1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
স্বাস্থ্যভারত

সন্দেহ-মৃত্যু হলে ডাক্তাররা মার খান, মার খেলে ধর্মঘট

ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি গৌতম হোড়৷
গৌতম হোড়
২১ জুলাই ২০২৩

জোর যার, মুলুক তার৷ পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্যখাতে এটাই চেহারা৷ আর পুলিশ? তারা তখনই সক্রিয়, যখন আদেশ আসে৷

https://p.dw.com/p/4UDHB
Indien | Der Server von Indiens renommiertestem Regierungskrankenhaus wurde gehackt
ভারতের রাজধানী দিল্লির একটি হাসপাতালের সামনে লম্বা লাইন৷ ফাইল ফটো৷ ছবি: Ab Rauoof Ganie/DW

সত্যি কথা বলতে কী, ভারতে কোনো ঘটনা বা দুর্ঘটনা ঘটলে তার দায় কারো নয়৷ খবরের কাগজ খুললে হামেশাই দেখতে পাবেন, ডাক্তারের ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু হয়েছে, কখনো অবহেলায় হয়েছে৷ ফলে রোগীর আত্মীয়রা হাসপাতাল বা নার্সিং হোম ভাঙচুর করেছে৷ মাস কয়েক আগে গাইঘাটার ঘটনাই দেখুন৷ পায়ে ব্যথা ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে একজন রোগীকে বেসরকারি নার্সিং হোমে ভর্তি করা হয়েছিল৷ তাকে পাঁচ দিনের প্যাকেজ দেয়া হয়৷ তারমধ্যে কলকাতা থেকে ডাক্তার দেখবেন এমন কথাও থাকে৷ পরে সেই রোগীকে দামী ইঞ্জেকশন দেয়ার জন্য টাকা চাওয়া হয়৷ বারবার চাওয়ায় রোগীর পরিবারের সন্দেহ হয়৷

তারা নার্সিং হোমে যান৷ তাদের প্রথমে ঢুকতে বাধা দেয়া হয়৷ পরে তারা জোর করে ঢুকে দেখেন রোগী মারা গেছেন৷ যে ডাক্তারের চিকিৎসা করার কথা ছিল তিনি একবারের জন্যও আসেননি বলে অভিযোগ৷ কী বলবেন এই ঘটনাকে? এরপরও রোগীর আত্মীয়রা উত্তেজিত হবেন না? এরপর পুলিশে অভিযোগ করা হয়৷ পুলিশ তদন্ত করে৷ তারপরের ঘটনা জানা নেই৷ সবই তো ধামাচাপা পড়ে যায়৷ আমাদের এই উপমহাদেশে তো সব জিনিসের জন্য আলাদা ওষুধ আছে৷ ব্যবস্থা আছে৷ দাম আছে৷ উত্তর ভারতে একটা বিখ্যাত কথা আছে, বাংলায় তাকে বলে 'জোগাড়'৷ সবকিছুরই তো জোগাড় হয়ে যায়৷ কখনো পকেটে বেশি টান পড়ে কখনো কম৷ ফলে চিন্তা কীসের!

তা জোগাড়ের দেশে সবই চলে৷ ভুল চিকিৎসায় মানুষ মারা যান (পরিসংখ্যান বলছে,বিশ্বে বছরে ২৬ লাখ মানুষ এভাবেই মারা যান)৷ ভুল হতেই পারে৷ চিকিৎসকরা মানুষ৷ তাদের রোগলক্ষণ বুঝতে ভুল হতে পারে৷ ওষুধ দিতে ভুল হতে পারে৷ সেই ভুল ইচ্ছাকৃত নয়৷ আবার চিকিৎসা না করে ফেলে রাখা, টাকা নেয়ার জন্য সমানে নানা ধরনের ডাক্তারি পরীক্ষা করিয়ে যাওয়া, তারপর অবহেলা, এ সব তো ইচ্ছাকৃত ভুল৷ তারও তো দায় কেউ নেয় না৷

আর শাস্তি দিলেও তা কি গুরুতর হয়? গত মার্চে অবহেলায় রোগীর মৃত্যুর পর মেডিকেল কাউন্সিল ছয় মাসের জন্য ডাক্তারের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করেছিল৷

