মমতার ভাবমূর্তি চ্যালেঞ্জের মুখে
৬ এপ্রিল ২০১৭প্রথমবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হওয়া থেকে এ রাজ্যে বিরোধী নেত্রী, এমনকি মহাকরণের লালবাড়ি দখল নেওয়ার পরও অগ্নিকন্যার সততার ইমেজ টোল খায়নি৷ এটাই তাঁর রাজনীতির প্রধান পুঁজি৷ বিজেপি সভাপতি বঙ্গারু লক্ষ্মণের দুর্নীতির ভিডিও টেপ প্রকাশ্যে আসায় তৃণমূল নেত্রী কেন্দ্রের এনডিএ মন্ত্রিসভা থেকেও বেরিয়ে এসেছিলেন৷ কেলেঙ্কারির সঙ্গে আপোসহীন মমতার সততার ভাবমূর্তি তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের কারণে এখন কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে৷
দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের জনপ্রিয় নেত্রী প্রয়াত জয়ললিতার বিলাসবহুল জীবনযাত্রা, একাধিক দুর্নীতির মামলার অভিযোগের পাশে তৃণমূল নেত্রী একেবারে বেমানান৷ রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়ার রাজকীয় গরিমা কিংবা উত্তর প্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতীর আত্মপ্রচারের সঙ্গেও মমতাকে মেলানো যায় না৷ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরও তিনি টালি-ছাওয়া ঘরেই থেকে গিয়েছেন৷ পারিশ্রমিক হিসেবে মাত্র এক টাকা নেন সরকারের কাছ থেকে৷ মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তাঁর প্রাপ্য টাকা জমা হয় ত্রাণ তহবিলে৷ এমন এক নেত্রীর ঘনিষ্ঠ বৃত্তে থাকা নেতাদের যখন টিভির পর্দায় গোছা গোছা টাকা নিতে দেখা যায়, তখন নেত্রীর ইমেজ প্রশ্নের মুখে পড়ে বৈকি!
গতবছর পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনের মুখে নারদ নিউজের কর্তা ম্যাথু স্যামুয়েলের ভিডিও টেপ হইচই ফেলে দিয়েছিল৷ শোভন চট্টোপাধ্যায়, ফিরহাদ হাকিম, সৌগত রায়, মদন মিত্রদের টাকা নিতে দেখা গিয়েছিল ওই ভিডিওয়৷ নির্বাচনের মুখে মরিয়া মমতা নারদের স্টিং অপারেশনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন৷ দাবি করেছিলেন, ওই ভিডিও জাল৷ বিধানসভা ভোটের ফল প্রমাণ করেছে, তৃণমূল নেত্রীর দাবিকে বিশ্বাস করেছে মানুষ৷ সব আসনে তিনিই প্রার্থী, মমতার এই ডাকে জনতা সাড়া দেওয়ায় বোঝা গিয়েছে, এখনও তাঁর দুর্নীতিমুক্ত রাজনীতিকের ভাবমূর্তি অটুট৷
কিন্তু নারদ টেপের ফরেনসিক রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসতেই সরগরম রাজনীতির মঞ্চ৷ ফরেনসিক পরীক্ষায় ভিডিওর সত্যতা প্রমাণিত হওয়ায় ভোটের মুখে মমতার দাবির অসারত্ব প্রমাণিত হয়েছে৷ নারদ মামলার তদন্তভার হাইকোর্ট সিবিআই-এর হাতে দিয়েছিল৷ সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে আর্জি জানায় পশ্চিমবঙ্গ সরকার৷ সে জন্য ভারতের প্রধান বিচারপতি জে এস কেহর পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সমালোচনা করে বলেছেন, ‘‘রাজ্য যেভাবে সমস্ত যুক্তির সীমা লঙ্ঘন করেছে, তাতে আমরা স্তম্ভিত৷ যে বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে, তা দুর্ভাগ্যজনক ও প্রত্যাখ্যানের উপযুক্ত৷''
