সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড: সাংবাদিকরা লজ্জিত!
১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডের সাত বছর পূর্তির দিনটিতেও সাংবাদিকরা প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেছেন বিচারের দাবিতে৷ তদন্ত শেষ করে অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে বিচারের দাবিতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে স্মারক লিপিও দিয়েছেন তাঁরা৷ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দিয়েছেন সেই পুরনো আশ্বাসই– অপরাধী দ্রুত ধরা পড়বে, বিচারের আওতায় আসবে৷
এদিকে তদন্তকারী সংস্থা র্যাব শুধু আদালতে একটি তদন্ত অগ্রগতি প্রতিবেদন দিতে সাত বছরে ৬২ বার সময় নিয়েও এখনো প্রতিবেদনটি দিতে পারেনি৷ এজন্য অবশ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বিব্রত৷সেরকমই বলেছেন তিনি৷
কিন্তু তদন্ত সংস্থা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রনালয় এবং সরকার কী করছে তা তো আমরা কম-বেশি জানি৷ কিন্তু সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে কী করা হয়েছে? বিচার আদায়ের জন্য তাদের ভূমিকা কতটা জোরালো?
দৈনিক সংবাদ-এর সিনিয়র ফটো সাংবাদিক সোহরাব আলম৷ ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি সকালে সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের খবর পেয়েই ঢাকার পশ্চিম রাজাবাজরের ফ্ল্যাটে গিয়েছিলেন তিনি৷হত্যাকাণ্ডের পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ এবং ওই সময়ে পুলিশের তৎপরতা সবই তিনি দেখেছেন৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘তখন ওই বাসায় গিয়ে তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন ৪৮ ঘন্টার মধ্যে অপরাধীদের শনাক্ত এবং আইনের আওতায় আনার কথা বলেছিলেন৷ কিন্তু সাত বছরেও তা হলো না৷''
তিনি বলেন, ‘‘ওই সময় সেখানে উপস্থিত কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তাও আমাদের বলেছিলেন– আমরা ক্লু ধরে তদন্ত এগিয়ে নিই, এখানে এত ক্লু যে আমরা দ্রুতই অপরাধীদের শনাক্ত করে ধরে ফেলব৷''
ইত্তেফাকের সিনিয়র প্রতিবেদক জামিউল আহসান সিপুও সেই সকালে সেখানে গিয়েছিলেন৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সাহারা খাতুন ওই বাসায়ই সাংবাদিকদের ব্রিফ করেছিলেন৷ তখন তাঁর কথায় আমাদের মনে হয়েছে, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আসামিদের চিহ্নিত ও আটকের ব্যাপারে তিনি কনফিডেন্ট৷''
তারপর এত বছরেও কেন হলো না? জামিউল বলেন, ‘‘ওই সময়ে পুলিশের সঙ্গে কথা বলে আমার মনে হয়েছে, তারা তাৎক্ষণিকভাবে, পারিবারিক কোনো কারণে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে মনে করেছিল৷ এছাড়া তারা মনে করেছিল, মেবাইল ফোনের কললিস্ট ধরে অপরাধী শনাক্ত করা যাবে৷ কিন্তু বিষয়টি সেরকম নয় বলে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়৷ আর তদন্তের নামেও সাত বছর কেটে যায়৷''
হত্যাকাণ্ডের পর সারা দেশের মানুষ যেমন প্রতিবাদ জানায়, সাংবাদিকরাও মাঠে নামেন অরাধীদের আটক ও বিচারের দাবিতে৷ তখন রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত সাংবাদিক ইউনিয়নগুলো এই ইস্যুতে এক হয়ে কর্মসূচি দিতে শুরু করে৷ সাংবাদিকদের দলীয় পরিচয় দূরে রেখে এক হওয়ারও সম্ভাবনা দেখা দেয়৷ কিন্তু বেশি দিন এই ঐক্য থাকেনি৷ তাই মানববন্ধন বা প্রতীকী অনশনের বাইরে আর কোনো জোরালো কর্মসূচি হয়নি৷ সংবাদমাধ্যমগুলো একদিনের জন্য বন্ধ রাখার দাবি উঠলেও সাংবাদিক সংগঠনগুলো সেই কর্মসূচি দেয়নি৷ আর এখন হত্যাকাণ্ডের দিনটিতে বছরে একবার প্রেসক্লাবের সামনে সাংবাদিকদের কালোব্যাজ পরে কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়িয়ে বিচার চাওয়া একটি সাধারণ কর্মসূচিতে পরিণত হয়েছে৷
