নারী অধিকার
২৪ ডিসেম্বর ২০১১‘‘ধর্ষিত হবার পর ওর অবস্থা দেখে আমার যে অনুভূতি হয়েছিল, তা এখনও আমি মনে করতে পারি৷'' বলেন নাজনিনের মা৷ ৯ বছরের এই মেয়েটি ধর্ষণের এক শিকার, আফগানিস্তানে অসংখ্য ধর্ষণের ঘটনার মধ্যে একটি৷ ‘‘আমি সরকারের কাছে আবেদন করছি, তাদের শাস্তি দেওয়ার জন্য৷'' অসহায় আবেদন মায়ের৷
বাবা মারা যাওয়ার সময় নাজনিনের বয়স ছিল দুই৷ মা কিছুদিনের মধ্যে আবার বিয়ে করেন৷ দুই সত্চাচা নাজানিনকে ধর্ষণ ও অত্যাচার শুরু করে৷ এ সব কথা সে যেন কাউকে না বলে সে জন্য তার গায়ে মাঝে মাঝে গরম তেলও ঢেল দিত তারা৷
শঙ্কাজনক উঁচু সংখ্যা
নাজনিন দেশটির অসংখ্য মেয়ের একজন, যাদের জীবন এইভাবে বিপন্ন৷ আফগানিস্তানের স্বাধীন মানবাধিকার কমিশনের তথ্য অনুযায়ী দেশটিতে নারীদের প্রতি সহিংসতার হার রীতিমত উদ্বেগজনক৷ ২০০৯ সালে এই সংখ্যা ছিল ২২০৬, ২০১০ সালে ২৭৬৫, ২০১১ সালে ২৪৩৩৷
নারী অধিকার কর্মসূচির সমন্বয়কারী লতিফা সুলতানি বলেন,‘‘নিরাপত্তাহীন অবস্থার কারণে মেয়েরা নির্যাতিত এক শ্রেণিতে পরিণত হয়েছে৷'' সুলতানি আইন প্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলির দুর্বলতা ও অপরাধীদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা না নেয়ার কঠোর সমালোচনা করেন তিনি, যার ফলে এই ধরনের সমস্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে৷
আফগানিস্তানের নারীবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী পালওয়াশা কাকার বলেন, নাজনিনের ঘটনাটি বিচ্ছিন্ন কোনো বিষয় না হলেও প্রচারমাধ্যমগুলি চাঞ্চল্যকর ঘটনার ওপর বিশেষ জোর দেয়৷ তাঁর মতে, তালেবানি সময়ের চেয়ে আফগানিস্তানের মেয়েদের অবস্থার এখন ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে৷ তবে নারীদের অবস্থার উন্নয়নের ক্ষেত্রে এখনও কিছু কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে৷ নারী বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কোনো কার্যনির্বাহী ক্ষমতা নেই, খেদ প্রকাশ করে বলেন উপমন্ত্রী কাকার৷
জার্মানিতে পারিবারিক সহিংসতা
নিরক্ষরতা, নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতার অভাব ও আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের দুর্বলতা আফগানিস্তানে পারিবারিক সহিংসতার মূল কারণ বলে মনে করা হয়৷ তবে জার্মানির মত উন্নত দেশগুলিতেও মেয়েরা অনেক সময় অবমাননা ও নির্যাতনের শিকার হন৷ বার্লিনস্থ পারিবারিক সহিংসতা রোধ বিআইজির মুখপাত্র জেনিফার রোটার জানান, প্রতি চারজনে একজন মেয়ে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হন৷ নারীদের প্রতি সহিংসতার প্রধান কারণ বেকারত্ব ও সামাজিক ভাতার ওপর নির্ভরশীল এক জীবন৷
৪৫ বছরের বেশি বয়স্ক মেয়েদের মধ্যে যারা স্বামীর চেয়ে ভাল উপার্জন করেন, তাদের পারিবারিক সহিংসতার শিকার হওয়ার আশঙ্কা বেশি৷ এর সঙ্গে যুক্ত হয় মদাসক্তি ও শিক্ষার অভাব৷ বলেন জেনিফার রোটার৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘পারিবারিক সহিংসতা সব শ্রেণিতে ও সামাজিক পরিস্থিতিতে লক্ষ করা যায়৷'' ইউরোপের ১২ থেকে ১৪ শতাংশ মেয়ে পারিবারিক সহিংসতার শিকার৷ তবে উন্নয়নশীল দেশগুলির তুলনায় জার্মানি ও উন্নত দেশের নির্যাতিত মেয়ে ও শিশুরা সরকারি উদ্যোগে নিরাপদ আশ্রয় ও পরামর্শ পেতে পারেন৷ স্বামী বা পুরুষ সঙ্গীর অত্যাচারের শিকার মেয়েরা পুলিশের কাছে অভিযোগ পেশ করতে পারেন৷ সেটা শারীরিক, মানসিক বা আর্থিক যাই হোক না কেন৷
আফগান সরকারও এখন নারীর নিরাপত্তার জন্য আইনকানুনের উন্নতি ঘটাচ্ছে৷ এ প্রসঙ্গে উপমন্ত্রী কাকার বলেন, ‘‘যেমন নিরক্ষরতার হার কমানোর জন্য শিক্ষা কর্মসূচির উন্নয়ন এবং নারী পুরুষের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নানা ওয়ার্কশপের আয়োজন করা হচ্ছে৷'' মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি পেলে পারিবারিক সহিংসতাও হ্রাস পাবে৷
মেয়েদের জন্য এখন নানা ক্ষেত্রে প্রবেশের পথ উন্মুক্ত হচ্ছে, যেমন পৌর সংস্থা ও স্বাধীন কমিশনে অংশ নিতে পারছেন মেয়েরা৷ এ ছাড়া প্রচার মাধ্যমে যোগ দেয়া সহজ হয়েছে তাদের পক্ষে৷ কার্যকর হয়েছে বিচার বিভাগ৷ এসব কিছু পারিবারিক সহিংসতার হার কমাতে সাহায্য করছে৷ বলেন কাকার৷ পরিবারের সদস্যদের দ্বারা প্রহৃত হলে মেয়েরা এখন নিরাপদ আশ্রয়স্থলে যেতে পারেন৷
দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক
আফগানিস্তানের নারী অধিকার রক্ষায় তত্পর বেসরকারি সংস্থা আফগানিস্তান উইমেন কাউন্সিলের মতে, ‘‘যে সব রাষ্ট্র পারিবারিক সহিংসতা রোধে ও নারী অধিকার রক্ষায় ব্যর্থ, তারা মেয়েদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক মনে করে এবং বিষয়টি নিয়ে সমাজের কোনো মাথা ব্যথার প্রয়োজন নেই, এটাই বোঝাতে চায়৷''
সংস্থা আরো জানায়, পারিবারিক সহিংসতা জাতি, ধর্ম, বয়স, সামাজিক ও আর্থিক অবস্থান নির্বিশেষে সব ক্ষেত্রেই দেখা দিতে পারে৷ এ ব্যাপারে জেনিফার রোটার একমত পোষণ করে বলেন, ‘‘আর্থিক ও সামাজিক পরিস্থিতির চাপে সহিংসতার প্রকাশ ঘটলেও এটাই যে মূল কারণ তা বলা যায়না৷ নারী পুরুষ জুটির মধ্যে সামঞ্জস্য না থাকলে এই রকমটি ঘটতে পারে৷''
প্রতিবেদন: তামানা জামিলি/ রায়হানা বেগম
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক