সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণ শিল্প
২২ ডিসেম্বর ২০১০মাত্র কিছুদিন আগেও জাহাজ কেনার জন্য ধনী দেশগুলো ছুটে গেছে চীন, জাপান, মালয়েশিয়া কিংবা কোরিয়ার কাছে৷ কিন্তু এখন বাংলাদেশের জাহাজ তৈরির প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে ঝুঁকছে পশ্চিমের দেশগুলো৷ ২০০৮ সাল থেকে বাংলাদেশ জাহাজ তৈরির ক্ষেত্রে বেশ সফলতার মুখ দেখতে শুরু করেছে৷ ইতিমধ্যে চারটিরও বেশি বড় জাহাজ বিক্রি করেছে বাংলাদেশ৷ এছাড়া জার্মানি, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ডস, নরওয়ে এবং মোজাম্বিকসহ বেশ কিছু দেশ থেকে আরো অনেকগুলো জাহাজ তৈরির অর্ডার পেয়েছে বাংলাদেশ৷
সম্প্রতি বাংলাদেশের ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড বাংলাদেশের বৃহত্তম এবং দীর্ঘতম দু'টি জাহাজ হস্তান্তর করলো জার্মান প্রতিষ্ঠান গ্রোনা শিপিং-এর কাছে৷ ১০০ মিটার দীর্ঘ জাহাজ দু'টির প্রত্যেকটি ৫,২০০ টন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন৷ এগুলোর প্রত্যেকটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৮০ কোটি টাকা করে৷ গ্রোনা শিপিং-এর কাছে ২০১২ সালের মধ্যে মোট ১২টি জাহাজ হস্তান্তরের কথা রয়েছে ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের৷ সম্পূর্ণ প্রকল্পটির জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৯০০ কোটি টাকা৷ উল্লেখ্য, ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশে জাহাজ নির্মাণ কাজ শুরু করে ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ড৷
ইএমএসরিভার জাহাজটি যখন চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর থেকে ধীর গতিতে ছেড়ে যাচ্ছিল বাংলাদেশের জলসীমা তখন অনেকেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারেন নি৷ যদিও এটা ছিল একদিকে বাংলাদেশের সাফল্যের প্রতীক, অন্যদিকে এটা ছিল যেন নিজের সন্তানকে অজানার উদ্দেশ্যে বিদায় দেওয়া৷ তাই সুখ আর দুঃখের সংমিশ্রণে ভরা ছিল জাহাজ হস্তান্তরের ক্ষণ৷
জাহাজ নির্মাণ শিল্পে বাংলাদেশ নতুন হলেও জাহাজ নির্মাণের কাজে ব্যবহৃত উপকরণ থেকে শুরু করে প্রত্যেক ধাপে সেগুলোর সঠিক মান নিয়ন্ত্রণে মেনে চলা হচ্ছে আন্তর্জাতিক নিয়ম-নীতি৷ এসব জাহাজের গুণগত মান তদারকি করার জন্য বাংলাদেশে কাজ করছে গের্মানিশের লয়েডসহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান৷ গের্মানিশের লয়েড এর সিনিয়র সার্ভেয়ার এ কে এম মাসুদ করিম ডয়চে ভেলেকে বলেন, বাংলাদেশে তৈরি এসব জাহাজের মান শতভাগ সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে৷ ফলে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো এসব জাহাজের গুণগত মান দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেছে৷ এছাড়া তারা বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে আরো বেশি জাহাজ কেনার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে৷
বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণ শিল্পকে এগিয়ে নিতে সেদেশের সরকারের কাছ থেকেও যথেষ্ট ইতিবাচক পদক্ষেপ এবং সহযোগিতা প্রদান করা হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন পেশায় মেরিন ইঞ্জিনিয়ার মাসুদ করিম৷ তিনি বলেন, গের্মানিশের লয়েড সারা বিশ্বে জাহাজ এবং এর যন্ত্রাংশের মান একইরকমভাবে নিরূপণ করে এবং তদারকি করে৷ তাই জাপান, কোরিয়া কিংবা ইউরোপে তৈরি যে কোন জাহাজের চেয়ে বাংলাদেশের জাহাজের মান কোন অংশেই কম নয়৷ বাংলাদেশের জাহাজ নির্মাণ শিল্প অত্যন্ত সম্ভাবনাময় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভৌগলিক অবস্থানসহ জাহাজ নির্মাণে বেশ কিছু সুবিধা রয়েছে বাংলাদেশে৷
জাহাজ নির্মাণ কাজে দক্ষ এবং আধা-দক্ষ প্রায় এক লাখ শ্রমিক রয়েছে বাংলাদেশের৷ অন্যান্য দেশের তুলনায় সেখানে শ্রমিকদের মজুরি দিতে হয় কম৷ এছাড়া জাহাজ নির্মাণ কাজে দক্ষতা সৃষ্টি ও বৃদ্ধির জন্য রয়েছে বেশ অনেকগুলো প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান৷ রয়েছে নদীমাতৃক বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তের সাথে চমৎকার নৌযোগাযোগ ব্যবস্থা৷ তাই সরকার এবং উদ্যোক্তারা আরো গুরুত্বের সাথে এই শিল্পের দিকে মনোযোগ দিলে জাহাজ নির্মাণ শিল্প দ্রুত সাফল্য পাবে বলে মনে করেন তিনি৷ সাম্প্রতিক এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে বাংলাদেশ বৈদেশিক বাণিজ্য ইন্সটিটিউট - বিএফটিআই উল্লেখ করেছে যে, আগামী দশ বছরে জাহাজ নির্মাণ শিল্প বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাতে পরিণত হতে পারে৷
প্রতিবেদন: হোসাইন আব্দুল হাই
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক