‘সহিংসতা নারীর ওপর কর্তৃত্ব রাখার হাতিয়ার'
৮ মার্চ ২০১৯ডয়চে ভেলে: মিস. শোয়ার্সার, আমরা এ বছর নারীদের ভোটাধিকার পাবার ১০০তম বছর পূর্ণ করেছি৷ আমরা যদি সত্তরের দশকের শুরুর দিক থেকে দেখি, সে সময় নারীর অধিকার নিয়ে আপনি প্রচুর কাজ করেছেন এবং সফলও হয়েছেন, যার সুফল ভোগ করছে ‘আজকের' নারীরা৷ ২০১৯ সালে এসে যদি তার মূল্যায়ন করেন, তাহলে আপনার কী মনে হয়, আপনি কি আপনার লক্ষ্য অর্জন করতে পেরেছেন?
অ্যালিস শোয়ার্সার: গবেষণায় দেখা গেছে, পুরুষতান্ত্রিকতার বয়স কমপক্ষে ৪,০০০ বছর, সে হিসেবে ৪০ বছরের লড়াই সেই সমাজকে পরিবর্তন বা উত্তরণের জন্য যথেষ্ট নয়৷ তবে এ লড়াইয়ের সময়টা যদি একজনের জীবনকাল হয়, তাহলে বলতেই হবে নারীর অবশ্যই অনেক অগ্রগতি হয়েছে৷ আমরা সত্যিই অত্যন্ত দ্রুতগতিতে এগিয়েছি৷ তাত্ত্বিকভাবে জার্মানিতেই শুধু নয়, পশ্চিমাবিশ্বের অনেক দেশই নারীর জন্য আইনি সমতা, শিক্ষার সুযোগ ও সব ধরনের পেশায় যাবার সুযোগ তৈরি করেছে৷ আর আপনি নিশ্চয়ই জানেন, জার্মানিতে একজন (নারী) চ্যান্সেলর আছেন ১৩ বছর ধরে৷
সমাজেও নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে, যদিও তাতে তা (সহিংসতা) সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়নি৷ এটা একটা বড় সমস্যা৷ সহিংসতা কর্তৃত্ব বজায় রাখার কঠিন হাতিয়ার, কিন্তু তা গ্রহণযোগ্য নয়৷ এছাড়া সময়ের সাথে সাথে নতুন নতুন সংকটও তৈরি হচ্ছে৷ যেমন, পর্নোগ্রাফি ভয়ানকভাবে বেড়েছে৷ বিতর্ক চলছে নারীর শরীর নিয়েও৷ একদিকে যেমন ইসলাম প্রধান দেশগুলোতে নারী শরীর ঢেকে রাখতে বলা হয়, অন্যদিকে, পশ্চিমাবিশ্বে নারী খোলাখুলিভাবে নিজেকে প্রকাশ করবে, সেটাই কাঙ্খিত৷ কিন্তু আমার মনে হয়, এর কোনোটাই সমাধান নয়৷ তবে এটাই সত্যি যে, সেসব ইসলামি দেশগুলোর তুলনায় ইউরোপ নারীদের জন্য হয়ত এক কথায় স্বর্গ৷
মিস শোয়ার্সার, আপনি যদিও আগেই সতর্ক করেছিলেন যে সেসব দেশে এমন পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে৷ কিন্তু তাতে কিছু বদলায়নি৷ আপনার শঙ্কাগুলো কী ছিল বলবেন?
