সাংবাদিকতা: স্বপ্ন ও বাস্তবতা
৮ নভেম্বর ২০১৯সাথে ক্যামেরা, ট্রাইপড৷ অফিসের কাছাকাছি সড়কেই রাস্তা অবরোধ করেছে দুইটি স্কুলের শিক্ষার্থীরা৷ মিডিয়ার গাড়ি দেখে আন্দোলনকারীদের কয়েকজন ছেড়ে দিতে চাইল, কিন্তু বেশিরভাগই রাজি নয়৷ একজন এসে বলল, ‘‘এরা সাংবাদিক নামের দালাল, এদের ছাড়া যাবে না৷'' সাংবাদিকতা করতে গিয়ে এমন গালমন্দ শুনতে হয় প্রায়ই কিন্তু তাই বলে এই স্কুল শিক্ষার্থীরাও! সেদিন সাংবাদিক পরিচয়ে তাদের সামনে ভীষণ বিব্রতবোধ করেছিলাম৷
দেড় যুগের বেশি সময় পর সার্টিফিকেট সংক্রান্ত কাজে হাজির হয়েছি নিজের স্কুলে৷ পুরাতন একজন শিক্ষককে পেয়ে গেলাম৷ পরিচয় দেয়ার পর জানতে চাইলেন কী করছি৷ জবাব দিলাম, সাংবাদিকতা৷ কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে বললেন, ‘‘এটাতো এখন একটা ব্যবসা''৷
উপরের এই দুটি ঘটনাই নয় প্রতিবেদক হিসেবে মাঠে যারা সাংবাদিকতা করেন এমন অভিজ্ঞতা এখন সবারই হয় কমবেশি৷ দিন যত যাচ্ছে মূল ধারার গণমাধ্যমগুলো নিয়ে অডিয়েন্সের নেতিবাচক ধারণা ততই প্রকট হচ্ছে৷ কিন্তু কেন? আজ থেকে ১০-১৫ বছর আগেও সাংবাদিকতা নিয়ে মানুষের ধারণা কি এতটা খারাপ ছিল? নিরাপত্তাহীনতা, চাকুরির অনিশ্চয়তা, অনিয়মিত বেতন এমন বিষয়গুলোতো আগেও ছিল, সেই সঙ্গে সাংবাদিকতা আর সাংবাদিকদের প্রতি মানুষের বিস্ময়মিশ্রিত শ্রদ্ধাবোধওতো ছিল৷
বিশ্ববিদ্যালয় পড়াকালীন সময়ের কথাই না হয় ধরা যাক৷ বাবা-মার অনীহা সত্ত্বেও ভর্তি হলাম গণযোগযাোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে৷ তখন দেশে নতুন করে বেসরকারি টিভি চ্যানেল আসতে শুরু করেছে৷ সাংবাদিকতায় যুক্ত হয়েছে গ্ল্যামার৷ নাটক সিনেমার তারকাদের মত সাংবাদিকদেরও নাম ধরে মানুষ চিনতে শুরু করেছে৷ সেসময় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যারা পড়তে আসে তাদের উপর এর প্রভাব পড়ে৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খ ইউনিটের অধীনে যেসব বিভাগ আছে তার মধ্যে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা যেখানে আগ্রহের তালিকায় পাঁচ-ছয়ে ছিল, সেটি এক-দুই বছরের মধ্যেই দুই-তিনে উঠে আসল৷ বেতন যাই হোক সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন, টেলিভিশন কিংবা অনলাইন, সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থীরা চাইলেই পার্ট টাইম, এমনকি ফুল টাইম চাকুরিও জুটিয়ে ফেলতে পারে, শিক্ষার্থী থাকা অবস্থাতেই৷
২০১১-১২ সাল তৃতীয় ধাপে নতুন করে আরো কিছু টেলিভিশন চ্যানেলের যাত্রা শুরু হল৷ মাস্টার্সের পাঠ চুকানোর আগেই তার একটিতে যোগ দেয়ার সুযোগ মিলল৷ প্রযুক্তির ঘোর কাটতে না কাটতেই চলে গেল এক-দুই বছর৷ পরিস্থিতিও দ্রুত বদলাতে শুরু করল৷ ক্রমশ নতুন টিভি চ্যানেল আসে৷ তার সাথে ধীরে ধীরে সাংবাদিকতার ধারও যেন কমে৷ পড়তে শুরু করে মান, সেই সঙ্গে বাড়তে শুরু করে সংবাদের ফিল্টার৷ যা ঘটে তা যথাযথভাবে তুলে ধরা হয় না৷ অনুসন্ধানী সাংবাদিকেরা যা তুলে আনে তার সব বলা কিংবা দেখানো হয় না৷
