1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

সম্ভব-অসম্ভব প্রত্যাশার চাপে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার

সাংবাদিক
মাসুদ কামাল
৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪

এখন, এই মুহূর্তে, নতুন সরকারের কাছে আপনার প্রত্যাশাটা কী?

https://p.dw.com/p/4kMwH
Bangladesch | Bildkombo Bangladesch Neue Regierung

প্রশ্নটা আমি অনেকের কাছে করেছি। গত এক সপ্তাহ ধরেই করছি। একেক জন একেক কথা বলেছেন। দ্রব্যমূল্য, আইন-শৃঙ্খলা, চাঁদাবাজি, সামাজিক নিরাপত্তা, আইনের শাসন, মানবাধিকার, নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার, রাজনৈতিক দলের সংস্কার—এরকম অনেক প্রত্যাশার কথাই উচ্চারিত হয়েছে নানা কণ্ঠে। সন্দেহ নেই, এ সবই পরিচিত প্রত্যাশা। গত দেড় দশকে এসব পায়নি নাগরিকরা। যা পায়নি, অথচ পেতে চেয়েছে, প্রত্যাশার তালিকায় সেসব থাকবে—এটাই স্বাভাবিক। এই চাহিদাগুলো যে একদিনেই পূরণ হয়ে যাবে, তেমনও কেউ হয়তো দাবি করবেন না। সবাই মানবেন—এতে সময় লাগবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এইসব প্রত্যাশা পূরণের কাজটা কি শুরু হয়েছে? অথবা শুরুর কোনো নমুনা কি দেখা যাচ্ছে?

৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার তিন দিন পর, ৮ আগস্ট দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন উপদেষ্টা পরিষদ। দায়িত্ব নেওয়ার পরপর, প্রথম দু'তিন দিন দ্রব্যমূল্যে একটা ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ্য করা গিয়েছিল। আমি নিজে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে গিয়ে শাক সবজি'র দাম দেখে কিছুটা বিস্মিতই হয়েছি। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, ইতিবাচক এই পরিবর্তনের পিছনে রয়েছে চাঁদাবাজির অনুপস্থিতি। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আগের সরকার সমর্থিত চাঁদাবাজরা যেন রাতারাতি উধাও হয়ে গিয়েছিল। সরকার, প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সমর্থনে এরা চাঁদা তুলতো। সেই চাঁদার ভাগ বিভিন্ন স্তরে ভাগ হয়ে হয়ে পৌছে যেত একেবারে মন্ত্রী পর্যায় পর্যন্ত। কদিন আগে একটা রিপোর্টে দেখলাম সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের কাছে নাকি প্রতিদিন দেড় কোটি পৌছে দেওয়া হতো এই এক কারওয়ান বাজার থেকে ওঠা চাঁদা থেকে। দেড় কোটি টাকা যদি মন্ত্রীর ভাগেই যেত, তাহলে মোট উঠতো কত? কেবল রাজধানী ঢাকার এই কারওয়ান বাজারেই নয়, সারা দেশেই চালু ছিল এই প্রবণতা। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে পণ্যবাহী যে ট্রাকগুলো আসত, সেগুলোকে ঘাটে ঘাটে চাঁদা দিতে হতো। শ্রমিক ইউনিয়ন, মালিক সমিতি, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, পুলিশ—সবাই চাঁদা নিতো। চাঁদার এই পুরো টাকাটাই তো যোগ হতো দ্রব্যমূল্যে। ফলে অবধারিতভাবেই বেড়ে যেত জিনিসপত্রের দাম৷

নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরশুরুর দুই তিন দিন দ্রব্যমূল্য কিছুটা কমলেও এর পরপরই বাজার আবার আগের জায়গায় ফিরে গেছে। তাহলে কি আবার শুরু হয়েছে চাঁদাবাজি? আগের লোকেরাই করছে, নাকি নতুন লোক এসেছে? আগের লোকেরা দল পরিবর্তন করে এসেছে, নাকি নতুন দলের লোকেরা জায়গাটা দখলে নিয়েছে? ঠিক কী ঘটেছে সেটা নিয়ে হয়তো বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু চাঁদাবাজি যে থামেনি সেটা বলা যায় নির্দ্বিধায়। দিন কয়েক আগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বসেছিলেন কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ীরা। সেখানেও উঠেছে চাঁদাবাজির এই প্রসঙ্গটি। সরকারি কর্মকর্তারা বারবার জানতে চাইলেও ব্যবসায়ীরা কারো নাম বলেননি। তারা নাম বলে বিপদে পড়তে চাননি। কেবল বলেছেন, তাদেরকে আগামীতেও ব্যবসা করতে হবে৷

এ থেকে বোঝা গেছে, তারা আসলে এই সরকারের ওপরেও ঠিক ভরসা করতে পারছেন না। নাম বলে দেওয়ার পর এই সরকার অপরাধীদের ধরতে পারবে, কিন্তু তাদেরকে সাজার আওতায় আনতে পারবে—এমন নিশ্চয়তা তারা পাচ্ছেন না। এই যে ব্যবসায়ী কিংবা সাধারণ নাগরিকদের আস্থা অর্জন করতে না পারা, আমার মনে হয় এটাও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একটা দায়। এই দায়ের অবস্থান মানুষের প্রত্যাশার একেবারেই বিপরীতে।

সরকার হয়তো বলতে পারে, এমন বিশাল একটা গণঅভ্যুত্থানের পর পুলিশ বিভাগকে এখনো পুরোদমে সক্রিয় করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু এটা কি গ্রহণযোগ্য? প্রত্যাশা তো কেবল পুলিশ বিভাগকে সক্রিয় করাই নয়, সেই সঙ্গে এদেরকে আন্তরিক করে তোলাও। মনে রাখতে হবে, এই পুলিশ বিভাগ যতটা না পেশাদার, তার চেয়েও অনেক বেশি বিগত সরকারের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট। টানা ১৬টি বছর তারা ক্ষমতায় ছিল। এই দীর্ঘ সময়ে নিজেদের মত করে তারা বাহিনীটিকে গড়ে তুলেছে। এই সময়ে যত নিয়োগ হয়েছে, বিরোধী রাজনৈতিক বলয়ের কেউ কি ঢুকতে পেরেছে? সে সম্ভাবনা ছিল খুবই কম। তো সেরকম একটা পুলিশ বাহিনী চিন্তা-চেতনায় এক রাতের ব্যবধানেই একেবারে বিপরীত আদর্শের কর্মী হয়ে উঠবে—এরকম আশা করা যায় না। এমনকি সকল রাজনৈতিক আদর্শকে পাশে ঠেলে পুরোপুরি পেশাদার হয়ে যাবে, সেটাও বা কতটুকু যৌক্তিক? তাহলে হবেটা কী? দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার কার ওপর নির্ভর করবে?

উত্তর একটাই—পুলিশকে মোটিভেট করতে হবে? সেটা কি করা সম্ভব হয়েছে? উত্তর হচ্ছে— না। সেই মোটিভেশন প্রক্রিয়ার শুরু কি হয়েছে? এই প্রশ্নেরও উত্তর ওই একই— না। তাহলে? এই প্রশ্নের কোনও জবাব নেই। খোদ স্বরাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টাও এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন কি-না, আমার সন্দেহ রয়েছে। অথচ একটা মোটিভেটেড পুলিশ বিভাগ ছাড়া আপনি চাঁদাবাজি বন্ধ করতে পারবেন? আইনের শাসন কায়েম করতে পারবেন?

সমাজে যে কোনো অপরাধ ঘটলে মানুষ প্রথমে কোথায় যায়? পুলিশের কাছেই তো? অথচ থানাগুলোর এখন কী অবস্থা? থানা আছে, পুলিশও আছে। কিন্তু কোথাও যেন প্রাণ নেই। সবাই মনমরা হয়ে বসে থাকে। কোনও অভিযোগ নিয়ে গেলে লিখে রাখে, কিন্তু ওই পর্যন্তই। এরপর আর কোনও অ্যাকশন নিতে দেখা যায় না। দু'একজন পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে আমার যে কথা হয়নি, তা নয়। তাদের কথা— তদন্তে যেয়ে আমরা বিপদে পড়বো নাকি! হয়তো সন্দেহভাজন কাউকে ধরবো, দেখা যাবে স্থানীয় কিছু তরুণ নিজেদেরকে ছাত্র পরিচয় দিয়ে মিছিল করে এসে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবে। কী করবো আমরা? বেইজ্জতি হওয়ার জন্য যাবো?

