ৪০টি ভাষা, তার মধ্যে ৩৪টি আদিবাসী ভাষা হিসেবে আমরা পেয়েছি৷ বিহারী বা পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের কিছু ভাষা আছে৷ সেগুলো এর মধ্যে আসেনি৷ শুধু আদিবাসী বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভাষা ৩৪টি৷
বাংলাদেশে এখন আদিবাসীর সংখ্যা কত?
এই সংখ্যাটা সুনির্দিষ্ট করে বলা যাবে না৷ ২০১১ সালের যে জনগণনা জরিপ ছিল, তাতে উল্লেখ ছিল ১৭ লাখ৷ কিন্তু আমরা বিভিন্ন গবেষণা ও বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বলতে পারি, এই সংখ্যাটা ২৮ থেকে ৩০ লাখ৷
সব আদিবাসীর কী আলাদা আলাদা ভাষা?
না, সবার আলাদা আলাদা ভাষা না৷ এখানে দুই রকম বিষয় আছে৷ একই আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে আলাদা ভাষার প্রচলন আছে৷ যেমন ধরেন, সিলেটে মনিপুরীরা৷ তাঁদের জাতি এক, ধর্ম এক, সবই এক৷ কিন্তু তাঁদের মধ্যে দু'টি ভাষার প্রচলন আছে৷ সেই দু'টি ভাষা একেবারেই ভিন্ন৷ দেখেন, আদিবাসী ফোরাম ও সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ যে প্রজ্ঞাপন আছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে ৪৯ থেকে ৫০টি আদিবাসী গোষ্ঠী আছে৷ কিন্তু তাঁদের ভাষা কিন্তু ৩৪টি৷ তার মানে, আদিবাসীদের গোষ্ঠী বেশি, ভাষার সংখ্যা কম৷ সিলেটের চা বাগানে যদি দেখেন, সেখানে ২১টি আদিবাসী গোষ্ঠী আছে৷ তাঁদের ভাষা কিন্তু একটা- পাদরী৷
তাঁদের ভাষার ভিন্নতা কেমন?
প্রত্যেকটা ভাষারই একটা সংগঠন আছে, একটা বাইরের দিক থেকে, আরেকটা ভেতরের দিক থেকে৷ সহজেই দেখেন, বাংলা ভাষাই কিন্তু একেক এলাকায় উপ-ভাষী বৈচিত্র্য রয়েছে৷ যেমন সিলেটের, চট্টগ্রামের বা নোয়াখালীতে একই বাংলা ভাষা, কিন্তু তাঁরা ভিন্নভাবে কথা বলেন৷ আদিবাসীদের মধ্যেও এমনটা আছে৷ এগুলো নিয়ে যথেষ্ট কাজ হয়নি৷ সার্বিকভাবে আমরা যদি ধরি, আদিবাসীদের যতগুলো ভাষা আছে, সবগুলোই সমৃদ্ধ ভাষা৷ সব ভাষার নিজস্ব বর্ণ নেই, কিছু ভাষার আছে৷ ২০০২ বা ২০০৩ সালে আমি যখন আদিবাসীদের ভাষা নিয়ে পিএইচডি করি, তখন মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, আগে অনেকগুলো ভাষা ছিল, এখন অনেক ভাষাই হারিয়ে গেছে৷
তাঁদের ভাষায় বর্ণের মিল কেমন?
আদিবাসীদের ভাষায় যে বর্ণ বা অক্ষর আছে, সেখানে কিছু সমস্যা বিদ্যমান৷ এখানে সবার লিপি নেই৷ যেমন চাকমা, মারমা বা মনিপুরী ভাষার নিজস্ব লিপি আছে৷ আর অধিকাংশই খ্রীষ্টধর্মের প্রভাবের কারণে রোমান হরফ ব্যবহার করেছে৷ যেমন, খাসিয়া বা গারোরা রোমান হরফ ব্যবহার করে৷ অতি সম্প্রতি ত্রিপুরাদের নিজস্ব ভাষায় বই বের করছে সরকার৷ সেখানেও রোমান হরফ ব্যবহার করা হচ্ছে৷ পার্বত্য চট্টগ্রামের অনেকগুলো গোষ্ঠী রোমান হরফ ব্যবহার করে৷ আবার দেখেন, চাক ও ব্রো কমিউনিটি নিজস্ব লিপি তৈরি করে নিয়েছে৷ আবার পাদরীরা বাংলা হরফ গ্রহণ করেছে৷
ভাষা কি আদিবসীদের আলাদা করেছে? নাকি আচরণ?
আসলে মানব জনগোষ্ঠী তার নিজস্ব নৃতাত্বিক পরিচয়ে বেড়ে উঠে৷ সেই হিসেবে বাঙালি যেমন একটা নৃতাত্বিক জনগোষ্ঠী, আবার গারো বা সাওতাঁলরাও কিন্তু একটা নৃতাত্বিক জনগোষ্ঠী৷ তাঁরা তাঁদের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট নিয়ে আলাদাভাবে বেড়ে উঠছে৷ যেমন ধরেন, একজন বাঙালির আকৃতি মাঝারি, চুল খাড়াও না বাঁকাও না৷ গায়ের উজ্জ্বল রঙ ফর্সাও না, আবার নিগ্রোদের মতো কালোও না৷ কিন্তু একজন চাকমার দেখা যাচ্ছে চোখ ছোট, চুল খাড়া এবং গায়ের রঙ ফর্সা৷ এটা হলো নৃতাত্বিক পরিচয়৷ ভাষা হলো সাংস্কৃতিক একটা উপাদান৷ সবকিছু মিলিয়েই একটা জাতি থেকে আরেকটা জাতি পৃথক৷
আদিবাসী ভাষায় যে বই আছে সেটা কী পর্যাপ্ত?
