‘সংলাপের ফল' আনতে হবে
১৬ আগস্ট ২০১৭দেড় বছর হাতে রেখেই বর্তমান নির্বাচন কমিশন সে লক্ষ্যে সংলাপও শুরু করেছে৷ এরই মধ্যে সুশীল সমাজ ও সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকের মধ্য দিয়ে সংলাপ কার্যক্রম শুরু হয়েছে৷ ঈদের আগে ও পরে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসার কথা রয়েছে৷
এর আগে গেল ১৬ জুলাই কমিশন রোডম্যাপ তুলে ধরে৷ সেই রোডম্যাপে একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে সাতটি প্রধান বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরা হয়৷ ১৫ পৃষ্ঠার এই রোডম্যাপে ঘোষিত সাতটি বিষয় হল:
১. আইনি কাঠামোগুলো পর্যালোচনা ও সংস্কার
২. নির্বাচন প্রক্রিয়া সহজীকরণ ও যুগোপযোগী করতে সংশ্লিষ্ট সবার পরামর্শ গ্রহণ
৩. সংসদীয় এলাকার নির্বাচনি সীমানা পুনর্নির্ধারণ
৪. নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও সরবরাহ
৫. বিধিবিধান অনুসরণপূর্বক ভোটকেন্দ্র স্থাপন
৬. নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন এবং নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের নিরীক্ষা
৭. সুষ্ঠু নির্বাচনে সংশ্লিষ্ট সবার সক্ষমতা বৃদ্ধির কার্যক্রম গ্রহণ
সেই সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নূরুল হুদা রোডম্যাপ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলসহ সব স্টেক হোল্ডারদের সহযোগিতা চান৷ তিনি বলেন, ‘‘বিদ্যমান আইনে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব৷ তবে সকলের সহযোগিতা ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়৷''
গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, প্রার্থীর যোগ্যতা প্রশ্নে নতুন ধারা সংযোজিত হতে পারে৷ রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনে নতুন শর্ত আরোপ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ব্যাপারে শর্ত শিথিলের বিষয় আলোচিত হচ্ছে৷
এ বছর অক্টোবরের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর নিবন্ধন শর্ত পালন সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করা হবে৷ আগামী ফেব্রুয়ারিতে নেয়া হবে নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের আবেদন৷ মার্চে প্রকাশ করা হবে তালিকা৷
তবে যে বিষয়গুলো সবচেয়ে বেশি আলোচিত তা হল, নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএমের ব্যবহার এবং অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মতো নির্বাচনকালীন নিরাপত্তা বিধানে ভোটের দিন সেনাবাহিনী মোতায়েন৷ এগুলো নিয়ে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভিন্নতা আছে৷
স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে নয়, অন্যান্য বাহিনীর মতো সরাসরি সেনাবাহিনীর মোতায়েন চায় বিএনপি৷ অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ, এর প্রয়োজন আছে বলে মনে করে না এবং ইভিএমে ভোট গ্রহণের বিষয়ে তাদের আগ্রহ আছে৷ সংলাপে এসব বিষয় উঠে আসবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে৷
নির্বাচন কমিশনের জন্য আরেকটি বড় কাজ হল, সীমানা পুনর্নির্ধারণ ও ভোটার তালিকা হালনাগাদ৷ তালিকা হালনাগাদের কাজ এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করে আগামী জানুয়ারিতে চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ করার কথা রয়েছে৷ গণমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী, কমিশন জনসংখ্যার ভিত্তিতে নয়, বরং ভোটারের ভিত্তিতে সীমানা নির্ধারণ করতে চায়৷
আলোচনায় আছে ‘না ভোটের পুন:প্রবর্তনের' বিষয়টিও৷ ভারতসহ অনেক দেশের মতোই বাংলাদেশেও ভোটারদের জন্য ‘উপরের কেউ নন' এমন অপশন রাখার বিষয়ে মত এসেছে৷
গেল ফেব্রুয়ারিতে দায়িত্ব নেবার পর কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বে বর্তমান কমিশনের বিপক্ষে এখন পর্যন্ত তেমন কোন অভিযোগ ওঠেনি৷ হুদা কমিশনের অধীনে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন ও কয়েকটি উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচন হয়েছে৷
পত্রপত্রিকায় প্রকাশ, বিএনপির হাইকমান্ড কমিশনের কার্যক্রম পর্যালোচনা করছে৷ সংলাপের সিদ্ধান্তকেও দেখছে ইতিবাচকভাবে৷ এছাড়াও সমাজের বিভিন্ন পর্যায় থেকেও কমিশনের এই উদ্যোগ সাধুবাদ পেয়েছে৷ কিন্তু প্রশ্ন হল, এই সংলাপ কতটা অর্থবহ হবে?
সুশীল সমাজের সঙ্গে সংলাপে কেউ কেউ আমন্ত্রণ পেয়েও অংশ নেননি৷ তাদের কেউ কেউ এ নিয়ে বক্তব্যও দিয়েছেন৷ কলামিস্ট আবুল মকসুদ লিখেছেন, অল্প সময়ে এত সংখ্যক ব্যক্তির মতামত দেয়া সম্ভব নয়৷ নিছক আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া আর কিছু হওয়া সম্ভব নয় বলে মত ছিল তার৷ তাই নিজের মন্তব্য লিখে পাঠিয়েছেন৷
তারপরও সংলাপ হয়েছে৷ সেখানে নানা মতামতও উঠে এসেছে৷ আরো সীমিত পরিসরে আবারো সুধীজনের সঙ্গে সংলাপ করা যেতে পারে বলে মত দিয়েছেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব.) সাখাওয়াৎ হোসেন৷
সাংবাদিক প্রতিনিধিদের সঙ্গেও এরই মধ্যে সংলাপ সম্পন্ন হয়েছে৷ অনেক রাজনৈতিক দল না চাইলেও অনেক সাংবাদিক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ‘না ভোটের' পুনঃপ্রনয়নের পক্ষে মত দিয়েছেন৷
এছাড়া নির্বাচন কমিশনের শক্তিবৃদ্ধির জন্য যাবতীয় উদ্যোগ নেবার পরামর্শ বরাবরের মতোই এসেছে এবং সামনেও আলোচিত হবে৷ কিন্তু যে বিষয়টির আরো আলোচনা দরকার তা হল, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন৷ সেটি করতে কমিশন কী উদ্যোগ নিচ্ছে, তা কমিশনকেই পরিষ্কার করতে হবে৷ একইসঙ্গে কমিশন এখন পর্যন্ত যে আস্থা নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছে তা চলমান রাখতে হবে৷
যেহেতু বিএনপির সহায়ক সরকারের প্রস্তাব কতটা ধোপে টিকবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই, সেক্ষেত্রে নির্বাচন সুষ্ঠু করা এবং সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার সব চেষ্টাই কমিশনকে করতে হবে৷
অনেক বিচ্ছিন্ন ঘটনাই একটি নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে৷ যেমন নির্বাচনের সময় প্রভাবশালীদের ছায়াতলে অনেক ভোটকেন্দ্র দখল, তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের ‘সিল মারার উৎসব' দেখা যায়৷ এসব থেকে বিরত রাখতে ইভিএম হোক আর সেনা মোতায়েন হোক কঠোর সিদ্ধান্তে যেতেই হবে কমিশনকে৷
২০১৪-র নির্বাচন যেহেতু প্রশ্নের অতীত নয়, এবং নিশ্চিতভাবেই বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে নির্বাচন হলে সরকারদলীয়রা বাড়তি সুবিধা পাবেন বলে অনেকেই মনে করছেন, সে জায়গায় সরকারকেও সব দলের অংশগ্রহণের স্বার্থে এবং লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির জন্য ‘ছাড়' দিতে হবে৷ আর বিএনপিকেও গত নির্বাচনে না অংশ নেয়ার মতো ‘রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত' থেকে সরে আসতে হবে৷
এর কারণ, ২০১৪-র নির্বাচনের আগে ও পরে দেশে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল তার পুনরাবৃত্তি কারো কাম্য নয়৷
এ নিয়ে আপনার কিছু বলার থাকলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