সরকারি খবরের গুরুত্ব ক্রমশ বাড়তে থাকে৷ নিউজের প্রথম অংশ ধীরে ধীরে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীরাই দখল করে নেয়, ঠিক যেমনটা বিটিভিতে হয়৷ সরকার বা মালিক; কার পক্ষে, কার বিপক্ষে যাবে তা চিন্তা করে আগে ভাগেই চলে সংবাদের সেলফ সেন্সরশিপ৷ এদিকে পাঠক বা দর্শক আগের চেয়ে আরো বেশি সচেতন৷ গণমাধ্যমে তারা যা দেখতে, শুনতে বা পড়তে চায় তা পায় না৷ তার চোখের সামনে ঘটা বিশেষ বিশেষ ঘটনা সংবাদ ভাষ্যে বদলে যায়৷ যেমনটা বিভিন্ন নির্বাচনের সময় হয়েছে৷
এভাবে পাঠক-দর্শক প্রতারিত বোধ করতে শুরু করে৷ তারা ক্রমশ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নির্ভর হয়ে ওঠে৷ মূল ধারার গণমাধ্যমের উপর আস্থাহীনতার জায়গায় ফেসবুক হয়ে যায় অনেকের সংবাদ ও তথ্যের প্রধান উৎস৷ অবস্থা এমন দাড়িয়েছে যে, কোনো একটি ঘটনায় মূলধারার গণমাধ্যম যতই সত্য তুলে ধরুক মানুষ ফেসবুকের গুজবেই বরং বেশি আস্থা রাখে৷
আমার মতে, নিজস্ব বা বাইরের সেন্সরশিপ, অনুষ্ঠান-সংবাদের নিম্নমান আর ডিজিটাল মাধ্যমের জনপ্রিয়তা মূল ধারার গণমাধ্যমের বাজার হারনোর কারণ৷ যার প্রভাব পড়ে ব্যবসায়ও৷ শুরু হয় বেতন পরিশোধে গড়িমসি আর কর্মী ছাঁটাই৷ যেকারণে দক্ষ ও মেধাবী সাংবাদিকরাও এখন গণমাধ্যম ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন৷ সবচেয়ে বেশি হতাশায় ভুগছেন তরুনরা, যারা ভালবেসে এই পেশায় এসেছেন৷
এই অবস্থা থেকে উত্তরণে ইদানিং বেশ দৌড়-ঝাপ শুরু করেছেন সাংবাদিক সংগঠনগুলোর নেতারা৷ তারা সরকারের কাছে ধরনা দিচ্ছেন, তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেন দরবার করছেন৷ মন্ত্রীও মালিকদের উদ্দেশ্যে বলেছেন ‘‘সাংবাদিকদের বঞ্চিত করবেন না, সময়মতো বেতন পরিশোধ করবেন; যাতে অহেতুক কারও চাকুরচ্যুতি না ঘটে, সে বিষয়েও সতর্ক থাকবেন৷’’ জ্যেষ্ঠ অনেক গণমাধ্যমকর্মী আপ্লুত হয়ে মন্ত্রীর এই বাণী ফেসবুকে শেয়ার দিচ্ছেন৷
কিন্তু এতে কি সমাধান মিলবে? পাঠক-দর্শকদের যে আস্থা গণমাধ্যম খুইয়েছে সেটি কি সরকার ফেরাতে পারবে? সরকার চাইলেও জোর করে কাউকে সংবাদপত্র পড়াতে বা টিভি চ্যানেল দেখাতে পারবে না৷ পরিস্থিতি বদলাতে গণমাধ্যমকর্মীদের তাই ধর্না দেয়া উচিত পাঠক-দর্শকদের কাছেই৷ কীভাবে তাদের আস্থা ফেরানো যায় সেই ভাবনাই এখন জরুরি৷ সেটি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সরকার, প্রশাসনের অসহযোগিতা ও চাপ থাকাটাই বরং স্বাভাবিক৷ এমন পরিস্থিতিতেই শক্তিশালী সাংবাদিকতা হয় তার ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে এশিয়া, লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে৷
দুতার্তের দমনপীড়ন, কারাদণ্ড ভোগেও নুয়ে পড়েননি ফিলিপাইনের সাংবাদিকরা, সহকর্মীদের হত্যা-নির্যাতন দেখার পরও একজোট হয়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করে রাষ্ট্র, প্রশাসনকে নাড়িয়ে দিচ্ছেন মেক্সিকান সাংবাদিকেরা, তুরস্কে এরদোয়ানের একচ্ছত্র ক্ষমতা চর্চার মধ্যেও নতুন নজির গড়ছে সেখানকার ডিজিটাল মিডিয়া, ট্রাম্পের ফেইক নিউজের অপবাদ আর হুমকি থোড়াই কেয়ার করছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাংবাদিকেরা৷ তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে বাংলাদেশের গণমাধ্যম আর সাংবাদিকতাও আবির্ভূত হবে নতুন এক রূপে, এই স্বপ্ন কি বহুদূরে?
প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