আমি গত ৪০ বছর ধরে ‘এমা' (জার্মানির অন্যতম নারীবাদী পত্রিকা) নামে একটি পত্রিকায়, যার শুরুটা আমার হাত ধরেই হয়, সে সমস্ত দেশের নারীদের কথা লিখে চলেছি৷ সেখানকার অনেক নারীর সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল, আছে৷ এমনকি এখনও মতবিনিময় হয়ে থাকে৷ কিন্তু আমার অস্থির লাগে যখন তাদের অবস্থা দেখি৷ যেমন ইরানে (নারীর প্রতি) সহিংসতায় কোনো রাখঢাক নেই৷ আর আফগানিস্তানে আমি বুঝি না অ্যামেরিকা কেন সেখানে যুদ্ধ করতে গিয়েছিল, যেখানে এখন তারাই আবার তালিবানদের সঙ্গে হাত মেলাতে চাইছে৷ এই শান্তি আলোচনা ভন্ডামি ছাড়া আর কিছু নয়৷ যে আলোচনা চলছে, তা নারীর জন্য শান্তি নয়, নরক৷ আমার মনে হয়, পশ্চিমাবিশ্বের এবার একটি ভিন্ন অবস্থান তৈরি করা উচিত৷ যেমন একটা উদাহরণ দিই: কয়েক দশক আগে পুরো পশ্চিমাবিশ্ব দক্ষিণ আফ্রিকাকে বর্ণবাদের জন্য বয়কট করে৷ কারণ, কালোদের সঙ্গে সেখানে পশুর মতো বা তার চেয়েও বাজে আচরণ করত৷ তারা বলে যে, আমরা আজ তাদের বয়কট করলে কাল পরিবর্তন আসবে৷ আর এই আন্তর্জাতিক বয়কট, বিশেষ করে অর্থনৈতিক বয়কট, সফল হয়েছে৷ তাহলে আজ কেন আমরা সে সমস্ত দেশকে বয়কট করি না যেখানে নারীর সঙ্গে পশু বা তার চেয়েও খারাপ আচরণ করা হয়?
গত ১৭ বছরে আফগানিস্তানের পরিস্থিতি, বিশেষ করে দেশটির অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে, পশ্চিমা দেশগুলোর কল্যাণেই৷ তবে যুদ্ধ ও সহিংসতায় প্রাণও হারিয়েছেন অনেক মানুষ৷ কিন্তু সবসময় সমাজে বা এমনকি জার্মান গণমাধ্যমে ভালো দিকগুলো আলোচিত হয়৷ খারাপ দিকগুলো, বিশেষ করে নারীদের অধিকার নিয়ে কোনো কথা হয় না৷ কেন?
ঠিক৷ আমার মনে হয়, এর মূল কারণ ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক৷ একদিকে দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য চলছে, যুদ্ধ হচ্ছে, আবার যুদ্ধের পর পুনর্গঠনের কাজও চলছে৷ এতে অর্থনৈতিকভাবে দেশগুলো দাঁড়াতে পারছে না৷ আর সঙ্গে সঙ্গে অবদমন করা হচ্ছে নারী, সমালোচক ও বুদ্ধিজীবীদের অধিকারও৷
জার্মানিতে ফেরা যাক৷ বর্তমানে লাখো মুসলিম নারী বাস করেন এ দেশে৷ তাদের মধ্যেও কিন্তু হিজাব পরা নারীর সংখ্যা বাড়ছে৷
জার্মানির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিন্তু একটি জরিপে বলছে, প্রতি চারজনের তিনজন মুসলিম নারী হিজাব করেন না৷ এমনকি প্রতি দু'জনের একজন, যারা নিজেদের খুব ধার্মিক বলে পরিচয় দেন, তারাও বিশেষ হিজাব করতে দেখা যায় না৷
এটা সত্যিই বিস্ময়কর যে, পশ্চিমা দেশগুলোর অনেক বুদ্ধিজীবী, বিশেষ করে বামপন্থিরা, প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিমদের প্রতি সহনশীল এবং এটাকে বড় বিষয় মনে করছেন না৷
আমি সেসব সংখ্যালঘুদের একজন যারা দশকের পর দশক ধরে এর প্রতিবাদ করে আসছি৷ কিন্তু এর উত্তরে কী পেয়েছি? তারা আমাকে ‘বর্ণবাদী' ও ‘ইসলামবিদ্বেষী' বলছেন৷ কিন্তু আমার মতে, ওরাই বর্ণবাদী, কারণ ইসলামি সমাজের একটি বড় অংশকে বাদ দিচ্ছেন তারা৷ তারা দেখতে পান না যে, হিজাব পরার মধ্যে আর স্বতঃস্ফূর্ততা ব্যাপারটি নেই৷ অনেক দেশেই, বিশেষ করে আফগানিস্তান ও ইরানে এটা মেয়েদের জোর করে পরানো হয়৷ আমাদের দেশের মেয়েরা হেডস্কার্ফ পরা বাদ দিয়ে বরং যদি তা খুলে ফেলেন তাহলেই জোরজবরদস্তির শিকার সেই মেয়েদের প্রতি সংহতি জানানো হবে৷
আপনার নতুন বই ‘মাই আলজেরিয়ান ফ্যামিলি'-তে আপনি একটি পরিবারকে দেখিয়েছেন যাদের একটি অংশ ধার্মিক ও অন্যরা নন৷ এমন একটি বিষয় এ সময়ে কেন বাছাই করলেন?
