‘‘সমৃদ্ধশালী এক দেশ'' নাকি শম্বুক গতিতে কাছাকাছি আসা
৩ নভেম্বর ২০০৯আর বছর খানেক পরেই ১৯৯০ সালের ৩ অক্টবর পূর্ব জার্মানির ৫টি রাজ্য - মেক্লেনবুর্গ-ফরপমার্ন, ব্রান্ডেনবুর্গ, জাখসেন-আনহাল্ট, জাখসেন এবং থুরিংগেন - ফেডারেল জার্মানি বা তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাবে৷
বার্লিন প্রাচীরের পতনের ২০ বছর পর জার্মানির পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে কী স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছে? জার্মানির পুরানো রাজ্যগুলির সঙ্গে নতুন প্রবেশ করা রাজ্যগুলির সম্পর্ক আজ কেমন? আর ক্রমশই সমৃদ্ধ হতে থাকা এক পূর্বাঞ্চলের যে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল, তারই বা কী হল?
রাজনৈতিক দিক দিয়ে জার্মানি পুনরেকত্রিত হয়েছে সত্যি৷ কিন্তু পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে রয়ে গেছে এখনও অনেক ফারাক, বলেন ধর্মতত্ত্ববিদ ফ্রিডরিশ শর্লেমার৷ পূর্ব জার্মানির বিরোধী দলে সক্রিয় ছিলেন তিনি বহু বছর৷ শর্লেমার বলেন, ‘‘আমাদের মধ্যে এখনও অনেক ফারাক রয়েছে৷ পারস্পরিক বোঝাপড়াটাও বেশ কম৷ তবে ধীরে ধীরে তা দূর হবে৷ আমি মনে করি, আগামী ২০ বছরের মধ্যে তা সম্ভব৷''
১৯৮৯ সালে পশ্চিম জার্মানির তৎকালীন চ্যান্সেলর ও সামাজিক গণতন্ত্রী দলের প্রধান, ভিলি ব্রান্ট দুই জার্মানির একত্রে বেড়ে ওঠা নিয়ে একসময় যে আশাবাদী মন্তব্য করেছিলেন, সেই রকম জোরালো নয় শর্লেমার-এর এই বক্তব্য৷
দুই জার্মানির মানসিক মিলনের প্রক্রিয়াটা যে, শম্বুকের মত এত ধীর গতিতে চলতে থাকবে, প্রাক্তন জার্মান চ্যান্সেলর হেলমুট কোলও ভাবেননি৷ ১৯৯০ সালে পূর্ব জার্মানদের উদ্দেশে তিনি বলেছিলেন,
‘‘একত্রে আমরা সমৃদ্ধিশালী এক দেশ গড়ে তুলব৷'' সেই লক্ষ্যে পুরোপুরি পৌঁছাতে আরও সময় লাগবে৷
অবশ্য বেশ কিছু উন্নয়ন প্রক্রিয়া যে বাস্তবায়িত হয়নি তা বলা যায় না৷ পূর্ব জার্মানির পরিকাঠামো নতুন করে গড়ে তোলা হয়েছে: যেমন, অনেক হাইওয়ের পরিবর্ধন করা হয়েছে৷ করা হয়েছে নগর সংস্কার৷ ক্যাথিড্রালের মত বিখ্যাত কিছু প্রাচীন ভবন এবং বার্লিনের বিখ্যাত মিউজিয়াম এলাকার সংস্কার করা হয়েছে৷ অন্যদিকে পূর্ব জার্মানির একনায়কতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার কিছু স্মৃতিচিহ্ন মুছে ফেলা হয়েছে৷ যেমন ভেঙে ফেলা হয়েছে বার্লিনের ‘পালাস্ট ডেয়ার রিপুবলিক', আর অবয়বহীন দেশলাই বাক্সের মত তৈরি করা অসংখ্য দালান৷
