সবার জন্য সুপেয় পানি কতদূর?
১৩ মে ২০১৯বিশ্বব্যাংক, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইউনিসেফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৯৮ ভাগ মানুষের আওতার মধ্যে পানির কোনো-না-কোনো উৎস রয়েছে৷ কিন্তু এর সবটাই পানযোগ্য নয়৷ নিরাপদ বা সুপেয় পানি পাচ্ছে শতকরা ৫৬ ভাগ মানুষ৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ এবং বাংলাদেশ সরকারের জয়েন্ট মনিটরিং প্রোগামের সর্বশেষ হিসেবে তা শতকরা ৮৭ ভাগ বলা হচ্ছে বলে ডয়চে ভেলেকে জানান ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন ফর রুর্যাল পুওর (ডরপ)-এর রিসার্চ, প্ল্যানিং অ্যান্ড মনিটরিং পরিচালক মোহাম্মদ যোবায়ের হাসান৷ তিনি স্যানিটেশন অ্যান্ড ওয়াটার ফর অল-এর দক্ষিণ এশিয়ার স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য৷ এই হিসাব আমলে নিলেও এখনবো ১৩ ভাগ মানুষ সুপেয় পানি পাচ্ছে না৷ তবে পানির দূষন হিসেব করলে ৪৪ ভাগ মানুষ নিরাপদ ও সুপেয় পানির আওতার বাইরে আছেন৷
কেন পানির উৎসগুলো নিরাপদ নয়
প্রতিবেদনগুলোতে সুপেয় পানির হিসাব করা হয়েছে উৎস বিবেচনা করে৷ কিন্তু সেগুলোও এখন দূষিত হয়ে পড়ছে৷ দেশের ১৩ ভাগ পানিতে গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি আর্সেনিক রয়েছে৷ কারও কারও হিসাবে তা আবার ২৬ ভাগের মতো৷
গত বছরের অক্টোবরে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণা বলছে, পাইপলাইনের পানির ৮০ ভাগেই ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়া রয়েছে৷ পুকুরের পানিতেও একই মাত্রায় এই ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পাওয়া গেছে৷ ৩৮ শতাংশ টিউবওয়লের পানিতেও এই ক্ষতকির অনুজীবের অস্তিত্ব মিলেছে৷ পাকস্থলী ও অন্ত্রের প্রদাহের জন্য ই-কোলাই ব্যাকটরিয়াকে দায়ী করা হয়৷
এজন্য যথাযথ স্যানিটেশন সুবিধা না থাকাও একটি বড় কারণ৷ ঢাকায় মাত্র ২০ ভাগ স্যুয়েরেজ পাইপ লাইন রয়েছে, বাকিটা খোলা৷ আবার সারাদেশে পয়ঃবর্জ্যের মাত্র ২ ভাগ ট্রিটমেন্ট করা হয়৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে বাকি বর্জ্য মূলত পানিতেই মিশে যাচ্ছে৷ ওয়াটার এইড বাংলাদেশের প্রোগ্রামস অ্যান্ড পলিসি অ্যাডভোকেসি ডিরেক্টর মো. লিয়াকত আলী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ ঢাকার পাগলায় একটি মাত্র পয়:বর্জ্য ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট আছে৷ সেটাও কাজ করেনা৷ তাহলে এই বর্জ্য কোথায় যায় ? বুড়িগঙ্গায় গিয়ে পানিতে মেশে৷''
এছাড়া দেশের উপকুলীয় অঞ্চলে লবনাক্ততার কারণেও পানি পানের অযোগ্য হচ্ছে৷ প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় এসব এলাকার এক তৃতীয়াংশ গৃহস্থালি পানি দূষিত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে৷ মো. লিয়াকত আলী বলেন,‘‘যেভাবেই হিসাব করা হোক না কেন এখন বাংলাদেশের ৫৬ ভগের বেশি মানুষ সুপেয় বা নিরপদ পানি পচ্ছেন না৷ কারন আর্সেনিক এবং অন্যান্য বায়োলজিক্যাল কন্টেমিনেশন, প্রাপ্য পানি থেকে বাদ দিয়ে নিরাপদ পানির হিসাব করতে হয়৷ জয়েন্ট মনিটরিং প্রোগামের ২০১৮ সালের রিপোর্টও তাই বলছে৷''
