সাকিব কেন বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় হবেন না?
১০ জুলাই ২০১৯দলের দৌড় অন্তত সে পর্যন্ত না হলে এ টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরষ্কার কারো হাতে ওঠেনি বলেই তো ইতিহাসের সাক্ষ্য!
কিন্তু সেরা চার দলের বাইরের কোনো ক্রিকেটারের সাকিবের মতো পারফরম্যান্সও যে ছিল না! চার সেমিফাইনালিস্ট কেন, অন্য কোনো দলের অন্য কোনো ক্রিকেটারেরও কি ছিল? বিশ্বকাপের প্লেয়ার অব দ্য টুর্নামেন্টের পুরষ্কার পাওয়াদের কীর্তির সঙ্গে সাকিবের এবারের পারফরম্যান্স তুলনা করলে তাঁকে পিছিয়ে রাখার উপায় নেই৷ বেশিরভাগ জায়গায় বরং এগিয়েই বাংলাদেশের সব্যসাচী৷
বিশ্বকাপ ক্রিকেটের প্রথম চার আসরে টুর্নামেন্টসেরা ক্রিকেটারের পুরষ্কারের চল চালু হয়নি৷ শুরু হবার পর এ পুরষ্কার পেয়েছেন নিউজিল্যান্ডের মার্টিন ক্রো (১৯৯২), শ্রীলঙ্কার সনাত্ জয়াসুরিয়া (১৯৯৬), দক্ষিণ আফ্রিকার ল্যান্স ক্লুজনার (১৯৯৯), ভারতের শচীন টেন্ডুলকার (২০০৩), অস্ট্রেলিয়ার গ্লেন ম্যাকগ্রা (২০০৭), ভারতের যুবরাজ সিং (২০১১) ও অস্ট্রেলিয়ার মিচেল স্টার্ক (২০১৫)৷ তাঁদের সঙ্গে পারফরম্যান্সের তুলনা করার আগে সাকিবের এবারের পারফরম্যান্সে আরেকবার চোখ বোলানো যাক৷
বিশ্বকাপের আট ম্যাচের আট ইনিংসের মধ্যে সাতটিতেই পঞ্চাশ পেরোনো স্কোর বাংলাদেশের অলরাউন্ডারের৷ দুই সেঞ্চুরি ও পাঁচ ফিফটিতে মোট রান ৬০৬৷ গড় ৮৬.৫৭; স্ট্রাইকরেট ৯৩.০৩৷ দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৭৫ রানে টুর্নামেন্ট শুরুর পর নিউজিল্যান্ড (৬৪), ইংল্যান্ড (১২১), ওয়েস্ট ইন্ডিজ (১২৪*), অস্ট্রেলিয়া (৪১), আফগানিস্তান (৫১), ভারত (৬৬), পাকিস্তান (৬৪)- প্রত্যেক দলের বিপক্ষে বিস্ময়কর ধারাবাহিকতায় হেসেছে সাকিবের ব্যাট৷ বোলিংয়ে হয়তো ততটা না, কিন্তু প্রয়োজনের সময় আফগানদের বিপক্ষে পাঁচ উইকেট নিয়ে দলকে জেতান ঠিক৷ ৭৪ ওভার বোলিং করে ৩৬.২৭ গড় এবং ৫.৩৯ ইকোনমিতে ১১ শিকার এই বাঁহাতি স্পিনারের৷
এক বিশ্বকাপে অন্তত চারশ রান ও ১০ উইকেট নেবার কীর্তি এর আগে দেখাতে পারেননি কোনো অলরাউন্ডার৷ সেটি আশির সেই বিখ্যাত চতুষ্টয় কিংবা পরবর্তী সময়ে জয়াসুরিয়া-ক্যালিস-ক্লুজনারদের কেউই না৷ সেখানে সাকিবের এক বিশ্বকাপে ৬০৬ রান ও ১১ উইকেট৷ বিশ্বকাপের রেকর্ডের পাতায় অক্ষয় কালিতেই বোধকরি লেখা হয়ে গেল এ কীর্তি৷
এবার দেখা যাক, বিশ্বকাপের আগের প্লেয়ার অব দ্য টুর্নামেন্টদের সঙ্গে তুলনায় কোথায় দাঁড়িয়ে সাকিবের এ পারফরম্যান্স? এ পুরষ্কার প্রচলনের প্রথমবারে তা ওঠেন কিউই অধিনায়ক ক্রোর হাতে৷ সেই ১৯৯২ বিশ্বকাপের ৯ ইনিংসে ৪৫৬ রান করেন ক্রো৷ গড় ১১৪; একটি সেঞ্চুরি ও চারটি ফিফটি৷ ক্রোর চেয়ে এক ইনিংস কম খেলে ১৫০ রান বেশি সাকিবের৷ বোলিংয়ের তাঁর ১১ উইকেট না হয় এ বিবেচনায় তোলাই থাকুক!