তদানীন্তন পূর্ব জার্মানিতে এক সময় বাসস্থানের যে টানাটানি ছিল, আজ অবস্থাটা সে রকম নেই৷ পুব থেকে পশ্চিমে পাড়ি দিচ্ছেন বহু মানুষ৷ তাই অনেক দালান কোঠাই এখন ফাঁকা৷ দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর ১৯৪৫ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ৪৫ লাখের মত মানুষ তৎকালীন পূর্ব জার্মানি থেকে পশ্চিমে চলে এসেছেন৷ বেশিরভাগই ১৯৬১ সালে বার্লিন প্রাচীর নির্মাণের আগে৷ জনগণের তীব্র প্রতিবাদের মুখে ১৯৮৯ সালে বার্লিনের দেয়াল ভাঙা হলে ভ্রমণের স্বাধীনতা ফিরে পান পূর্ব জার্মানির মানুষ৷ তারপর থেকে আজ পর্যন্ত পূর্ব জার্মানিতে আরো ১৫ লক্ষ মানুষ কমে গেছেন৷
২০০৯ সালের ৩ অক্টবর জার্মানির পুনরেকত্রীকরণ দিবসে চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল বলেন,
‘‘সে সময় শুধু মাত্র যে অতীতের একটা অধ্যায়ই শেষ হয়েছে তাই নয়৷ বরং বলা যায় স্বাধীনতার এক নতুন যুগ শুরু হয়েছে৷ আর তার মাঝেই বাস করছি এখন আমরা৷''
১৯৯০ সালে জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র বা জিডিআর-এর জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১ কোটি ৪৫ লাখ(পূর্ব বার্লিন ছাড়া)৷ এখন এই সংখ্যা ১ কোটি ৩০ লাখ৷ অবশ্য প্রতি বছর পশ্চিমাঞ্চল থেকেও হাজার দশেক মানুষ পুবে বসবাসের জন্য যাচ্ছেন৷ কিন্তু পূর্ব থেকে পশ্চিমাঞ্চলে যাওয়ার প্রবণতাটা আরো অনেক বেশি৷ শুধু ২০০৮ সালেই জার্মানির পূর্বাঞ্চল ৫০ হাজার মানুষ হারিয়েছে৷ বিশেষ করে তরুণ ও শিক্ষিতদের মধ্যেই পশ্চিমে পাড়ি দেয়ার প্রবণতা দেখা যায়৷ থেকে যান প্রবীণ এবং সামাজিক ও আর্থিক দিক দিয়ে দুর্বল মানুষরা৷
এর কারণ হিসেবে বলা যায়, জার্মানির পূর্বাঞ্চলে অর্থনৈতিক উন্নয়নে শ্লথ গতি৷ পশ্চিমাঞ্চলের তুলনায় পূর্বাঞ্চলে গড় মাথাপিছু আয় এখনও অনেক কম৷ বেকারের হারও দ্বিগুন৷
তবে জার্মানির নতুন অঙ্গ রাজ্যগুলিতে অর্থনৈতিক ও বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে কিছুটা আশার আলো দেখা যাচ্ছে ইদানীং৷ অনেক জায়গায় স্থাপিত হচ্ছে বড় বড় কোম্পানি ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্র৷ কিন্তু সেসব সুদূরপ্রসারী ফল বয়ে আনবে কীনা তা এখনও বলা যাচ্ছে না৷ যেমন ড্রেসডেন শহরে গড়ে ওঠা জমজমাট ইলেকট্রনিক শিল্প অর্থনৈতিক সংকটের কবলে পড়েছে ইতিমধ্যে৷
জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল-এর মতে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করাই হবে ‘‘...সম্ভবত দুই জার্মানির জন্য প্রথম বিরাট এক চ্যালেঞ্জ৷ তবে কীভাবে তা সম্ভব হবে, তা কোথায় লেখা নেই৷ সংকটকে সুযোগ হিসাবে ব্যবহার করতে হবে৷ আমরা যদি বৈষম্য দূর করে পরস্পরের কাছে এগিয়ে আসতে পারি, কেবল তাহলেই আমাদের পক্ষে এক্ষেত্রে সফল হওয়া সম্ভব,'' বলেন জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল৷
প্রতিবেদক: রায়হানা বেগম
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক