সরকারি উদাসীনতা ও জবরদখলের জেরে মৃতপ্রায় কলকাতার দুই খাল
জবরদখলের চাপে ও সরকারি উদাসীনতায় কলকাতার মানচিত্র থেকে মুছে যেতে পারে বাগজোলা ও কেষ্টপুর খাল, আশঙ্কায় পরিবেশবিদেরা।
মিশেছে বিদ্যাধরীতে
গন্তব্য একটাই। তা হল বিদ্যাধরী নদী বা কুলটি গাঙ। বহু নদী, খালের মতো বাগজোলা আর কেষ্টপুর খালেরও শেষ গন্তব্য উত্তর ২৪ পরগনার এই নদী। উত্তর শহরতলির বরাহনগর বিধানসভা এলাকার ডানলপের কাছ থেকে শুরু হয়ে বহু এলাকা পেরিয়ে কুলটির ঘুসিঘাটার কাছে গিয়ে বিদ্যাধরীতে মিশেছে এই বাগজোলা খাল।
দীর্ঘ ৩৮ কিলোমিটার পথ
পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হওয়া প্রায় ৩৮ কিলোমিটার এই জলপথের দু’টি অংশ রয়েছে। ডানলপ থেকে শুরু করে কেষ্টপুরের ভিআইপি রোড পর্যন্ত অংশটিকে বলা হয় ‘আপার বাগজোলা’ এবং তার পর থেকে কুলটি গাঙ পর্যন্ত অংশটি ‘লোয়ার বাগজোলা’।
বর্ষার বাগজোলা
ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী, ওই সমস্ত শাখা খাল দিয়েই উত্তর শহরতলির বিস্তীর্ণ অংশের জমা জল বাগজোলা আর কেষ্টপুর খালে যাওয়ার কথা। বাস্তবে তা হচ্ছে না। কারণ, প্রতি বর্ষায় দেখা যায়, বাগজোলা আর কেষ্টপুর খাল নিজেই ভরে রয়েছে। ফলে অন্যের জল নেওয়ার ক্ষমতা তার থাকে না। একসময় এই খাল দিয়ে নৌকা চলতো। এখন আর চলে না। খালে শুধু কালো জল ভরে থাকে।
পরিবেশবিদ যা বলছেন
জাতীয় পরিবেশ আদালত সূত্রের খবর, গৌরাঙ্গনগর এবং নিউ টাউন এলাকায় লোয়ার বাগজোলা খালের দু’পাড় জবরদখল হয়েছে। পরিবেশবিদ জয়া মিত্রর কথায়, বসতির কারণে আশেপাশের এলাকার বৃষ্টির জল সঠিকভাবে খালে পৌঁছতে পারে না। ওই খালের মধ্যে ফেলা হয় সেই বসতিগুলির বিভিন্ন বর্জ্য। খালে জমে থাকা ওই নোংরা জল ভূগর্ভে প্রবেশ করে ভূগর্ভস্থ জলকে দূষিত করে তোলে। এটা খাল ও পার্শ্ববর্তী মানুষদের স্বাস্থ্য, দুয়ের পক্ষেই ভয়ংকর।
খাল এখন নর্দমা
শৌচালয়ের বর্জ্য সরাসরি খালে ফেলার কথা নয় এটা প্রশাসন জানে। নিজেদের পরিকাঠামো ও সদিচ্ছার অভাব আছে বলে তারা চুপ বলে অভিযোগ। এই ধরনের বর্জ্যের সঙ্গে রয়েছে রাসয়নিক বর্জ্য, সেগুলোকেও খালে ফেলে খালগুলোকে নর্দমা বানিয়ে দেয়া হয়েছে। এই বসতির জন্য বৃষ্টির জল সরাসরি খালে নামতে পারে না, গড়িয়ে আসা জল খালে পড়লে ও খালের মুখ বাধাহীন হলে বহমান স্রোতে জল কিছুটা অবর্জনামুক্ত, স্বশোধিত হয়ে উঠতে পারে, বললেন জয়া।
পরিবেশ আদালতের মামলা
পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্তর কথায়, দু’পাড়ের দখলদারিই যে খালের দূষণের অন্যতম কারণ, সেটা কার্যত স্বীকার করে নিয়েছে রাজ্যের সেচ দপ্তর। বাগজোলা ও কেষ্টপুর খালের দূষণ নিয়ে জাতীয় পরিবেশ আদালতের (এনজিটি) ২০১৭ সালে করা একটি মামলায় দেয়া হলফনামায় সেচ ও জলপথ পরিবহণ দপ্তর আঙুল তুলেছে খালের দু’পাশ দখলদারির দিকে। হলফনামায় আরও অভিযোগ ছিল, দু’টি খালে অবাধে মিশছে কঠিন ও তরল বর্জ্য।
হলফনামায় যা বলা আছে
