সাম্বার ছন্দে শেষ আটে ব্রাজিল
৫ ডিসেম্বর ২০২২নেইমার-রিচার্লিসন-ভিনিসিয়ুসরা বুঝিয়ে দিলেন, জুং কুক এর 'ড্রিমার’ গানের চেয়ে তাদের গোলেই এখনো নাচে বেশিরভাগ মানুষ৷ দক্ষিণ কোরিয়াকে ৪-১ গোলে হারিয়ে কাতার বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছে গেল ব্রাজিল৷ গোল করেছেন ভিনিসিয়ুস, নেইমার, রিচার্লিসন ও লুকাস পাকেতা৷
সার্বিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে নয় ফাউলের শিকার হয়ে পরের দুটো ম্যাচে দর্শক হয়ে থাকার পর নকআউটের প্রথম ম্যাচে নেইমার ফিরেছেন মাঠে৷ ক্যামেরুনের বিপক্ষে রিজার্ভ বেঞ্চের শক্তি যাচাই করে দেখার পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে তিতে ফের বেছে নিয়েছেন সেরা একাদশ৷ যে ছকে খেলে বাছাই পর্বে সফল হয়েছে ব্রাজিল, সেই ৪-২-৩-১ ছকেই ফেরত গেছেন তিতে৷ গোলবারে অ্যালিসন, রক্ষণে এদের মিলিতাও, মারকুইনহোস, থিয়াগো সিলভা ও দানিলো; মাঝমাঠে কাসেমিরো আর লুকাস পাকেতা, আক্রমণে নেইমারের পাশে দুই উইংয়ে ভিনিসিয়ুস-রাফিনহা আর সামনে রিচার্লিসন৷
বিশ্বকাপে এশিয়ার কোন দলের কাছে কখনো হারেনি ব্রাজিল, তাই দক্ষিণ কোরিয়াকে নিয়ে ছিল না খুব বেশি ভয়৷ তবুও অঘটনের বিশ্বকাপে কখন যে কী হয়? মাত্রই আগের ম্যাচে পর্তুগালকে হারিয়ে আসা দক্ষিণ কোরিয়াকে হালকা ভাবে নিলেই যে হবে ভুল৷ তবে দলটার নামও তো ব্রাজিল, পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন৷
তিতে শুরু থেকে আক্রমণাত্মক৷ ম্যাচের সপ্তম মিনিটেই ভিনিসিয়ুসের গোল, রাফিনহার বাড়ানো পাস বাম প্রান্তে ধরলেন রিয়াল মাদ্রিদ তারকা, বল নিজের আয়ত্তে এনে নিশানা ঠিক করলেন, তারপর নির্ভুলভাবে পাঠিয়ে দিলেন জালে৷ ১-০ গোলে এগিয়ে গেল ব্রাজিল৷ পরের গোলটা পেনাল্টি থেকে৷ ম্যাচের ১১ মিনিটে উ-ইয়ুং-জুং বক্সের ভেতর অবৈধভাবে বাধা দেন রিচার্লিসনকে, পেনাল্টির সংকেত দেন রেফারি৷ স্পটকিকে গোল করেন নেইমার, যা চলতি বিশ্বকাপে এই তারকার প্রথম গোল৷ ব্রাজিলের হয়ে গোলসংখ্যা ৭৬ হয়ে গেল নেইমারের, মাত্র এক গোলে পিছিয়ে আছেন পেলের চেয়ে৷
রাফিনহা জানিয়েছিলেন, গোল উদযাপনের জন্য ১০ রকমের নাচের মূদ্রা আয়ত্ত করেছেন ব্রাজিলের ফুটবলাররা৷ অবশ্য মাঠের চলাফেরাই যাদের সাম্বা নাচের ছন্দে, তাদের আলাদা করে নেচে মন ভরানোর কী দরকার?