ঢাকায় সুপেয় পানি
ঢাকাবাসীর জন্য পাইপ লাইনে ওয়াসা যে পানি সরবরাহ করে তারমধ্যে ৭৫ শতাংশ ভূগর্ভস্থ, বাকি পানি আসে ভূ-উপরিস্থ উৎস থেকে৷ ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নীচে নেমে যাচ্ছে৷ যা অদূর ভবিষ্যতে ঢাকায় পানির বড় সংকট তৈরি করবে বলে আশংকা বিশেষজ্ঞদের৷ যদিও ২০২১ সালের মধ্যে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার ২৫ ভাগের নামিয়ে আনার পরিকল্পনা রয়েছে ওয়াসার৷
রাজধানীতে এখন ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষের বসবাস৷ এরমধ্যে ২০ ভাগ মানুষ বস্তিতে থাকেন৷ তাদের ৭০ ভাগের পানির কোনো বৈধ উৎস নাই৷ ঢাকায় গড়ে মানুষের প্রতিদিন পানির চাহিদা ১৪০ লিটার হলেও বস্তিবাসীরা পান মাত্র ২০ লিটার৷
গত ১৭ এপ্রিল ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) পক্ষ থেকে ‘ঢাকা ওয়াসা: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়' শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয় ঢাকায় ৯৩ শতাংশ গ্রাহক বিভিন্ন পদ্ধতিতে সংস্থাটির পানি পানের উপযোগী করে৷ এর মধ্যে ৯১ শতাংশ গ্রাহকই পানি ফুটিয়ে বা সিদ্ধ করে পান করেন৷ পানি পানের উপযোগী করতে প্রতিবছর আনুমানিক ৩৩২ কোটি টাকার গ্যাসের অপচয় হয়৷ প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ৫১ শতাংশ গ্রাহক সরবরাহকৃত পানিকে অপরিস্কার এবং ৪১ শতাংশ গ্রাহক দুর্গন্ধযুক্ত বলে অভিযোগ করেছেন৷
নগরবাসীর সঙ্গে কথা বলেও এর সত্যতা পাওয়া যায়৷ ধানমন্ডিসহ কয়েকটি এলাকার বাসিন্দারা বলেন,‘‘ওয়াসার পানি ফুটিয়ে ছাড়া পান করা অসম্ভব৷ কখনো কখনো তা পানের পুরোপুরি অযোগ্য থাকে৷ পানিতে দুর্গন্ধ থাকে৷ মুখে দেয়া যায়না৷ কেরোসিন তেলের মত রঙ হয়৷ আবার এই পানি ব্যবহার করলে শরীর চুলকায়৷''
তারা আরো অভিযোগ করেন, ‘‘এই পানির কারণেই নানা ধরণের পেটের পীড়া হয়৷ পানি খেলে বমি বমি ভাব হয়৷ বাচ্চারা খেতেই পারেনা৷''
টিআইবি'র প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়ায় ২০ এপ্রিল এক সংবাদ সম্মেলন করে ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান বলেন, ‘‘ওয়াসার পানি শতভাগ সুপেয়, বিশুদ্ধ৷ একে ফুটিয়ে খাওয়ার প্রয়োজন হয় না৷'' এমডির এই কথার জবাব দিতে তাঁকে ওয়াসার পানি দিয়ে শরবত খাওয়াতে গিয়ে আলোচনায় আসেন জুরাইনের বাসিন্দা মিজানুর রহমান৷ ২৩ এপ্রিল তিনি ওয়াসা ভবনে গিয়ে শরবত খাওয়ানোর চেষ্টা করলেও তিনি অফিসে না থাকায় সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়৷ যারা ছিলেন তারাও খাননি৷
ওয়াসার পরিচালক (কারিগরি) এ কে এম সহিদ উদ্দিন ডয়চে ভেলের কাছে দাবী করেন, ‘‘উৎসে ওয়াসার পানি শতভাগ বিশুদ্ধ৷ আমরা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মান অনুযায়ী পানি বিশুদ্ধ করি৷ এখন কেউ যদি চোরাই লাইন নেন৷ কারুর পানি রিজার্ভারে যদি সমস্যা থাকে, দূষিত পদার্থ থাকে, যদি নিয়মিত পরিস্কার না করে সে দায়িত্ব কে নেবে?''
পানি বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ম. ইমামুল হক বলেন,‘‘পরিশোধন পর্যায়ে পানি ঠিকই থাকে৷ উৎসে পানির মান বজায় থাকে৷ কিন্তু সমস্যা হয় সরবরাহ লাইনে৷ এই লাইনগুলো খুবই খারাপ৷ ঢাকা শহরে যত ময়লা আবর্জনা ও দূষিত পদার্থ আছে তা সব এই পাইপ লাইনে ঢোকে৷ কিন্তু ওয়াসার দায়িত্ব হলো গ্রাহক পর্যায় পর্যন্ত বিশুদ্ধ পানি পৌছে দেয়া সেটা তারা করে না৷ তাই পানিতে শুধু ই-কোলাই কেন আরো অনেক জীবানু এবং দূষিত পদার্থ থাকে যা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর৷''
ঢাকার ৩৫০ বর্গ কিলোমিটার এলাকার মানুষের জন্য প্রতিদিন ওয়াসা ২৩৯ কোটি লিটারের বেশি পানি সরবরাহ করে৷ তাদের প্রায় ৬০ হাজার কিলোমিটার পাইপ লাইনের মধ্যে ৩৬ হাজার কিলোমিটারই পুরনো এবং নিম্নমানের৷ ৮শ'রও বেশি গভীর নলকূপের মাধ্যমে ওয়াসা ভূগর্ভস্থ পানি তোলে সেই সঙ্গে বিশুদ্ধ করার জন্য তাদের ৫টি প্ল্যান্ট আছে৷
পানি নিয়ে বৈষম্য
ঢাকা শহরে পানি নিয়ে বস্তিবাসী বা নিম্নবিত্ত মানুষ যেমন বৈষম্যের শিকার, তেমনি গ্রাম আর শহরের মানুষের মধ্যেও আছে বৈষম্য৷ নিরাপদ পানির জন্য সরকারের মোট বরাদ্দের শতকরা ৮০ ভাগই শহরের মানুষের জন্য৷ গ্রামের মানুষ পাচ্ছে বাকি ২০ ভাগ৷
৮৩ ভাগ শহুরে মানুষ তাদের হাতের কাছেই নিরাপদ পানির উৎস পায়৷ কিন্তু গ্রামে পায় ৭১ শতাংশ মানুষ৷ অন্যদিকে উপকুলীয় এলাকায় লবনাক্ততার কারণে নিরপদ পানির উৎস কমে যাচ্ছে, এর শিকারও হচ্ছেন মূলত গরীব মানুষ৷
সব মিলিয়ে গড় হিসেবে ৫৬ ভাগ পেলেও নিম্নবিত্ত মানুষের মাত্র ৩৬ ভাগের কাছে নিরাপদ পানি পৌছাচ্ছে৷
নিরাপদ পানির চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশে ২৪ হাজার কিলোমিটার নদী আছে৷ এর বাইরে সুপেয় পানির উৎস হিসেবে পুকুর, নলকূপের মাধ্যমে ভূগর্ভ থেকে পানি সংগ্রহ করা হয়৷ কিছু কিছু জায়গায় স্বল্পমাত্রায় বৃষ্টির পানি ব্যবহার হয়৷
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে ২০৩০ সালের মধ্যে পানির ৪টি দিক নিশ্চিত করতে হবে৷ সেগুলো হল প্রাপ্যতা, প্রবেশগম্যতা, গুণগত মান এবং পানি পাওয়ার আর্থিক সক্ষমতা৷ মো. লিয়াকত আলী বলেন, ‘‘মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল অর্জনে বাংলাদেশ এই ক্ষেত্রে সফল বলা যায়৷ কিন্তু সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল অর্জনে সময় আছে হাতে মাত্র ১১ বছর৷ এই সময়ের মধ্যে আরো ৪৪ শতাংশ মানুষের জন্য নিরাপদ পানি নিশ্চিত করতে হবে৷ এবং তা অব্যাহত রাখতে হবে৷ তাই সরকারকে আরো আন্তরিক হতে হবে৷''
নিরাপাদ পানির জন্য এখন সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে প্রায় ২০০ প্রতিষ্ঠান কাজ করছে৷ গ্রামাঞ্চলে নলকূপ পানির একটি বড় উৎস৷ কিন্তু তাতে আর্সেনিক সমস্যা আছে৷ যোবায়ের হাসান জানান,‘‘সরকার প্রতিটি মৌজায় একটি করে পুকুর খনন বা পুনর্খনন করতে চায় নিরাপদ পানির উৎস হিসেবে৷ আর নলকুপগুলো ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন৷ এর দায়িত্বে আছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর৷ সব মিলিয়ে পানির এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে, ২০৩০ সালের মধ্যে সবাইকে নিরাপদ পানি দিতে হলে খরচ করতে হবে ১৩৫ বিলিয়ন টাকা৷''