এসব কথায় বাড়াবাড়ি কি কিছু আছে? আছে কি অজুহাত? থাকতে পারে। কিন্তু এমন ঘটনা যে কিছু একেবারেই ঘটছে না—তা-ও তো নয়। খবর তো পাচ্ছি আমরা। অনেক জায়গাতেই আজকাল ছাত্ররাই যেন বিচারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে গেছে। তারা বিচার-শালিশ করছে। কোন অফিসে বা প্রতিষ্ঠানে কে থাকবে, আর কে থাকবে না, সেসব নির্ধারণ করে দিচ্ছে। সরকার কি এসব থামাতে পারছে?

দুদিন আগে আমার এক সহকর্মী, যিনি হিন্দু ধর্মাবলম্বী এবং কিছুটা আওয়ামী ভাবাপন্ন, বললেন—এবারের এই আন্দোলনে মৃত্যুভয় কাকে বলে সেটা তিনি উপলব্ধি করেছেন। ওই সময়টায় তিনি তাদের জেলা শহরের বাড়িতে ছিলেন। বললেন, আশপাশের বাড়িতে লুটপাট হচ্ছে, আগুন জ্বলছে, আর আমরা বাড়িতে বসে ভয়ে কাঁপছি। যারা এগুলো করছে, তাদেরকে যে একেবারে চিনি না, তাও নয়। ওদের দুএকজন হয়তো বিএনপি করে, বাকিরা নিছকই চোর-ডাকাত টাইপের। থানায় পুলিশকে ফোন করেছি, তারও অসহায়। একটা ভয়াবহ অরাজক পরিস্থিতি। একটা স্বাধীন দেশে এমন কেন হবে? এমন প্রশ্নের সদুত্তর কি আছে?

এতকিছু প্রত্যাশার ভিড়ে যে বিষয়টি আসার কথাই ছিল না, সেই বাক-স্বাধীনতার কথাও কিন্তু উঠছে। আওয়ামী আদর্শের প্রতি অনুগতরা কোনো কথা কি নির্ভয়ে বলতে পারছেন? এমনই একজন বললেন, মানছি—শেখ হাসিনা স্বৈরাচারী ছিলেন। তিনি বিরুদ্ধ মত ও ব্যক্তিদের নির্মমভাবে দমন করেছেন। তার তো পতন হয়েছে, তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। শেখ হাসিনা স্বৈরাচারী ছিলেন বলে কি আওয়ামী লীগের সবাই স্বৈরাচারী ছিল? আওয়ামী লীগের অনেকেই কি গণতন্ত্রমনাও ছিল না। হয়তো তারাও হাসিনার স্বৈরাচারী আচরণের শিকার হয়ে কোনঠাসা ছিলেন। আর তাছাড়া আওয়ামী লীগ কি সব সময়ই হাসিনার আওয়ামী লীগ-ই ছিল? এই দলটিই তো আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্বে ছিল। তাদের সেই সমস্ত অবদান, সকল গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ কি এক শেখ হাসিনার কারণে বাতিল হয়ে যাবে? এটা হয় না। এখন যদি আওয়ামী লীগকে রাজনীতি করতে বাধা দেওয়া হয়, তাহলে বর্তমান সরকার কিভাবে নিজেদেরকে হাসিনার মনোভাবের চেয়ে ভিন্নতর বলে দাবি করতে পারবে?