নারদ মামলা এখন সিবিআই-এর হাতে৷ ইতিমধ্যে উত্তরপ্রদেশে বিজেপি বিপুল জয় পাওয়ায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর হাত শক্ত হয়েছে৷ ভারত সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন সিবিআই এবার নারদ তদন্তের গতি বাড়াবে বলে অনেকে মনে করছেন৷ এই গোয়েন্দা সংস্থাটিকে দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতাসীন দল বিরোধীদের শায়েস্তা করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে বলে বারবার অভিযোগ উঠেছে৷ কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট নারদ মামলায় রাজ্য সরকারকে তিরস্কার করায় সেই বিতর্কের বদলে এখন মমতার চ্যালেঞ্জই মূল প্রতিপাদ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে৷
নারদ কাণ্ডের আগেও বিভিন্ন চিটফান্ড মামলায় তৃণমূল নেতাদের নাম জড়িয়েছে৷ সারদা কাণ্ডে গ্রেফতার হয়েছেন দলের সাংসদ কুণাল ঘোষ৷ দীর্ঘদিন জেল খেটেছেন প্রাক্তন মন্ত্রী মদন মিত্র৷ তৃণমূলের প্রাক্তন সাংসদ সৃঞ্জয় বসুও বন্দি ছিলেন৷ জেরা করা হয়েছে সাংসদ শতাব্দী রায়, আহমেদ হাসানদের৷ এমনকি তলব করা হয়েছিল প্রাক্তন সাংসদ চিত্রতারকা
মিঠুন চক্রবর্তীকেও৷ রোজভ্যালি মামলায় তৃণমূলের লোকসভার দলনেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ওড়িশার জেলে বন্দি৷ তাঁর সঙ্গেই আছেন আরেক সাংসদ তাপস পাল৷ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ চিটফান্ড মামলার তদন্ত করছে সিবিআই৷ শোনা যাচ্ছে, নারদ থেকে সারদা বিভিন্ন অভিযোগের তদন্তে তৃণমূলের আরও কয়েকজন নেতা-মন্ত্রী-সাংসদকে তলব করতে পারে সিবিআই৷ তাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিযোগ করেছেন, কেন্দ্র প্রতিহিংসার রাজনীতি করছে৷
তৃণমূল ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠছে দেখে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে৷ মানুষ এ সবের জবাব দেবে৷ সারদা চিটফান্ড নিয়ে আইনি লড়াই করে যিনি তৃণমূলকে নাস্তানাবুদ করছেন, পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার সেই বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নানের মন্তব্য, ‘‘টাকা দলের না নিজের প্রয়োজনে নেওয়া হয়েছে, তার জবাব কে দেবে? চোখে যা দেখা যাচ্ছে, তাতে ষড়যন্ত্র না খুঁজে মুখ্যমন্ত্রী অভিযুক্তদের পদ ছাড়তে বলুন৷ তা হলে বোঝা যাবে, উনি সততার জন্য লড়াই করেন৷'' তবে তৃণমূল কংগ্রেস আত্মবিশ্বাসী, নেত্রীর প্রতি জনতার আস্থা অটুট থাকবে৷ তৃণমূল নেতা নির্বেদ রায়ের মতে, ‘‘সব মানুষকে চিরকাল বোকা বানিয়ে রাখা যায় না৷ কিছু মানুষকে বোকা বানানো যেতে পারে, সেটা গত বিধানসভা ভোটেই প্রমাণিত হয়ে গেছে৷ দেশের কোনো মূখ্যমন্ত্রী এমন সাদামাটা জীবনযাপন করেন না, এটা মানুষ জানে৷''
কিন্তু শুধু কি নারদ বা সারদা-রোজ ভ্যালি? আরও দুর্নীতির কাঁটা বিঁধছে পশ্চিমবঙ্গের শাসকদলকে৷ এর মধ্যে অন্যতম স্কুলশিক্ষক নিয়োগ কেলেঙ্কারি৷ অভিযোগ, তৃণমূল নেতাদের উৎকোচ দিয়ে যোগ্য প্রার্থীদের বঞ্চিত করে অনেকে চাকরি হাতিয়ে নিয়েছে৷ এজন্য লেনদেন হয়েছে লক্ষ লক্ষ টাকা৷ আঙুল উঠেছে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের দিকে৷ যদিও তিনি বলেছেন, ‘‘যোগ্যতার ভিত্তিতেই নিয়োগ করা হয়েছে চাকরিপ্রার্থীদের৷''
একদিকে দুর্নীতির অভিযোগে জড়িয়ে পড়া এতগুলি নাম, আর অন্যদিকে নিষ্কলুষ মমতা৷ তৃণমূল নেত্রীর পক্ষে এত অভিযোগের বোঝা বহন করে সরকার চালানো কি কঠিন হয়ে পড়ছে না? এত জনের ঢাল হয়ে একা কুম্ভ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী৷ উল্টোদিকে রাজ্যে রাজনৈতিক জমি খুঁজতে মরিয়া মোদী অ্যান্ড কোং৷ তারা ইতিমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গে ক্ষয়িষ্ণু বাম ও বিলীয়মান কংগ্রসের হারানো জমির দখল নিতে ব্লু-প্রিন্ট তৈরি করে ফেলেছে৷ বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহের রাজনৈতিক আগ্রাসনের ধার বাড়াতে সিবিআইকে ব্যবহার করা হবে বলে অনেকের ধারণা৷ এই পরিস্থিতিতে আগামী কয়েক মাসে মোদী-শাহের জোড়া ফলার আক্রমণ সামলাতে মমতা কী কৌশল নেন, সেদিকে নজর থাকবে৷ নেত্রীর এক টাকার মাসিক বেতন ও সাদামাটা জীবনযাত্রা তাঁর সহযোগীদের দুর্নীতির অভিযোগের মোকাবিলায় আবারও কাজে আসবে কিনা, তার জবাব দেবে সময়৷
বিরোধীদের আক্রমণ, সিবিআই তদন্ত, আদালতের সমালোচনার ত্রিফলার মুখে পড়ে তৃণমূল নেত্রী কৌশল বদল করেছেন৷ নারদ ভিডিও টেপের সত্যতা প্রমাণিত হওয়ায় মমতা ষড়যন্ত্রের পাল্টা অভিযোগ তুলছেন৷ তিনি জোর দিচ্ছেন এই তত্ত্বে, সব রাজনৈতিক দল টাকা নিলে তৃণমূল কী দোষ করল? যদিও এই মুহূর্তে অন্য কোনও দলের টাকা নেওয়ার ছবি প্রকাশ্যে আসেনি৷ আর সুপ্রিম কোর্ট তৃণমূলের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগটিই এই সময় খতিয়ে দেখছে৷
গোদের ওপর বিষফোঁড়া তৃণমূলেরই সাংসদ কে ডি সিং৷ ম্যাথু স্যামুয়েল দাবি করেছেন, কে ডি-র পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি নারদ নিউজের হয়ে স্টিং অপারেশন চালিয়েছেন৷ ইনিই হচ্ছেন সেই কুনওয়ারদীপ সিং, যাঁর সংস্থা অ্যালকেমিস্টের বিরুদ্ধেও গরিবের টাকা নয়ছয় করার অভিযোগ উঠেছে৷ প্রশ্ন উঠেছে, এমন অভিযুক্ত একজন ব্যক্তিকে কেন ঝাড়খণ্ড থেকে রাজ্যসভায় পাঠালেন মমতা? সর্ষের মধ্যেই যখন এই কে ডি-র মতো ভূত, তখন মমতার কাছে দুর্নীতির অভিযোগের মোকাবিলা কঠিন হয়ে ওঠাই স্বাভাবিক৷ সাধে কি তিনি বলেছেন, এই পাঞ্জাবতনয়কে দলে নেওয়া তাঁর ‘ব্লান্ডার'!