সেচ দপ্তরের হলফনামায় দাবি করা হয়েছে, দুই পাড়ে দখলদারির জন্য খালের কিছু জায়গায় তারা সাফাইয়ের কাজ ঠিক মতো করতে পারছে না। দু’টি খালে কঠিন ও তরল বর্জ্য যে পড়ছে, সে কথাও সেচ দপ্তর হলফনামায় স্বীকার করেছে। তবে খালের ড্রেজিং যে ঠিক মতো হয়েছে এবং খাল যে নিয়মিত সাফ করা হয়, সেই দাবিও করা হয়েছে ওই হলফনামায়।
পুরসভার দায়
মামলাটি দু’টি খাল নিয়ে হলেও বেশি সমস্যা বাগজোলা খাল নিয়ে। বাগজোলা খাল ৩৮ কিলোমিটার দীর্ঘ। ওই খাল কলকাতা পুর এলাকা তো বটেই, সেই সঙ্গে বিধাননগর, দক্ষিণ দমদম ও উত্তর দমদম, পানিহাটি, কামারহাটি, বরাহনগর পুরসভা এবং নিউ টাউন-রাজারহাটের নিকাশির অন্যতম আধার। একই সঙ্গে ওই সব এলাকার বর্জ্যও বাগজোলা খাল বহন করে চলেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে এই দূষণের দায় পুরসভাগুলো এড়াতে পারে না।
শৌচাগারের বর্জ্য
এর মধ্যে খালের ড্রেজিং হয়েছে। তাতে নাব্যতা বেড়েছে। বর্ষায় জল জমার সমস্যাও মিটেছে অনেকটা। কিন্তু ফের দূষণ নিয়ে অভিযোগ ওঠায় ২০২৪ সালের শুরুর দিকে নতুন করে দু’টি খালের পরিস্থিতি সরেজমিনে খতিয়ে দেখেন সুভাষ দত্ত। এবং তার পর তাঁর অভিযোগ, ‘খালের দু’পাড় দখল করে অসংখ্য ঝুপড়ি তৈরি হয়েছে। প্রতিটি ঝুপড়ির সঙ্গে একটি শৌচাগার, যার বর্জ্য সরাসরি খালের জলে মিশছে।
ভোটব্যাঙ্কের জন্য?
খালের দুইধার ধরে পাকা বাড়ি এবং দোকানঘর, পাকা শৌচাগারও তৈরি হয়েছে কেষ্টপুরের আদর্শপল্লি, গৌরাঙ্গনগর, জগৎপুর এলাকার প্রায় পাঁচ কিলোমাটার বিস্তৃত পথে। এই প্রসঙ্গে পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত বললেন, সরকার সবটাই জানে। এই ঝুপড়িগুলোয় বসবাসকারি মানুষেরা আসলে ভোটব্যাঙ্ক। এত বড় সংখ্যক ভোটারকে চটাতে চাইছে না তারা।
আলোচনাই সার
খালে তরল রাসায়নিক ও বর্জ্য মিশছে বলে যে অভিযোগ করা হয়েছে, তা রাজ্যেরই একটি বিদ্যুৎ বণ্টন কেন্দ্রের। তা ছাড়া, খালের দুই দিকেই বাজার, প্রচুর দোকানপাট রয়েছে। সেগুলো থেকেও খালে তরল ও কঠিন বর্জ্য মিশছে। সেচ দপ্তরের প্রস্তাব— ওই সব বর্জ্য খালে এসে পড়ার আগেই তা আটকে দেওয়ার ব্যবস্থা করলে খালকে দূষণমুক্ত করা যাবে। এই ব্যাপারে সেচ দপ্তর বিভিন্ন পুরসভা, পুর ও নগরোন্নয়ন দপ্তরের সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছে।
আদালতের নির্দেশ
কঠিন ও তরল বর্জ্যের ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতার জন্য দুই বছর আগে রাজ্য সরকারের উপরে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা পরিবেশগত ক্ষতিপূরণ ধার্য করেছিল জাতীয় পরিবেশ আদালত। নির্দেশ দিয়েছিল, সরকারকে পৃথক তহবিল তৈরি করে ওই টাকা জমা রাখতে হবে।
সরকার অসহায়!
রাজ্যের মুখ্যসচিবের নেতৃত্বে সেই তহবিল থেকে কঠিন ও তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় খামতি দূর করার জন্য অর্থ খরচ করতেও বলা হয়েছিল। সেই মতো রাজ্য সরকার সংশ্লিষ্ট তহবিল তৈরি করে। কিন্তু পরিবেশগত ছোটখাটো প্রকল্পের জন্যও সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার ওই তহবিলের অর্থ খরচ করতে সরকারের এত ‘অনীহা’ কেন? কেন বার বার তহবিলের অর্থ খরচ করতে সরকারের তরফে ‘অসহায়তা’ প্রকাশ করা হচ্ছে?