কোষবিজ্ঞান
৯ অক্টোবর ২০১২সৃষ্টির আদিকাল থেকেই মানুষ সন্তানের বাবা-মা হতে চায়৷ শুধু মানুষ কেন, জগতের সব প্রাণীই চায়৷ প্রকৃতির নিয়ম বলুন, বংশ বিস্তারের অদম্য ইচ্ছার স্বাভাবিক প্রকাশ বলুন কিংবা মৃত্যুর পরও নিজের অস্তিত্ব আরো কিছুকাল সন্তানের মাধ্যমে রেখে যাওয়ার অভীপ্সা বলুন - কারণ যা-ই হোক, এই চাওয়া চিরকালীন৷ কিন্তু চাইলেও অনেকে সন্তানের মা-বাবা হতে পারেন না৷ কারো কারো জন্য এই ‘না পাওয়ার ব্যথা' অবর্ণনীয়৷ চিরহাহাকার হয়ে থাকে এই হতাশা৷ একদল কোষবিজ্ঞানীর উদ্ভাবন এই হতাশা থেকে মুক্তির উজ্জল সম্ভাবনা দেখাচ্ছে৷
যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞান বিষক জার্নাল ‘সায়েন্স'- এ প্রকাশিত হয়েছে একটি নিবন্ধ৷ ওই নিবন্ধের মাধ্যমেই জানা গেছে কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন বিজ্ঞানীর অভূতপূর্ব এক সাফল্যের খবর৷ জাপানের এই বিজ্ঞানীদের দাবি, তাঁরা সন্তান জন্ম দিতে অক্ষম যাঁরা, তাঁদের এই অক্ষমতা দূর করার সম্ভাবনা সৃষ্টির খুব কাছাকাছি পৌছে গেছেন৷ সাধারণ কোষ থেকে ডিম্বকোষ তৈরি করে দেখিয়েছেন তাঁরা, তাই এমন দাবি তো করতেই পারেন!
মানুষের বড় বড় আবিষ্কারের পেছনে গিনিপিগ, মশা, মাছি, গরু বা ভেড়ার মতো প্রাণীদের অনেক অবদান৷ হাসবেন না, খোঁজ নিয়ে দেখুন, জেনে যাবেন৷ এই সেদিনও তো ক্লোনিংয়ের সার্থক রূপায়ণ প্রমাণ করে দেখাতে জন্ম দেয়া হলো মেয়ে-ভেড়া ডলিকে৷ ভেড়া ডলির নাম তাই মানব ইতিহাসে অক্ষয়, অমর হয়ে থাকবে চিরকাল৷ কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা তাঁদের সাফল্য প্রমাণ করে দেখাতে বেছে নিয়েছিলেন একটি ইঁদুরকে৷ প্রাপ্ত বয়স্ক ইঁদুরটি সন্তানের জন্ম দিতে অক্ষম৷ সক্ষম করতে প্রথমে বিজ্ঞানীরা তার দেহ থেকে কোষ নিয়ে সেগুলোর কিছু জিন পাল্টে দিয়ে এমন করে ফেললেন যার ফলে কোষগুলো একেবারে পুরুষদের শুক্রাণু বা মেয়েদের ডিম্বাণু তৈরির সহায়ক আদি কোষের অনুরূপ হয়ে গেল৷ সেই কোষগুলো নিয়ে সাধারণ কোষের সঙ্গে মিলিয়ে তৈরি করা হলো ডিম্বকোষ৷ তারপর ডিম্বকোষ প্রোথিত হলো ইঁদুরের দেহে৷ তারপর সেই ইঁদুরের দেহে তৈরি হলো জননকোষ৷ প্রক্রিয়াটা খুব সহজ মনে হলেও আসলে কিন্তু মোটেই সহজ নয়৷ অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছে পুরো প্রক্রিয়াটায়৷ যা হোক, তারপর জননকোষগুলো নিয়ে রাখা হয় টেস্ট টিউবে আর সেখানেই অবশেষে তৈরি হয় নতুন ভ্রুণ৷ তারপর শেষ ধাপ৷ এ পর্যায়ে দরকার পড়ে ‘সারোগেট মাদার'এর৷ অন্য একটি মেয়ে ইঁদুর এনে তার সহায়তায় জন্ম দেয়া হয় সুস্থ, স্বাভাবিক এক ইঁদুর ছানা৷ ছানাটিকে দেখার পর বিজ্ঞানীরা আর্কিমিডিসের মতো ‘ইউরেকা', ‘ইউরেকা' বলে চিৎকার করে উঠেছিলেন কিনা কে জানে!
দীর্ঘদিনের গবেষণা শেষে প্রাপ্তিটা কিন্তু আনন্দে আত্মহারা হবার মতোই৷ নারী-পুরুষের সরাসরি মিলন ছাড়া, দেহের সাধারণ কোষ নিয়ে ধাপে ধাপে এগিয়ে এক পর্যায়ে সুস্থ শিশুর জন্ম দেয়া - এ যে কী অবিশ্বাস্য কাণ্ড তা কি ভেবে দেখেছেন! বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, এই প্রক্রিয়ায় যেসব নারী মা হতে ব্যাকুল, কিন্তু দেহে ডিম্বাণু তৈরি হয়না বলে পারছেন না, তাঁরাও মা হতে পারবেন৷ তাঁদের দেহ থেকেও কোষ নিয়ে একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করলেই সেটা সম্ভব বলে মনে করছেন অনেকে৷ কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মিচিনোরি সাইতো মনে করেন, তাঁদের এই সাফল্য ডিম্বাণু সৃষ্টির প্রক্রিয়া সম্পর্কে আরো স্বচ্ছ ধারণা দেবে এবং সন্তান জন্ম দেয়ায় অক্ষমতার কারণ শনাক্ত করতেও সাহায্য করবে৷ তবে তিনি বলেছেন, এখনো কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর সময় আসেনি, পথ এখনো অনেক বাকি৷ গবেষণার সাফল্য সম্পর্কে সংশয়মুক্ত হতে মানুষ আর বানরের দেহে একই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সন্তান জন্ম দেয়া যায় কিনা তা দেখার পরিকল্পনা আছে বলেও জানিয়েছেন তিনি৷
কিন্তু কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক কাতসুহিকো হায়াসি মনে করেন, মানুষের দেহে সরাসরি এ প্রক্রিয়া চালানোর কথা ভাবা এখনো সম্ভব নয়, কারণ, ইঁদুর নিয়ে কাজ করতে গিয়েই সম্প্রতি দেখা গেছে, আদি কোষ নিয়ে সেইগুলোকে আবার অন্য একটি জীবিত ভ্রুণের কোষের সঙ্গে নিষিক্ত করতে হয় এবং তা করতে গেলে ওই ভ্রুণটি মারা যায়৷ কথা হলো, এভাবে নতুন শিশুর জন্ম দিতে গিয়ে অন্য একটি ভ্রুণ হত্যা কি সবাই মেনে নেবেন? অনেক ধর্মপ্রাণ মানুষেরই কিন্তু এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হওয়ার কথা৷ সেকারণেই মানুষের দেহে এই প্রক্রিয়া যাচাই করে দেখার আগে গবেষণা করে বিকল্প উপায় বের করার পক্ষে কাসুহিকো হায়াসি৷
এসিবি/জেডএইচ (এএফপি)