ঠিক সেটাই তো আমি দেখাতে চেয়েছি: সব মুসলিম নারী হিজাব পরেন না, সব মুসলিম পুরুষ জঙ্গি ও নারীবিদ্বেষী নন৷ এরা আমাদের প্রতিবেশী, আমাদের মতোই সাধারণ মানুষ৷ কিন্তু আলজেরিয়ায় থাকার কারণে এদের কেউ কেউ মৌলবাদীদের হুমকির শিকারও হন৷ এই মৌলবাদীদের প্রথম শিকার আমরা পশ্চিমারা নই৷ বরং মুসলিমরা নিজেরাই৷
আমি দেখাতে চেয়েছি যে, আফগানিস্তানের মতো এদেশটির মানুষও ঐতিহ্য বনাম অগ্রগতি প্রসঙ্গে দ্বিধাবিভক্ত৷
আলজেরিয়া ও আফগানিস্তান দু'টি দেশেই যুগ যুগ ধরে পুরুষতান্ত্রিকতা রয়েছে, যা মৌলবাদকে আরো উস্কে দিচ্ছে৷
এই দুইয়ের মিশ্রণ হতাশাজনক এবং এটা যেন সমাজে বিস্ফোরকের কাজ করছে৷ আমি মনে করি, সমাজ পরিবর্তনের জন্য আমাদের এ সব দেশের উদার ও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করা উচিত৷
জার্মানিতে বহু মুসলিমই মৌলবাদের শিকার৷ অনেক মায়েরাই যারা তাদের সন্তানদের চোখের সামনে উগ্রবাদে জড়িয়ে পরতে দেখেছেন৷ এখানকার রাজনীতি কি তাদের সহায়তার জন্য যথেষ্ট কার্যকর নীতি গ্রহণ করতে পেরেছে?
না৷ রাজনীতি এক্ষেত্রে পুরোপুরি ব্যর্থ৷ প্রথম ভুলটি হলো, নতুন অভিবাসীদের এখানে সাংস্কৃতিকভাবেই ‘ভিন্ন' বলে ধরে নেয়া হয়েছে৷ ভিন্ন সংস্কৃতি ও ধর্মের নামে আসলে দু'টি মানদণ্ড তৈরি করা হয়েছে৷ এটা এক ধরনের ভুল সহনশীলতা৷ আমার মতে, মানবাধিকার, আইনের শাসন ও লিঙ্গ সমতা সবার জন্য প্রযোজ্য, তা তিনি যে সংস্কৃতি বা ধর্মেরই হোন না কেন৷
নব্বইয়ের গোড়ার দিকে জার্মানিসহ গোটা পশ্চিমাবিশ্বেই ইসলামকে কেন্দ্র করে একটি উত্তেজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়৷ এর পৃষ্ঠপোষকতায় ছিল সৌদি আরব, তুরস্ক ও ইরান৷ সে সময় থেকেই বিভিন্ন দেশে তারা ইমামদের, হিংসার বার্তাবাহকদের পাঠাতে শুরু করে৷ এরাই বিভিন্ন সমাজে গিয়ে মৌলবাদ ছড়াতে শুরু করেন৷
‘প্রপাগান্ডা' দিয়ে পথভ্রষ্ট করা শুরু করে পুরুষদের৷ এই প্রপাগান্ডার বিরোধিতা কিন্তু তখন আমরা জার্মানরা করিনি৷ আর আমরা তাদের বলিনি যে, আপনি এখন একটা গণতান্ত্রিক দেশে বাস করছেন, এবং আপনার সবকিছু শেখার সুযোগ আছে৷ বলিনি যে আপনাকে জার্মানির অংশ হয়ে উঠতে হবে, জার্মান ভাষা জানতে হবে, এবং আপনি যদি যোগ্য হন, আপনাকে চাকরিও দেয়া হবে৷
আমরা মেয়েদের গিয়েও বলিনি: আপনার জার্মান বন্ধুদের মতো আপনারাও এখানে মুক্ত স্বাধীন৷ আপনারা স্বাধীনভাবে বাঁচুন, আমরা আপনাদের সাহায্য করবো৷ আপনাকে কেউ বাধা দিলে আমরা প্রতিরোধ করবো৷ এর কোনো কিছুই আমরা করতে পারিনি৷
