সব স্কুলে ‘স্যানিটারি প্যাড সার্ভিস’ চালুর স্বপ্ন প্রভার
৩ জানুয়ারি ২০১৭উদ্যোগটির নাম ‘ডোনেট এ প্যাড ফর হাইজিন বাংলাদেশ’৷ প্রভা তার প্রধান সমন্বয়কারী৷ ডয়চে ভেলের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি তাঁর স্বপ্নের কথা জানান৷
ডয়চে ভেলে: মেয়েদের ঋতুস্রাব নিয়ে আপনারা একটা সচেতনতার কাজ শুরু করেছেন৷ কীভাবে এটা শুরু করেছিলেন?
মার্জিয়া প্রভা: ২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে ভারতে ‘হ্যাপি টু ব্লিড’ নামে একটা আন্দোলন শুরু হয়৷ ওদের মূল ক্যাম্পেইনটা ছিল মন্দিরে ঋতুমতী মহিলাদের ঢোকা নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে৷ ঐ মন্দিরের পুরোহিত বলেছিলেন, একজন মেয়ে যে ঋতুমতী নন এবং তিনি যে মিথ্যে বলে মন্দিরে ঢুকে দেবতা ও মন্দিরকে অপবিত্র করছেন না, তার নিশ্চয়তা কী? তাই এই নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি৷ তার মানে হল মেয়েরা ঋতুমতী হলে অচ্ছুত হয়ে যায়৷ এটার প্রতিবাদে সারা ভারতে মেয়েরা ঐ আন্দোলন শুরু করে৷ সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে নিজেদের প্রথম মাসিকের বর্ণনা দেওয়া শুরু করে মেয়েরা৷ প্রোফাইল ছবি বদল করে নিজেদেরকে আন্দোলনের সাথে সংযুক্ত করেন অনেক মেয়ে৷ বাংলাদেশে আমিও এটা নিয়ে লেখালেখি করি৷ এর ফলে প্রচণ্ড গালিগালাজের সম্মুখীন হই৷
এই পরিস্থিতির মধ্যে গত বছর বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে হুট করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়াতে একটা ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্পেইনে উপস্থিত থাকার নিমন্ত্রণ পাই৷ আমাকে এমনি বেড়াতে যাওয়ার জন্য ডাকা হয়েছিল৷ আমার দুই বন্ধু মাটি ভাই ও তারেক ভাই আমাকে ওখানে নিয়ে যায়৷ তখন আমি কিছু প্যাড সেখানে নিয়ে যাই৷ বিভিন্নজন আমাকে প্যাড ডোনেট করে৷ প্রায় ৬/৭শ’ প্যাড সেখানে নিয়ে যাই৷ কিন্তু ওখানে গিয়ে মাথায় হাত৷ এরা নোংরা কাপড়, পাতা, কাপড়ের মধ্যে বালি ভরে ব্যবহার করে৷ অনেকে কিছুই ব্যবহার করে না৷ রক্ত পেটিকোটে পড়লে নদীতে গিয়ে অনেকক্ষণ ডুব দিয়ে আসে৷ এভাবেই মাসিকের তিন দিন যায় তাদের৷ আমি শুনছিলাম আর হতভম্ব হচ্ছিলাম৷ কাপড় ব্যবহার করে কড়া রোদে শুকালেও কথা ছিল! লজ্জায় তারা বাইরেও নেড়ে দেয় না৷ নোংরা ভেজা সেই কাপড় পরেই কাজ করে৷ আর তাতেই শরীরে ইনফেকশন বাসা বাঁধে৷
এই কাজ করতে গিয়ে আপনি কী ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েছেন?
শুরু থেকেই প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয়েছিল৷ লেখালেখি যখন করতাম তখন তো অনেকেই গালিগালাজ করেছে৷ শুধু এই কারণে বড় দু'টি গ্রুপ থেকে আমাকে ‘ব্যান’ করে দেয়৷ আমি কেন এটা করি সেটা নিয়ে তারা অনেক কথা বলেছে৷ অনেকে তখন বলেছে, আপনি কনডমও বিতরণ শুরু করেন৷ আমি তখন বলেছি, হ্যাঁ প্রয়োজনে কনডমও বিতরণ করব৷ অনেকে তখন আমাকে নষ্টা বলেও গালি দিয়েছে৷ ব, খ, ম, চ এই চার বর্ণ দিয়ে শুরু গালি আমাকে শুনতে হয়েছে৷ সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, মেয়েরাও আমাকে গালিগালাজ করেছে৷ এখন অনেকটাই গালিগালাজ কমে গেছে৷ তবে রুট লেভেলে কাজ করতে গিয়ে আমি কোনো বাধার মুখে পড়িনি৷ কেন হয়নি আমি জানি না৷ মানুষগুলো অসচেতন হোক, খুবই ধর্মান্ধ হোক, কেন যেন তারা আমাকে বাধা দেয়নি৷
আপনি পাইলট প্রজেক্ট শুরু করেছিলেন নোয়াখালীর একটি গ্রামে৷ সেই প্রজেক্টের অবস্থা কী?
