সরকারি হিসাবের চেয়ে প্রকৃত বেকারত্ব অনেক বেশি
৪ মে ২০২৩বিশ্লেষকেরা বলছেন, বিবিএস বেকারত্বের যে সংজ্ঞার ওপর বেকারত্বের হার নির্ধারণ করে তা গ্রহণযোগ্য নয়। বাংলাদেশে প্রকৃত বেকারের সংখ্যা বিবিএসের হিসাবের চেয়ে অনেক বেশি।
বিবিএস এই ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপ জরিপ প্রকাশ করে ২ এপ্রিল। জরিপে তারা বলছে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ এই তিন মাসে আগের তিন মাসের ( অক্টোবর-ডিসেম্বর) তুলনায় বাংলাদেশে বেকার লোকের সংখ্যা বেড়েছে দুই লাখ ৭০ হাজার।
চলতি বছরের মার্চ মাস শেষে দেশে মোট বেকার ছিলেন ২৫ লাখ ৯০ হাজার । আর গত বছরের ডিসেম্বর শেষে বেকারের সংখ্যা ছিল ২৩ লাখ ২০ হাজার। দেশে এখন মোট বেকারের মধ্যে পুরুষ ১৭ লাখ ১০ হাজার এবং নারী আট লাখ ৮০ হাজার।
২০২২ সালের জরিপে ওই বছর দেশে মোট বেকার ছিলেন ২৬ লাখ ৩০ হাজার। এর মধ্যে পুরুষ ১৬ লাখ ৯০ হাজার এবং নারী ৯ লাখ ৪০ হাজার।
দেশের শ্রমশক্তিতে নিয়োজিত মোট জনগোষ্ঠী সাত কোটি ৩৬ লাখ। কর্মে নিয়োজিত জনগোষ্ঠী বর্তমানে সাত কোটি ১১ লাখ।
শ্রমশক্তির বাইরে থাকা জনগোষ্ঠী চার কোটি ৬৩ লাখ। কৃষিতে নিয়োজিত আছে তিন কোটি ১৯ লাখ, শিল্প খাতে এক কোটি ২২ লাখ, সেবা খাতে দুই কোটি ৬৯ লাখ মানুষ। দেশের যুব শ্রমশক্তি দুই কোটি ৭৩ লাখ। এখন দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর ৩.৫১ শতাংশ বেকার।
সর্বশেষ জনশুমারি বলছে দেশের এখন মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ।
কেন বেকার বাড়ছে?
বিবিএসের জরিপ প্রকাশ অনুষ্ঠানে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেন, "শীতকালে কাজের সুযোগ কম থাকে, বিশেষ করে কৃষি খাতে তখন কাজ কম থাকে। সেকারণে বেকার বেড়েছে। এখন ধান কাটার মৌসুম শুরু হয়েছে। এ খাতে কাজের সুযোগ অনেক বেড়েছে। ফলে বেকার মানুষের সংখ্যা আবার কমে আসবে।”
কিন্তু সিরডাপের পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মো. হেলাল উদ্দিন মনে করেন, "এটা মৌসুমি বেকারত্ব নয়। সামনে এই প্রবণতা অব্যাহত থাকবে এবং বেকারত্ব আরো বাড়বে বলে আশঙ্কা করি। এর কয়েকটি কারণ আছে। প্রথমত, কাঁচামালের আমদানি কমে যাওয়ায় শিল্প উৎপাদন কমে যাচ্ছে। ফলে সেখানে শ্রমিকেরা কাজ হারাচ্ছেন। এটা তৈরি পোশাক খাতসহ সব শিল্পখাতেই। ডলার সংকটের কারণে কাঁচামাল আমদানি করা যাচ্ছেনা। আর নতুন বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীরা এখন অনেক সতর্ক। কারণ ভবিষ্যৎ অনেকটা অনিশ্চিত। ফলে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। আবার অনেক প্রতিষ্ঠানের প্রফিট মার্জিন কমে গেছে উৎপাদন ব্যয় বাড়ার কারণে ফলে তারাও কর্মী ছাটাই করছে। সব মিলিয়েই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে।”
তবে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, "মৌসুমি বেকারত্ব আছে। শীতকালে কৃষিখাতে কাজ কমে যায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো তারা তখন বেকার থাকেন না অন্যখাতে চলে যান। আমরা জানি তখন গ্রামে যারা কৃষিকাজ করেন তাদের বড় একটি অংশ শহরে চলে আসেন রিকশা চালাতে বা অন্যকোনো কাজ করতে। তাই বাস্তব অবস্থা বুঝতে আরো গভীর জরিপ করা প্রয়োজন।”
তিনি বলেন,"তবে এটা ঠিক যে নতুন কর্মসংস্থান তেমন হচ্ছে না। নানা কারণে অনেকে কাজ হারাচ্ছেন। নতুন বিনিয়োগ না হলে তো কর্মসংস্থান হবে না। আর এখন লেবার ইনটেনসিভ না হয়ে ক্যাপিটল ইনটেনসিভ বিনিয়োগ হলে কর্মসংস্থান তো সেই হারো বাড়বেনা।”
বেকারত্বের প্রকৃত অবস্থা কী?
বিবিএস বলছে বেকার মূলত তারাই, যারা গত সাত দিনে কমপক্ষে এক ঘণ্টাও কাজ করেনি, কিন্তু গত সাত দিনে কাজ করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন এবং গত ৩০ দিনে বেতন মজুরি বা মুনাফার বিনিময়ে কাজ খুঁজেছেন।
বিবিএসের এই সংজ্ঞাকে গ্রহণ করতে নারাজ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন। তিনি বলেন, "কারো কাজ থাকা মানে হচ্ছে সারা বছর তিনি দেশের মিনিমাম ওয়েজে একটি কাজে যুক্ত আছেন। সপ্তাহে একবার বা মাসে একবার এক ঘণ্টা কাজ করলে তাকে কর্ম নিয়োজিত আছেন বলে হিসাব করা হাস্যকর। আর কাজ এমন হতে হবে যাতে তিনি পরিবার পরিজন নিয়ে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মোটামুটিভাবে জীবনযাপন করতে পারেন।”
তার মতে, সেইভাবে হিসাব করলে বাংলাদেশে বেকার মানুষের সংখ্যা বিবিএসের হিসাবের চেয়ে অনেক বেশি। বিশ্লেষকেরা বলছেন, কৃষিখাতে কর্মসংস্থানের একটি বড় হিসাব দেয়া হয়। কিন্তু এই খাতে ছদ্ম বেকারের সংখ্যা অনেক বেশি। কারণ এই খাতে একজনের কাজ অনেকজন মিলে করেন। বিশেষ করে নিজের জমিতে যারা নিজেরাই চাষাবাদ করেন তাদের ক্ষেত্রে এই ছদ্ম বেকারত্ব বেশি।
ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন,"বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষই কিছু না কিছু করে খায়। কাজ করে না এমন মানুষের সংখ্যা তো খুবই কম। উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্ত ঘরের কিছু তরুণ হয়তো কিছু করেনা। করার প্রয়োজন মনে করে না। এখন বছরে বা মাসে এক ঘন্টা কাজ করলেই যদি তাকে বেকারের হিসাব থেকে বাদ দেয়া হয় তা হলো তো বেকারের প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাবে না। এখন যে শতকরা তিন-চার ভাগ বেকার বলা হচ্ছে এটা ঠিক নয়। বাংলাদেশে বেকারত্ব এখন ভয়াবহ অবস্থায় আছে।”