ক্যামেরুনের সঙ্গে অপ্রত্যাশিত হারে মন খারাপ হয়েছিল বলেই হয়তো সোমবার রাতে উদযাপনের মাত্রাটা বেশি! গোল করেই কর্নার ফ্ল্যাগের কাছে ছুটে যাচ্ছেন ব্রাজিলের ফুটবলাররা, কখনো গোল হয়ে নাচছেন কখনো বা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে৷ কখনো কোচ তিতের সঙ্গে গিয়েও একটু কোমর দুলিয়ে এলেন ফুটবলাররা৷ তবে সেরা নাচটা দেখিয়েছেন রিচার্লিসন৷ সার্বিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে তার অ্যাক্রোব্যাটিক গোল তো সবাই দেখেছেন, দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে এই ফরোয়ার্ড দেখিয়েছেন নিজের জাগলিং স্কিল৷ মাথায় থাকা বলটাকে হালকা করে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে নিজের আয়ত্তে এনে যেভাবে পায়ে নামিয়ে আনলেন, সেটাই ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের চিরায়ত সৌন্দর্য্য৷ দুজন রক্ষণভাগের ফুটবলারের মাঝখানে এটা করেছেন রিচার্লিসন, নামিয়ে পাস দিয়েছেন মার্কুইনহোসকে৷ তিনি দিলেন লুকাস পাকেতাকে, ততক্ষণে বক্সের ভেতর জায়গা করে নিয়েছেন রিচার্লিসন, বল এল তার পায়ে এবং তিনি সেটা ঠেলে দিলেন গোলপোস্টের ভেতরে৷
৩৬ তম মিনিটে গোল করে ফেললেন লুকাস পাকেতাও৷ বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে ৩ গোল করা পাকেতা করলেন ম্যাচে ব্রাজিলের চতুর্থ গোল, আবারও কিছুক্ষণ নাচ চলল কর্নার ফ্ল্যাগের সামনে৷ ১৯৫৪ সালের বিশ্বকাপে, গ্রুপপর্বে মেক্সিকোকে ৫-০ গোলে হারানোর ম্যাচে প্রথমার্ধেই চার গোল করেছিল ব্রাজিল৷ ৬৮ বছর পর আবার সেই কীর্তি ব্রাজিলের৷ প্রথমার্ধে দক্ষিণ কোরিয়ার সুযোগ বলতে হুয়াং হি চ্যানের বক্সের বাইরে থেকে নেয়া জোরালো শট, যেটা ফিস্ট করে কর্নারের বিনিময়ে রক্ষা করেন অ্যালিসন৷
দ্বিতীয়ার্ধে ব্রাজিল আক্রমণে গেলেও তাতে ছিল না নির্মমতা, বরং প্রতিপক্ষকে নিয়ে খেলতেই যেন বেশি পছন্দ৷ তিতে বেশ কিছু পরিবর্তনও এনেছেন ধাপে ধাপে৷ ৬৩ মিনিটে এদের মিলিতাও কে তুলে তিতে নামান দানি আলভেসকে, ৭২ মিনিটে ভিনিসিয়ুসকে তুলে নিয়ে সুযোগ দেন গ্যাব্রিয়েল মার্তিনেলিকে আর দানিলোকে তুলে নিয়ে নামান ব্রেমারকে৷ তিন পরিবর্তনে খানিকটা এলোমেলো ব্রাজিলের রক্ষণ, এই সুযোগেই দূরপাল্লার শটে পাইক সুইংহো গোল করেন সেলেসাওদের বিপক্ষে৷ অবশেষে অ্যালিসনকে ফাঁকি দিয়ে কেউ বল পাঠাতে পারলেন জালে৷ মজার ব্যপার হচ্ছে গোল হজমের মিনিট চারেক পর অ্যালিসনকে তুলে উইভারটনকে নামান তিতে, এর মাধ্যমে স্কোয়াডে থাকা তিন গোলরক্ষকই পেলেন মাঠে নামার স্বাদ কারন আগের ম্যাচেই ব্রাজিল কোচ খেলিয়েছেন এদেরসনকে৷ একই সময়ে সদ্যই চোট থেকে সেরে উঠে মাঠে নামা নেইমারকেও তুলে নিয়ে রদরিগোকে নামিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা সেরে নিয়েছেন তিতে৷