সোহরাব আলম বলেন, ‘‘আসলে শুরু থেকেই আন্তরিকতা ছিল না৷ ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে লোকদেখানো প্রতিবাদ ছিল৷ আর এজন্য এখন আর আমি নিজেও কোনো কর্মসূচি দিলে সেখানে যাই না৷ শুরুতে সব কর্মসূচিতে আমি অংশ নিতাম৷ আমি হতাশ হয়েছি৷ কারণ, যতটা জোরালো আন্দোলন গড়ে তোলা যেতো, তা করা হয়নি৷''
জামিউল আহসান সিপু বলেন, ‘‘হত্যাকাণ্ডের পর ১৫-২০দিন সাংবাদিকরা জোরালো আন্দোলন করলেও এরপর ম্রীয়মান হয়ে যায়৷ সাংবাদিকদের একটা প্রচেষ্টা ছিল তীব্র আন্দোলন করা যায় কিনা, পত্রিকার প্রথম পাতার এক কলামের কিছু অংশ ফাঁকা রাখা যায় কিনা, অথবা সব ধরনের সংবাদমাধ্যমে এক দিন ধর্মঘট পালন করে প্রকাশনা ও সম্প্রচার বন্ধ রাখা যায় কিনা, কিন্তু এই মাত্রার প্রতিবাদ শেষ পর্যন্ত হয়নি৷ কর্মসূচিভিত্তিক কিছু প্রতিবাদ হয়েছে৷''
তিনি বলেন, ‘‘এটাকে আমি ব্যর্থতা বা অনীহা না বলে হতাশার জায়গা থেকে সাংবাদিকরা পিছিয়ে গেছে বলে আমি মনে করি৷''
সাগর-রুনি হত্যার প্রতিবাদে ও বিচারের দাবিতে সাংবাদিদের শুরুর দিকের আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন সাংবাদিক আবু জাফর সূর্য৷ তিনি এখন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা তো নিয়মতান্ত্রিকভাবে আন্দোলন করি৷ আমরা তো অন্য শ্রেণি-পেশার মতো রাস্তা অবরোধ করতে পারি না৷ আমরা সাগর-রুনির সন্তানের কাছে লজ্জিত৷ তাদের কাছে আমাদের দায় রয়ে গেছে৷ বিচারের দাবিতে যেভাবে আন্দোলন করা দরকার ছিল, আমরা তা পারিনি৷ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি হয় এমন আন্দোলন আমরা গড়ে তুলতে পারিনি৷''
কেন তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলা যায়নি? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,‘‘আমাদের সাংবাদিকদের মধ্যে বিভাজন আছে৷ ফলে আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারিনি৷ আমাদের সাংবাদিকদের মধ্যে দলকানা ভাবও আছে৷ ফলে আমরা বড় আন্দোলন গড়ে তুলতে পারিনি৷ কিন্তু হতে পারতো৷''
ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটির সাবেক সভাপতি ইলিয়াস খানও শুরুর দিকের আন্দোলনে ছিলেন৷ তিনি বলেন, ‘‘অনেকে বলছেন, সাংবাদিকরা কার্যকর আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি৷ কিন্তু সাংবাদিকরা তাদের দলীয় বিভাজন এবং বিভেদ ভুলে অনেক দিন আন্দোলন করেছেন৷ কিন্তু সরকার যদি বিষয়টি আমলে না নেয়, গুরুত্ব না দেয়, তাহলে আমরা কী করতে পারি৷ আসলে এখানে সরকারের আন্তরিকতাই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়৷''
কিন্তু শেষ পর্যন্ত তো আর সাংবাদিকরা ঐক্যবদ্ধ খাকেননি৷ কেন এমন হলো? ইলিয়াস খান বলেন, ‘‘এটা আমারও প্রশ্ন৷ বাজারেও তা চাউড় হয়েছে, যাঁরা নেতৃত্বের উচ্চ পর্যায়ে ছিলেন, তাঁরা সরকারের কাছ থেকে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে ম্যানেজড হয়ে যান৷ আমাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার একটা প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল৷ আমাদের সাংবাদিক ইউনিয়নে রাজনৈতিক বিভক্তি আছে৷ কেউ কেউ সরকারের উচ্চ পদে গিয়েছেন৷ দু'চারজন সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন৷ ফলে আমাদের আর ঐক্যবদ্ধ হওয়া হয়নি৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘আমাদের অনৈক্যের কারণেই আমরা সাগর-রুনি হত্যার বিচারের দাবিতে সংবাদমাধ্যমে ধর্মঘট বা বন্ধ রাখার মতো কর্মসূচিতে যেতে পারিনি৷ তবে সরকার যদি আন্তরিক হতো, তাহলে অপরাধীরা শনাক্ত হতো এবং বিচারের আওতায় আসত৷ তবে আমি এখনো আশাবাদী যে, একদিন বিচার হবে৷''