১৯৯৬ বিশ্বকাপের প্লেয়ার অব দ্য টুর্নামেন্ট সনাত্ জয়াসুরিয়া অবশ্য অলরাউন্ড পারফরম্যান্স৷ ছয় ইনিংসে এই বিস্ফোরক লঙ্কান ওপেনারের মোটে দুই ফিফটিতে ২২১ রান৷ রানসংখ্যা কিংবা ৩৬.৮৩ গড় অবশ্য জয়াসুরিয়ায় প্রভাব বোঝাতে পারে না, কিছুটা পারে ১৩১.৫৪ স্ট্রাইকরেট৷ তা হোক, তবুও তো সাকিবের চেয়ে ৩৮৫ রান পিছিয়ে থাকার রেকর্ডও অস্বীকারের উপায় নেই৷ জয়াসুরিয়ার সাত শিকারের চেয়ে বাংলাদেশী অলরাউন্ডারের উইকেটও চারটি বেশি৷
১৯৯৯ বিশ্বকাপের টুর্নামেন্টসেরা ক্লুজনারের ব্যাটে যেন ভর করেছিল দানো৷ ম্যাচের পর ম্যাচ ইনিংসের শেষদিকে নেমে দ্রুতগতিতে রান তুলে জেতান দক্ষিণ আফ্রিকাকে৷ আট ইনিংসে তাঁর ২৮১ রান৷ ফিফটি মোটে দুটি হলেও ছয় ইনিংসে অপরাজিত থাকায় গড় ১৪০.৫০৷ ক্লুজনারের মতো অত অত ম্যাচ জেতানো ইনিংস নেই সাকিবের; কিন্তু সমান ইনিংসে রান ৩২৫ বেশি৷ প্রোটিয়া অলরাউন্ডারের উইকেট (১৭) অবশ্য সাকিবের চেয়ে ছয়টি বেশি৷ ব্যাট-বলের পারফরম্যান্সে তাই দুজনকে রাখা যায় একই পাল্লায়৷
২০০৩ বিশ্বকাপের টেন্ডুলকার দুই উইকেট পেলেও তিনি তো ব্যাটসম্যানই৷ ব্যাট হাতে সফলতম আসর কাটান ১১ ইনিংসে এক সেঞ্চুরি ও ছয় ফিফটির মালায় ৬১.১৮ গড়ে ৬৭৩ রান করে৷ সাকিবের চেয়ে ৬৭ রান বেশি, তবে তা তিন ইনিংস বেশি খেলে৷ সেঞ্চুরি ও গড়ে বাংলাদেশের অলরাউন্ডার এগিয়ে৷ সঙ্গে বোলিংয়ে ৯টি বেশি উইকেট তো রয়েছেই!