‘দল হিসেবে আওয়ামী লীগ চলবে’

তবে প্রত্যাশার তালিকায় দীর্ঘ মেয়াদে যে প্রসঙ্গগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিতে পারে বলে আমার মনে হয়, তার মধ্যে প্রথমেই আসবে নির্বাচন ও শাসন ব্যবস্থা কথা।  নির্বাচনটা কীভাবে হবে—কারা নির্বাচনে অংশ নেবেন, নির্বাচিত হওয়ার পর তাদের দায়-দায়িত্ব কেমন হবে, প্রধানমন্ত্রীর জবাবদিহিতা কার কাছে কীভাবে হবে, প্রেসিডেন্ট কেবলই একটা রাবার স্ট্যাম্প হিসাবে টিকে থাকবে নাকি প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার সঙ্গে একটা ভারসাম্যমূলক অবস্থানে থাকবেন—এসব বিষয়ের সুরাহাও প্রত্যাশা করে সচেতন মানুষ। অনেকেই মনে করেন, নির্বাচনটা হওয়া উচিত সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে। যে দল যত শতাংশ ভোট পাবে, জাতীয় সংসদে তাদের তত শতাংশ সদস্য থাকবে। সংসদ দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট হওয়ার দাবিও রয়েছে অনেকের। কেউ কেউ এমনও বলছেন, স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার কথা। এলাকার উন্নয়ন নির্বাচিত স্থানীয় সরকারের হাতেই থাকা দরকার, সংসদ সদস্যদের সেখানে কোনোই ভূমিকা থাকার কথা নয়। এসব বিষয় নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। আর এসবের পাশাপাশি অনিবার্যভাবেই এসে যাচ্ছে দুর্নীতিমুক্ত সমাজ ও আইনের শাসন কায়েমের কথা। বলা হচ্ছে এমন একটা সিস্টেম তৈরি করতে হবে, যাতে নাকি নতুন কোন শাসক এসে স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে না পারে। স্বৈরাচারী হতে চাইলেও যেন সেই সিস্টেমই তাকে আটকে দেয়। তেমন কিছু করতে গেলে প্রথমেই এসে যাবে সংবিধানের কথা। বর্তমানে যে সংবিধান আছে, কাটাছেড়া করতে করতে এটাকে এমন একটা বিকলাঙ্গ চেহারা দেওয়া হয়েছে, এই সংবিধানই প্রধানমন্ত্রীকে সকল জবাবদিহিতার উর্ধ্বে তুলে দিয়েছে। কাজেই সংবিধানে পরিবর্তন আনতে হবে। এসব কিছুই বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিবেচনায় নিয়ে কাজ করবে, এমন প্রত্যাশাও করছে দেশের মানুষ।

এই যে বিশাল প্রত্যাশার পাহাড়, এসব করার জন্য সময় কতটুকু দেওয়া হবে এই সরকারকে? এটা নিয়েও রয়েছে নানা মত। কেউ কেউ আছেন, প্রত্যাশা অনেক কিন্তু সময় দিতে চান একেবারেই কম। আবার কেউ কেউ বলছেন, রাজনৈতিক সরকার অনেক দেখেছি, বরং এই অরাজনৈতিক সরকারই থাক। এরা হয়তো অনভিজ্ঞ, কিন্তু আন্তরিকতার তো অভাব নেই। এরা আর যা-ই করুক, চুরি তো করছে না।

সাধারণ মানুষের এমন চিন্তার পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর প্রত্যাশা প্রভাবও পড়বে অন্তবর্তীকালীন সরকারের ওপর। সরকারকে সেসব বিবেচনায় নিতে হবে। তারাও তাদের মত করে অনেক প্রত্যাশা লালন করে, তার থেকে কিছু কিছু প্রকাশ করে। তবে এদের যে দাবিটি সরকারকে আগামীতে ভোগাবে বলে ধারণা করি, সেটা হচ্ছে সময়সীমার প্রত্যাশা। যাদের দেশজুড়ে গোছানো দল রয়েছে, তারা চাইবে দ্রুত নির্বাচন। আর যাদের দল গোছানোর জন্য আরও কিছুটা সময় লাগবে, তারা বলবে নির্বাচন হোক একটু পরেই। এরকম দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতির মধ্যে সরকার কতটা কী করতে পারবে—সেটাই এখন দেখা বিষয়।