এর ফলে এখানে শুধু সমান্তরাল সমাজই তৈরি হয়নি, এমা পত্রিকার এক জার্মান-তুর্কি লেখকের মতে, এখানে একটি বিপরীতমুখী সমাজও তৈরি হয়েছে৷ এমন এক সমাজ যা অন্য নিয়মে চলে এবং শেষ পর্যন্ত আমাদেরই ক্ষতি করছে৷
মিস শোয়ার্সার, আপনি জানেন আমি আফগানিস্তান থেকে এসেছি এবং এখানে ৩৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে আছি৷
আমি যখন ছোট ছিলাম তখন আফগানিস্তানকে ভিন্নভাবে দেখেছি৷ নারীদের অধিকার সম্পর্কে হয়ত অতটা সোচ্চার ছিল না, কিন্তু অন্তত শহরের নারীরা স্কুলে যেতে পারতেন এবং অবশ্যই পড়াশোনা শেষ করতেন৷ সে সময় হিজাব করা বাধ্যতামূলক ছিল না, ফ্যাশনেবল ও রঙিন পোশাক এমনকি মিনিস্কার্টও হরহামেশা রাস্তায় দেখা যেত৷ বিশেষ করে আমাদের প্রজন্মে মেয়েদের মধ্যে একটা শক্তিশালী আত্মনির্ভরশীলতা গড়ে উঠেচিল৷ কিন্তু এরপর প্রায় ৪০ বছরের যুদ্ধে নারীরা তাদের অধিকার হারিয়েছেন৷ ‘বিশ্ব নারী দিবস' উপলক্ষ্যে আপনার কাছে আমার প্রশ্ন: আফগানিস্তানের নারীরা তাদের অবস্থার উন্নয়নে কী করতে পারেন? আপনি এর কি কোনো চমৎকার উদাহরণ দিতে পারেন?
আমার জন্য বলা ঔদ্ধত্যপূর্ণ হয়ে যাবে আফগানিস্তানের মেয়েদের এখন করণীয় কী বা কতটা কী তারা করতে পারেন৷
আমি এমন একটা সময়ে এ কাজ শুরু করি, যখন এ কাজের জন্য বাহবা পাওয়া যেত না৷ আজও আমার অনেক নারী ও পুরুষ প্রতিদ্বন্দ্বী রয়েছেন৷ তারা কিন্তু বলেন না যে, অ্যালিস শোয়ার্সার যা বলেন তা ভুল, তারা আমাকে রীতিমত অপমান করেন৷ আমার প্রতিপক্ষে কে তা আমি জানি৷ তবে আমি সমান অধিকার নিয়ে কথা বলি বলে আমার নিজের জীবনে কোনো ঝুঁকি আছে কিনা, তা বলতে পারব না৷ কিন্তু আপনার দেশে সন্ত্রাস একটা সমস্যা৷ একটা নগ্ন হাতিয়ার৷ এক্ষেত্রে পশ্চিমাবিশ্বের অবশ্যই কিছু করার আছে৷ আমি আমার কাজ করে যাচ্ছি৷ আমি সাংবাদিক৷ আমি পত্রিকা চালু করেছি এবং তার ফলেই আজ আমি এখানে৷ ইসলামি দেশগুলোর নারীরা চাইলেই আমাদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে পারেন৷ আমরা তাদের পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করি এবং যথাসাধ্য চেষ্টা করি সাহায্য করতে৷ এর বাইরে আমি এইটুকুই বলতে পারি, আফগান মেয়েদের সাহস হারালে হবে না৷ অন্তত এটাই আমার আশা এবং সেরকমটা হলে আমি সত্যিই খুশি হব৷
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ৷