২০০৭ সালে এসে বিশ্বকাপ প্রথমবারের মতো এক বোলারকে পায় প্লেয়ার অব দ্য টুর্নামেন্ট হিসেবে৷ ২৬ উইকেট নিয়ে সে মুকুট অসি পেসার ম্যাকগ্রার৷ ১১ ইনিংসে ১৩.৭৩ গড় এবং ৪.৪১ ইকোনমিতে তাঁর সে অর্জন৷ সাকিবের চেয়ে তিনি ঢের এগিয়ে; তিন ইনিংস বেশি বোলিং করে ১৫ শিকার বেশি করার চেয়েও বেশি৷ তবে তুলনার সময় সাকিবের ৬০৬ রানকে উপেক্ষা করবেন কিভাবে?
২০১১ বিশ্বকাপসেরা ভারতের যুবরাজের ব্যাট-বল চলেছে সমানতালে৷ ৯ ম্যাচের আট ইনিংসে এক সেঞ্চুরি ও চার ফিফটিতে ৩৬২ রান তাঁর; গড় ৯০.৫০৷ সমান ইনিংসে সাকিবের একটি করে সেঞ্চুরি-ফিফটি বেশি, রান বেশি ২৪৪৷ যুবরাজের উইকেট (১৫) অবশ্য চারটি বেশি; যদিও এক ইনিংস বেশি বোলিং করেছেন৷ সাকিব-যুবরাজের পারফরম্যান্সের তুলনায় কাউকে এগিয়ে-পিছিয়ে রাখা তাই কঠিন৷
২০১৫ বিশ্বকাপে ৮ ম্যাচে ২২ উইকেট নিয়ে কেবল টুর্নামেন্ট-সর্বোচ্চ উইকেটশিকারী নন স্টার্ক, টুর্নামেন্টসেরায়ও পেছনে ফেলেন বাকিদের৷ তাঁর ১০.১৮ গড়, ১৭.৪ স্ট্রাইকরেট, ৩.৫০ ইকোনমি সবই ঈর্ষণীয়৷ সাকিবের ঠিক দ্বিগুণ উইকেট স্টার্কের৷ কিন্তু রান? সাকিবের এবার যে ৬০৬ রান, এর পুরোটাই বেশি! ২০১৫ বিশ্বকাপে তিন ইনিংস ক্রিজে গিয়েও তো রানের খাতা খুলতে পারেননি স্টার্ক! তাহলে তুল্যমূল্য আলোচনায় স্টার্কের চেয়ে সাকিব পিছিয়ে থাকেন কিভাবে?
সাকিব পিছিয়ে আছেন আসলে একটি জায়গাতেই৷ তাঁর দল বাংলাদেশ সেমিফাইনালে জায়গা করে নিতে পারেনি৷ আগের প্লেয়ার অব দ্য টুর্নামেন্টদের বেলায় অন্তত ওইটুকুন হয়েছে বলে তা যেন এক অলিখিত শর্ত৷ ১৯৯২ সেমিফাইনাল খেলেছে ক্রোর নিউজিল্যান্ড, ১৯৯৬ চ্যাম্পিয়ন জয়াসুরিয়ার শ্রীলঙ্কা, ১৯৯৯-র সেমিফাইনালিস্ট ক্লুজনারের দক্ষিণ আফ্রিকা, ২০০৩ সালের রানার্সআপ টেন্ডুলকারের ভারত, ২০০৭ আসরের চ্যাম্পিয়ন ম্যাকগ্রার অস্ট্রেলিয়া, ঠিক যেমনটা ২০১১-র যুবরাজের ভারত ও ২০১৫-র স্টার্কের অস্ট্রেলিয়া৷ সাকিবের বাংলাদেশ তা নয়৷
এই আসরে রোহিত শর্মা, ডেভিড ওয়ার্নার, মিচেল স্টার্ক, জাসপ্রিত বুমরাহদের কীর্তির আলোচনা করবেন? অলরাউন্ড পারফরম্যান্সে কেউ সাকিবের ধারেকাছে নেই৷ শুধু বাংলাদেশ সেমিফাইনালে নেই বলেই হয়তো প্লেয়ার অব দ্য টুর্নামেন্টের পুরষ্কার তিনি পাচ্ছেন না৷
হয়তো তা সাকিবের প্রাপ্য হওয়া সত্ত্বেও!