দ্বিতীয়ার্ধে আরো গোলের চেয়ে স্কোয়াডের সদস্যদের সবাইকে মাঠে খানিকটা সময় কাটানোর সু্যোগ করে দেয়াটাই যেন ছিল তিতের লক্ষ্য৷ তবে প্রথমার্ধের ৪৫ মিনিটেই তিতে বুঝিয়ে দিয়েছেন, ক্যামেরুনের বিপক্ষে হারটা স্রেফ দুর্ঘটনা, পরীক্ষা নিরীক্ষার ফল৷
ম্যাচ শেষে নেইমার আর থিয়াগো সিলভা মিলে পেলের বিশ্বকাপে গোল করে উদযাপনের আইকনিক ছবি খচিত ব্যানার নিয়ে এলেন, এরপর দলের সবাই তার পেছনে দাঁড়িয়ে ছবি তুললেন৷ ফুটবলের রাজার শারীরিক অবস্থা ভালো নয়, সম্প্রতি ছড়িয়ে পড়েছিল তার মৃত্যু সংবাদও৷ যদিও পরে পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে সত্যিটা৷ পেলে মাঠে না থাকলেও সাম্বার ছন্দ যে হারিয়ে যায়নি, সেলেসাওরা পেলেকে যেন সেই ভরসাই দিলেন৷
দক্ষিণ কোরিয়াকে ৪-১ গোলে হারানোর দিনে অদ্ভুত এক রেকর্ড গড়েছে ব্রাজিল৷ এই ম্যাচে অ্যালিসনের বদলি হিসেবে উইভারটনকে মাঠে নামানোর মাধ্যমে প্রথম কোন দল হিসেবে বিশ্বকাপে স্কোয়াডের সব খেলোয়াড়কে একবার হলেও মাঠে নামার সুযোগ করে দেয়ার বিরল রেকর্ড গড়েছে সেলেসাওরা৷
রেকর্ড গড়েছেন ভিনিসিয়াসও৷ ২০০২ সালে রোনালদিনহোর পর সবচেয়ে কমবয়সী ব্রাজিলিয়ান হিসেবে বিশ্বকাপের নকআউট পর্বে গোল করেছেন রিয়াল মাদ্রিদে খেলা এই উইঙ্গার৷
চোট থেকে সেরে ওঠার পর মাঠে নেমে গোল করে আরেক রেকর্ড করেছেন নেইমার৷ পেলে এবং রোনালদোর পর বিশ্বকাপের তিন আসরে গোল করা তৃতীয় ব্রাজিলিয়ান তিনি৷ ২০১৪, ২০১৮-এর পর ২০২২ বিশ্বকাপেও স্কোর করলেন নেইমার৷
এদিকে ব্রাজিলের বিপক্ষে হারের পর দক্ষিণ কোরিয়ার কোচের পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন পাওলো বেনতো৷ ম্যাচের পর বেনতো সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, সিদ্ধান্তটা আগেই নেয়া ছিল৷ তিনি বলেন, ‘‘সিদ্ধান্তটা নেয়াই ছিল, আজ প্রকাশ করলাম৷ এখন থেকে আমাদের ভবিষ্যতের কথা ভাবতে হবে৷ আমি আপাতত বিশ্রাম নেব আর দেখি সামনে কী হয়’’৷ ব্রাজিলের বিপক্ষে হার নিয়ে তার মন্তব্য, ‘‘আমাদের উচিত ব্রাজিলকে অভিনন্দন জানানো, ওরা অবশ্যই আমাদের চেয়ে ভালো খেলেছে৷’’
স্টেডিয়াম ৯৭৪ থেকে ব্রাজিলের পরের গন্তব্য এডুকেশন সিটি, শুক্রবার ৯ ডিসেম্বর যেখানে তাদের প্রতিপক্ষ ক্রোয়েশিয়া৷
একই রাতে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিল এশিয়ার দুই প্রতিনিধি, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া৷ আফ্রিকার একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে এখনো টিকে আছে মরক্কো যারা আজ মুখোমুখি হবে স্পেনের৷