সাইবার আইনে মামলা কমলেও উদ্বেগ আছে
২১ অক্টোবর ২০২৩গত এক মাসে সাইবার নিরাপত্তা আইনে ঢাকায় মামলা হয়েছে ১৪টি৷ এর মধ্যে ১২টি সাইবার ট্রাইব্যুনালে এবং দু'টি মামলা হয়েছে থানায়৷ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যেখানে প্রতিদিন গড়ে ৪টি করে মামলা হতো, বিশ্লেষকেরা বলছেন, এক মাসের চিত্র দেখে এখনই পরিস্কার ধারণা করা কঠিন যে মামলার সংখ্যা তুলনামূলক কম না বেশি হচ্ছে৷ তবে এই আইনের ৪২ ধারা নিয়ে তো এখনও উদ্বেগ রয়ে গেছে৷
প্রথম এক মাসে ঢাকায় যে ১৪টি মামলা হয়েছে তার বেশিরভাগই মানহানি সংক্রান্ত অপরাধের অভিযোগে৷ এছাড়া প্রতারণা ও হ্যাকিং সংক্রান্ত অপরাধের ঘটনায়ও কিছু মামলা হয়েছে৷ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও মানহানি সংক্রান্ত মামলা বেশি হয়েছে৷ প্রতারণার ও হ্যাকিংয়ের ঘটনায়ও অনেক মামলা হয়েছে৷
আগের আইনটি থেকে বর্তমান আইনটিতে কাজ করতে গিয়ে কী পার্থক্য দেখছেন- জানতে চাইলে ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) নজরুল ইসলাম শামীম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘প্রথমত, আমার কাছে যেটা মনে হয়েছে, আগে মামলাগুলো বেশি হতো থানায়৷ এখন মামলা বেশি হচ্ছে আদালতে৷ আবার তদন্ত না করে কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না৷ আগে যেখানে অভিযোগ করলেই কাউকে গ্রেপ্তার করা হতো, এখন সেই অবস্থাটি আর নেই৷ আবার সরকার বা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের মানহানি সংক্রান্ত অনেক বেশি মামলা হতো৷ কারণ একজনের পক্ষে আরেকজন মামলাটি করতে পারতেন৷ এখন যার মামলা তাকেই করতে হয়৷ পাশাপাশি জামিনের সুযোগ থাকা এবং অর্থদণ্ড দিয়ে শাস্তি মওকুফ পাওয়ার সুযোগও আছে৷ ফলে যারা মামলা করতেন তারা অনেক ক্ষেত্রেই আগ্রহ হারিয়েছেন৷’’
বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত করে গত ১৩ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে সাইবার নিরাপত্তা আইন পাস হয়৷ নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইনে করা মামলাগুলো পর্যালোচনায় দেখা গেছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ অন্যান্য ইলেকট্রোনিক মাধ্যমে মানহানিকর তথ্য প্রকাশের অভিযোগে মামলাগুলো করেছেন ভুক্তভোগীরা৷
২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হওয়ার পর থেকে দেশে এই আইনে সাড়ে ৭ হাজারের মতো মামলা হয়েছে৷ সে হিসেবে, প্রতিদিন গড়ে মামলা হয়েছে প্রায় সাড়ে ৪টি৷ সাইবার নিরাপত্তা আইনে সে হিসেবে মামলার সংখ্যা কম৷
গত এক মাসের চিত্র দেখে কী মনে হচ্ছে? সাংবাদিকদের যে উদ্বেগ ছিল সেটা কী আছে? এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) মহাসচিব দীপ আজাদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সাইবার নিরাপত্তা আইনের ৪২ ধারা নিয়ে আমরা তো আপত্তি জানিয়েছিলাম৷ সেটা নিয়ে তো উদ্বেগ আছে৷ তবে আশার কথা এই আইনে এখনও সাংবাদিকদের হয়রানি করা হয়নি৷’’
মামলার সংখ্যাও তো অনেক কমেছে? এটা কী আশার কথা নয়- এর জবাবে জনাব আজাদ বলেন, ‘‘মামলা কমার একটি কারণ আমার মনে হয়, আমরা আইনমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে একটি ধারা যুক্ত করতে অনুরোধ করেছিলাম৷ সেটা তিনি রেখেছেন৷ এই আইনে কেউ মিথ্যা মামলা করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে৷ আমার মনে হয়, মামলার সংখ্যা কমার পেছনে এটি অন্যতম কারণ হতে পারে৷ কারণ যারা ভুয়া মামলা করতেন তারা এখন আর সাহস পাবে না৷ এই দিক দিয়ে আমাদের জন্য খানিকটা হলেও স্বস্তির৷’’
সাইবার নিরাপত্তা আইনের গেজেট প্রকাশের সাত দিনের মাথায় গত ২৫ সেপ্টেম্বর ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালে প্রথম মামলা করেন কেরানীগঞ্জের এক নারী৷ তার অভিযোগ, ফটোশপের মাধ্যমে কেরানীগঞ্জের এক জনপ্রতিনিধির সঙ্গে তার ছবি জুড়ে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা৷ পরে সেই ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে প্রকাশ করে তার সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্য করা হয়েছে৷ আদালত মামলাটি তদন্তের জন্য পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটকে নির্দেশ দিয়েছেন৷ গত ১৩ অক্টোবর পর্যন্ত ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালে যে ১২টি মামলা হয়েছে, তার মধ্যে ৬টির বাদী নারী৷
সাইবার নিরাপত্তা আইন হওয়ার পর গত এক মাসের চিত্র দেখে কী মনে হচ্ছে? জানতে চাইলে সুপ্রীমকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী শাহদীন মালিক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘একটা আইন হওয়ার পর এক মাসের চিত্র দেখে কিছুই বোঝা যাবে না৷ আইনটি বুঝতে পুলিশের সময় লাগে৷ এমনকি আইনজীবীদেরও সময় লাগে৷ এই অবস্থা যদি ৬ মাস পরও দেখা যায়, তাহলে আমরা বিষয়টি ইতিবাচক হিসেবে দেখব৷’’
সামনে নির্বাচন এবং এ কারণে কী সরকার আইনটি প্রয়োগ করার ব্যাপারে একটু বেশি সতর্ক কি না জানতে চাইলে এই আইন বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘‘বিষয়টি আমার কাছে এমন মনে হয় না৷ সরকার যে প্রক্রিয়ায় নির্বাচনটি করতে চায় সেখানে যেই বাধা হয়ে দাঁড়াবে তার বিরুদ্ধে যে ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া দরকার সেটা নেবে৷ এখন সাংবাদিকরা যদি বাধা হয়ে দাঁড়ায় তাহলে এই আইন প্রয়োগের ব্যাপারে সরকার নমনীয় হবে বিষয়টি আমার কাছে এমন মনে হয় না৷’’
প্রসঙ্গত, নিবর্তনমূলক কিছু ধারা ও এর অপব্যবহারের কারণে দেশ-বিদেশে ব্যাপক সমালোচনার মুখে সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন রহিত করে এবং সাইবার নিরাপত্তা আইন নামে নতুন আইন করে৷ তবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিতর্কিত কিছু ধারা সাইবার নিরাপত্তা আইনেও রাখা হয়েছে৷ এ নিয়েও দীর্ঘদিন ধরে সাংবাদিকরা কথা বলছেন৷ এমনকি মানাধিকার কর্মী ও সুশীল সমাজের পক্ষ থেকেও কিছু ধারা নিয়ে আপত্তি তোলা হয়েছে৷ তারা মনে করেন, মানুষের বাকস্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সঙ্গে যেসব ধারা সাংঘর্ষিক সেগুলো বাতিল করা উচিত৷