সেই প্রজেক্টটা চলছে৷ আমাদের অনেকগুলো ডোনার আছে, ফ্যাশন হাউজ আছে৷ তারা আমাদের টাকা দেয়, প্যাড দেয়৷ প্যাড তো আছেই, আর টাকা দিয়ে প্যাড কিনে সেগুলো আমরা তাদের কাছে পৌঁছে দেই৷ আরেকটি ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি আছে যারা প্যাড বানায়৷ তারা আমাদের খুবই অল্প দামে সেগুলো দেয়৷ এরপর আমরা ওগুলো গরিব মেয়েদের ফ্রি দেই৷ যারা স্বচ্ছল তাদের কাছে আমরা তিন টাকা দরে বিক্রি করি৷ যেটা বাজারের দামের চেয়ে খুবই কম৷ নোয়াখালীর গ্রাম তো, সেখানে আসলে সবাই অসচ্ছল৷ ফলে সবাইকে আমাদের এটা ফ্রি দিতে হয়৷ প্রথম তিন মাস আমরা সবাইকে ফ্রি দিয়েছি৷ এখন ব্যবহার করতে করতে অনেকে ইউজড টু হয়ে গেছে৷ তারা এখন পরিবারের সাপোর্ট পাচ্ছে৷ অনেকেই আমাদের বলে তারা এখন কিনে নেবে৷
আপনারা যাদের কাছে পৌঁছেছেন তারা তো সারাদেশের নারীদের সামান্য একটা অংশ৷ যাদের প্যাড কেনার সামর্থ্য নেই তারা কী করবে?
বাজারে যে প্যাডগুলো পাওয়া যায় তার দাম তো অন্তত একশ টাকা৷ কিন্তু আমরা যেটা দিচ্ছি সেটার ১০ পিসের দাম ৩০ টাকা৷ এবার সামর্থ্যের কথা বলি৷ নোয়াখালীর গ্রামে খুবই গরিব একজন মহিলা আমাকে বলল, আপা এটা কেনার সামর্থ্য তো আমাদের নেই৷ আমরা কী করব? তখন আমি তাকে বললাম আপনার স্বামী চা-সিগারেট খায়? সে বলল খায়৷ কোন ব্র্যান্ডের সিগারেট খায়৷ সে বলল গোল্ডলিফ খায়৷ তাহলে তো তার প্রতিদিন ৫০-৬০ টাকা সিগারেটের পেছনেই চলে যায়৷ তাহলে মাসে সে কেন আপনাকে ৫০ টাকা দিতে পারবে না? তখন সে বলল, দেয় না তো৷ না দিলে আমি কী করব? তখন আমি বুঝলাম রুট লেভেলে টাকা একটা সমস্যা কিন্তু আসলে ইচ্ছে করলে এটা দিতে পারে৷ সস্তায় দিলেও অনেকে কিনবে না৷ কারণ তাদের আসলে ইচ্ছেটাই নেই৷
আপনি বলছিলেন, গ্রামের অধিকাংশ মানুষকে আপনি পুরনো কাপড় ব্যবহার করতে দেখেছেন? এই পুরনো কাপড় ব্যবহারের ক্ষতিকর দিকটা কি?
পুরনো কাপড় কিন্তু ক্ষতিকর না৷ কিন্তু সেটা হাইজেনিক করে নিতে হবে৷ আমি আমার মায়ের কাছে শুনেছি, তারা যখন পুরনো কাপড় ব্যবহার করত, তখন ঐ কাপড়টা ঘরের সবচেয়ে কোনার মধ্যে রেখে দিত৷ তাদের মধ্যে কুসংস্কার ছিল- রক্তমাখা কাপড় দেখলে নাকি পুরুষ লোক অন্ধ হয়ে যায়৷ কোথা থেকে এটা এসেছে আমি জানি না৷ কিন্তু এই কুসংস্কারটা এখনো আছে৷ পুরনো কাপড়টা যে সে ব্যবহার করছে সে তো ওটা পুরোপুরি ধুয়ে রক্ত পরিষ্কার করে নিতে পারছে না৷ আবার শুকাতে দিচ্ছে ঘরের কোনে৷ ফলে ওটাতে তো জীবাণু জমে যাচ্ছে৷ এরপর সে আবার সেটা ব্যবহার করছে৷ এর ফলে তার ইনফেকশন হচ্ছে৷ এতে তার জরায়ুর মুখে ক্যানসার হতে পারে, যেটা নোংরা কাপড় থেকে হয়৷ আমি এ পর্যন্ত কারো কাছেই শুনিনি সে পুরনো কাপড়টা ৯০ ভাগও জীবাণুমুক্ত করতে পেরেছে৷
প্যাড ব্যবহারের কোনো ক্ষতিকর দিক আছে কিনা?
জেল প্যাড ব্যবহারে ক্ষতি আছে৷ সারা বিশ্বেই কটন প্যাড ব্যবহারের বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে৷ এটা নিয়ে এক ধরনের আন্দোলনও হচ্ছে৷ এই প্যাডটা সবচেয়ে আরামদায়ক, সবচেয়ে ভালো৷ জেল প্যাড ব্যবহার করা ক্ষতিকর৷ ওখানে কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়৷
প্যাড ব্যবহারে কি ধর্মীয় কোনো বিধিনিষেধ আছে?
এই ধরনের কোনো কথা আমি কখনও শুনিনি৷
বাংলাদেশে কত শতাংশ নারী প্যাড ব্যবহার করে?
আমি যে স্কুলে সার্ভে করেছিলাম তাতে দেখেছিলাম ৬৮ ভাগ নারী প্যাড ব্যবহার করত না৷ সেনোরার একটা সমীক্ষায় আমি পেয়েছি, ৮৭ ভাগ নারীই প্যাড ব্যবহার করে না৷ আমার গবেষণায় আমি দেখেছি ৪০ ভাগ নারী প্যাড ব্যবহার সম্পর্কে জানেই না৷ আর সেনোরা বলছে, এই সংখ্যা ৭১ ভাগ৷
গ্রামের স্কুলের কিশোরীদের যে লজ্জাবোধ, এটা থেকে বের হওয়ার পথ কী?
আমরা তো প্রথমে সেমিনার করি৷ তারপর প্যাড পাঠানো শুরু করি৷ প্রথম দিন হয়কি কেউ কোনো কথা বলতে চায় না৷ পরে ছেলেদের রুম থেকে বের করে দিয়ে তাদের সঙ্গে আস্তে আস্তে কথা বলি৷ এরপর তারা মুখ খুলতে শুরু করে৷ আমাদের সঙ্গে ডাক্তার ছিল৷ বারবার বলার পর তারা স্বাভাবিক হতে শুরু করে৷ প্রথম সেশনে তো সবাই হাসাহাসি করে৷ শেষে গিয়ে তারা প্যাড উঁচু করে বলে আপা আমরা প্যাড ব্যবহার করি৷
আপনি যে সচেতনতার কাজ শুরু করেছেন, এটা নিয়ে আপনি কতদূর যেতে চান?
আমার মূল কাজ হচ্ছে প্যাডের দাম কমানো৷ এটা নিয়ে আমি কাজ করে যাচ্ছি৷ আমি যাদের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছি তারা আমাদের কম দামে দিচ্ছে, কিন্তু এভাবে তো এগুবে না৷ আমি চাই প্রতিটি স্কুলে প্যাড সার্ভিস থাকবে৷ আমি ঢাকার একটি স্কুলে পড়েছি৷ সেখানেও আমাদের প্যাড সার্ভিস ছিল না৷ আমি চাই, কোনো মেয়েকে দোকানে যেতে হবে না, সে স্কুল থেকেই এটা নিতে পারবে৷ এই সার্ভিস আমি সব স্কুলেই করতে চাচ্ছি৷ আমার স্বপ্ন এটা সারাদেশে এটা ছড়িয়ে দেয়া৷ জানি না কীভাবে হবে, তবে এটা আমার স্বপ্ন৷