অন্যদিকে রোগীর আত্মীয়দের ব্যবহারও তেমনই৷ পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বড় চিকিৎসক ধর্মঘট হয়েছিল ২০১৯ সালে৷ কলকাতার সরকারি হাসপাতাল এনআরএসে৷ ট্যাংরা অঞ্চলের একজন রোগীর মৃত্যুর পর তার আত্মীয় ও পাড়ার লোক এসে দুইজন জুনিয়র ডাক্তারকে বেধড়ক মারে৷ ব্যাপক ভাঙচুর করে৷  তারপর জুনিয়র ডাক্তাররা ধর্মঘট শুরু করে দেন৷ এনআরএসের পাশাপাশি এই আন্দোলন অন্য হাসপাতালে ছড়িয়ে পড়ে৷ শুরু হয় কর্মবিরতি৷ অনেক রোগীকে ছেড়ে দেয়া হয়৷

Goutam Hore
গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলেছবি: privat

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কড়াভাবে মোকাবিলা করতে চান৷ চরমসীমা দেন৷ কিন্তু শেষপর্যন্ত তিনি ঘোষণা করেন, প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে একজন অ্য়াসিসটেন্ট কমিশনারের নেতৃত্বে পুলিশ দল থাকবে৷ কোনো অসুবিধা হলে তারা হস্তক্ষেপ করবে৷ তারপর ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ চিকিৎসকদের পূর্ণ নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতির পর ধর্মঘট ওঠে৷

রোগীর আত্মীয় ও বন্ধু-প্রতিবেশীরা ট্রাক ভর্তি করে এনআরএসে এসে জুনিয়ার ডাক্তারদের মেরেছিল৷ ভাঙচুর করেছিল৷ কোনো সন্দেহ নেই, প্রিয় মানুষের মৃত্যু খুবই শোকাবহ এবং ধাক্কা লাগার মতো ঘটনা৷ কিন্তু তার জেরে সন্দেহের বশে দলবল নিয়ে এসে ডুনিয়র ডাক্তারদের মারা হবে, এটাই বা কোন দেশি নিয়ম? আর সেই মারে দুইজন জুনিয়র ডাক্তার গুরুতর আহত হওয়ার পর কলকাতার সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা পরিষেবা থামিয়ে দেওয়াটাই বা কীরকম আন্দোলন?

জুনিয়র ডাক্তারদের দাবি, তারা এই আন্দোলনে না গেলে, তাদের শুধু মারই খেতে হত৷ যেহেতু তারা হাসপাতালে সকলের নাগালের মধ্যে থাকেন, তাই যাবতীয় ঝড়ঝাপটা তাদের সামলাতে হয়৷ কিছু হলেই রোগীর আত্মীয়রা তাদের মারধর করে৷ এরপর এককাট্টা হয়ে প্রতিবাদ না করলে তাদের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ হবে৷ কারণ, এই সব ঝামেলা হলেই তার সঙ্গে রাজনীতি ঢুকে পড়ে, তার সঙ্গে জড়িয়ে যায় স্থানীয় স্বার্থ৷ তাই তারা চরম অবস্থান নিতে বাধ্য হয়৷ জুনিয়র ডাক্তারদের মধ্যে রাজনৈতিক মতভেদ থাকতে পারে, কিন্তু আন্দোলনের ক্ষেত্রে তারা এককাট্টা৷

আবার সরকারি হাসপাতাল মানে তো দালালচক্র৷ সরকারি হাসপাতাল মানে তো সাধারণত ক্ষমতাশীল দলের শক্ত জমি৷ সরকারি হাসপাতাল মানে একগুচ্ছ বেনিয়মের অভিযোগ৷ আর বেসরকারি হাসপাতালের অধিকাংশই রোগী ও তাদের আত্মীয়দের শোষণ করার যন্ত্র৷ ফলে সাধারণ মানুষের রাগ হওয়াটাও তো অস্বাভাবিক নয়৷ আর এখন কোথাও কিছু হলে তো আগে হাত চলে, ছুরি চলে, বোমা চলে, গুলি চলে, মারধর তো খুব সাধারণ ঘটনা৷ একটা বারুদের স্তূপের উপর বসে থাকা সমাজ ও তার অধিবাসীরা৷ সামান্য সংঘাতেই ফুলকি বের হয়৷