এখানে দু'টি বিষয়৷ বেসরকারি উদ্যোগে অনেক আগে থেকেই আদিবাসীদের মাতৃভাষায় বইপুস্তক ছিল সীমিত আকারে৷ সরকার ২০১০ সালে যে এডুকেশন পলিসি করেছে, সেখানে বলা হয়েছে, আদিবাসীদের জন্য মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা হবে৷ ৫টি আদিবাসীর ভাষায় প্রাথমিক পর্যায়ে তিনটি বই করা হয়েছে৷ আসলে ৬টি ভাষায় এটা করার কথা ছিল৷ কিন্তু লিপি বিতর্কের কারণে তিনটি বই করা যায়নি৷ আসলে রোমান হরফ নেবে, নাকি বাংলা হরফ নেবে, সে বিষয়ে সাঁওতালিদের মধ্যে সিদ্ধান্ত না হওয়ায় এটা করা যায়নি৷ তবে কিছু কাজ এখনো করা যায়নি৷ যেমন শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ বা ওইসব ভাষা জানা শিক্ষকদের নিয়োগ দেওয়া৷
ভাষার ক্ষেত্রে আদিবাসীরা কী ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হন?
ভাষার ক্ষেত্রে তাঁদের অনেক ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়৷ তাঁরা যখন ঘর থেকে বের হন, তখন তাঁদের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী, অর্থাৎ বাংলা ভাষাভাষীদের মুখোমুখি হতে হয়৷ সে কারণে তাঁদের বাংলা জানতে হয়৷ বৃহত্তর জনগোষ্ঠী সাঁওতালী বা চাকমা ভাষা শেখে না৷ ওই সাঁওতালী বা চাকমাকে শিখতে হয় বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ভাষা৷ দেখেন, একজন শিশু প্রথমেই স্কুলে গিয়ে পাচ্ছে ভিন্ন ভাষার বই, ভিন্ন ভাষার শিক্ষক বা ভিন্নভাষী পরিবেশ৷ এটা কিন্তু একটা শিশু শারীরিক ও মানসিক বিকাশে একটা বাধা৷ আদিবাসীদের মধ্যে যাঁরা একটু বেশি, তাঁদের দু'টি ভাষা জানলেই হয়৷ যেমন ধরেন, চাকমা৷ তাঁদের চাকমা আর বাংলা ভাষা জানলেই হয়৷ কিন্তু যাঁরা আরো ক্ষুদ্র, যেমন ম্রো, তাঁদের কিন্তু অনেকগুলো ভাষা জানতে হয়৷ যেমন, তাঁরা ঘর থেকে বের হলেই একজন চাকমার মুখোমুখি হন৷ ফলে তাঁদের চাকমা ভাষা জানতে হয়৷ এরপর বাংলা তো আছেই৷ আবার উচ্চ পর্যায়ে পড়াশোনা করতে গেলে ইংরেজি জানতে হয়৷ এ কারণে তাঁদের অনেকগুলো ভাষা জানতে হয়৷ তাঁদের ভাষার গুরুত্ব না থাকায় তাঁদের এক ধরনের ভাষার চাপে থাকতে হয়৷
আদিবাসীদের ভাষা সংরক্ষণ করতে সরকার কী ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে?
কোনো ভাষাই সংরক্ষণ করে টিকিয়ে রাখা যায় না৷ ভাষার ব্যবহারের জায়গা সম্প্রসারিত করতে হয়৷ আর্কাইভে ব্যাকরণ বা অভিধান রাখা যেতে পারে৷ তাতে ভাষা টিকবে না৷ প্রকৃতপক্ষে ভাষার ব্যবহার বাড়াতে হবে৷ এর মধ্যে একটি কাজ হলো, এসব ভাষার নতুন প্রজন্মকে তাঁর ভাষায় শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে৷ যাঁদের হরফ নেই, তাঁদের হরফের ব্যবস্থা করতে হবে৷ এই ভাষাকে ব্যবহারিক জীবনে প্রয়োগের সুযোগ দিতে হবে৷ এই ভাষা নিয়ে প্রচার মাধ্যমেও বিভিন্ন রকম অনুষ্ঠান হতে পারে৷ ভাষার মুল জিনিসটা হলো এর ব্যবহার মূল্য বাড়াতে হবে৷ আমরা যদি বাংলা ভাষার ব্যবহার-মূল্য বাড়াতে না পারি, তাহলে এক সময় এই ভাষাও দুর্বল হয়ে যাবে৷
ভিন্ন নৃ-গোষ্ঠীদের ভাষা টিকিয়ে রাখার উপায় কী? লিখুন মন্তব্যের ঘরে৷