ফলে হাসপাতালে, ডাক্তারদের মারধর যেমন আছে, তেমনই দুর্নীতি, বেনিয়ম, রোগীদের অর্থ নেয়ার নানান ফিকির, দালালচক্র সবই আছে৷ ফলে কোন অন্য়ায় থেকে যে কোন অন্য়ায়ের জন্ম হয় তা বলা মুশকিল৷  ২০২২-এর শেষদিকের ঘটনা৷ মেডিক্যাল কলেজে পড়ুয়ারা আমরণ অনশন শুরু করলেন৷ দাবি, তাদের ছাত্র সংগঠনের নির্বাচন যথাসময়ে করতে হবে৷ ১২দিন ধরে অনশন চললো৷ এর ফলে চিকিৎসায় ব্যাঘাত ঘটলো৷ সেখানে তিন পক্ষ ছিল৷ পড়ুয়া, রাজ্য সরকার এবং কলেজ কর্তৃপক্ষ৷ তালি বাজতে গেলে অন্তত দুইটি হাত তো দরকার৷

তাই বলে কি এখানে চিকিৎসকদের গ্রেপ্তার করা হয় না? হয়৷ ২০১১ সালে আমরি হাসপাতালে ভয়াবহ আগুন লেগেছিল৷ তাতে পুড়ে মারা গিয়েছিলেন ৮৯ জন৷ তারপর মালিল ও ম্যানেজারদের গ্রেপ্তার করা হয়৷ ২০১২তে তারা অবশ্য জামিন পেয়ে যান৷ এক দশক ধরে আইনি লড়াই করে মৃতদের আত্মীয়রা ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন৷

আমরির ঘটনা তো ভয়ংকর৷ তাছাড়া খুঁজলে এক-দুজনকে ধরা হয়েছে, এমন নিদর্শন পাওয়া যাবে, কিন্তু তার সংখ্যা খুব বেশি নয়৷ প্রথমত, ডাক্তারদের গ্রেপ্তার করাই বা হবে কেন? তার জন্য অভিযোগ চাই, প্রমাণ চাই৷ তাছাড়া ডাক্তারদের সংগঠনও খুব প্রভাবশালী৷ আর ডাক্তারদের কেই বা চটাতে চায়৷ পুলিশ থেকে মন্ত্রী সকলেরই তো তাদের দরকার হয়৷

তাহলে সবমিলিয়ে ঘটনাা কী দাঁড়ালো? এককথায়, যাদের যা ইচ্ছে, তারা তা করছে৷ যাদের যেখানে শক্তি, তারা সেখানে রাজা৷ বেসরকারি হাসপাতালগুলি রোগীদের কাছ থেকে কতটা টাকা নেয়া যায়, সেই ধান্ধায় থাকে৷ সেখানকার চিকিৎসকরাও তাদের সাহায্য করেন বলে হামেশা অভিযোগ ওঠে৷ রোগীর আত্মীয়রা কিছু হলেই আইন নিজের হাতে তুলে নেন৷ সরকারি হাসপাতালে হয় দাদাকে ধরতে হয় অথবা রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক মহলে উঁচু পদে পরিচিত কেউ থাকা চাই৷ তারা বললে, ভর্তি থেকে শুরু করে চিকিৎসা সবই হবে৷ না হলে..থাক সে কথা৷ কিছুদিন আগেই সরকারি হাসপাতালে দালালচক্র নিয়ে তৃণমূলের সাবেক মন্ত্রী মদন মিত্র পর্যন্ত সোচ্চার হয়েছিলেন৷ একসময় অবশ্য অভিযোগের আঙুল তার দিকে ছিল৷ ফলে পশ্চিমবঙ্গের চিকিৎসাক্ষেত্রের কথাও মহাভারত-সমান৷ তাতে সাসপেন্স আছে, দুর্নীতি আছে, মারামারি আছে, ট্রাজেডি আছে, আন্দোলন আছে, সিস্টেম ভাঙার ডাক আছে, আবার সবই সেই সিস্টেমে চলে যাওয়ার কাহিনি আছে৷

তা এর মধ্যে জুনিয়র ডাক্তাররা মার খাবেন, সব বন্ধ করে দেবেন, রোগীর আত্মীয়রা তাদের দাদাগিরি দেখাবেন এ আর বেশি কথা কী? এ সব তো প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে৷ যা দেখা যাচ্ছে না, সেটা হলো, প্রদীপের তলায় বড়ই অন্ধকার৷

ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি গৌতম হোড়৷
গৌতম হোড় ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি৷
স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য