যেমন ইচ্ছে যায় না লেখা…
৩১ জানুয়ারি ২০২০কবি শামসুর রাহমানের কাছে স্বাধীনতা মানে- ‘যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা’৷ যেমন ইচ্ছে কী আসলে লেখা যায়? এটা কথার কথা৷ প্রতীকি ব্যঞ্জনা৷ বাংলাদেশের প্রধান কবিও কিন্তু যেমন খুশি লিখে যাননি। তাকে একদিকে ভাবতে হয়েছে মানের দিক৷ অন্যদিকে মাথায় রাখতে হয়েছে সমাজবাস্তবতাও। তাই শামসুর রাহমানের যাপিত জীবনের সবটা মেলে ধরেননি বইয়ের পাতায়৷ কারণ একজনের বিশ্বাস প্রকাশিত হলে অন্যের বিশ্বাসে আঘাত আসতে পারে৷ অন্যকে বিক্ষুব্ধ করতে পারে। এসব বিষয় সামনে রেখে রাষ্ট্র বাড়াবাড়ি করতে পারে৷ সাংবাদিকতা শুধু নয়, নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারে বই প্রকাশেও৷ যার প্রতিফলন পড়তে পারে সাহিত্যচর্চায়৷ এই বাস্তবতায় কোথায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ? কতটা মুক্ত পরিবেশ পাচ্ছেন সাহিত্যিকরা?
পরিস্থিতি অতোটা গুরুতর নয়- এমন ইঙ্গিত দিলেন কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন৷ ডয়চে ভেলের বাংলা বিভাগকে তিনি বলছেন, ‘‘আমি নিজেও জানতে চাচ্ছি- লেখালিখির জন্য কাউকে কী থ্রেট করা হয়েছে? কোনো গ্রেপ্তার করা হয়েছে কি না? কোনো বই নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে কি না৷ এগুলো কী হয়েছে?’’
কোনো মহল সংক্ষুব্ধ হতে পারে, লেখার সময় এ বিষয়টি ভাবতে হয় কিনা, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ''আমার তো মনে হয় না, এই লেখালেখির জায়গা নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠেছে চারপাশে- দেখতে তো পাচ্ছি না৷ পত্রিকা বা অন্য কোথাও৷ আমার ক্ষেত্রে এসব বিষয় মাথার ভেতর থাকে না। এগুলো কখনোই আমি মাথায় রাখি না৷ আমার যা মনে আসে তা চিন্তা করেই লিখি। কেউ প্রতিরোধও করেনি। কেউ বলেনি যে, এই লেখাটা করেছেন, এই জন্য আপনি দায়ী হতে পারেন এটাও কেউ বলেনি৷’’
বইমেলা সামনে রেখে পুলিশ প্রশাসন বই যাচাই করার আগাম ঘোষণা দিয়ে রাখছে, এ বিষয়ে সেলিনা হোসেনের ভাষ্য, ''এটা নিয়ে ঢালাও কোনো মন্তব্য করতে পারব না৷ এখন যিনি লিখছেন, কোন পর্যায় সামনে রেখে লিখছেন। তবে অকারণে কাউকে ক্রদ্ধ করার কোনো যুক্তি আছে বলে আমি মনে করি না৷ লেখকদের প্রতি একটা আহ্বান আছে, উপন্যাস লিখলে তার জায়গা থেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করবেন। কোনো বিতর্ক আনবেন না, যে বিতর্ক দিয়ে একটা দ্বিধাবিভক্তি তৈরি হয়৷’’
প্রকাশনায় কেন নিয়ন্ত্রণ?
বছরজুড়ে বইপাড়া থাকে ঢিমেতালে৷ ফেব্রুয়ারি সামনে রেখে চাঙা হন লেখক-প্রকাশক-পরিবেশকরা৷ কারণ বাংলা একাডেমির অমর একুশে গ্রন্থমেলা সামনে রেখেই ঢাকা থেকে বেশিরভাগ বই প্রকাশিত হয়৷ একাডেমির তথ্যমতে, ২০১৯ সালে মেলায় প্রকাশিত হয়েছে চার হাজার ৬৮৫টি বই৷ ২০১৮ সালে বইয়ের সংখ্যা চার হাজার ৫৯১, আর ২০১৭ সালে ৩ হাজার ৬৬৬৷
বাংলা একাডেমির বইমেলা ঢাকায় লেখক-পাঠক-প্রকাশকের প্রধান মিলনমেলা৷ আবার একাডেমি গত কয়েক বছরে কিছু বই নিষিদ্ধ করেছে৷ সংশ্লিষ্ট প্রকাশকের স্টল পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছে। প্রায় সবার বিরুদ্ধেই আনা হয় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগ৷ এরমধ্যে ২০১৫ সালে রোদেলা প্রকাশনীকে বইমেলায় নিষিদ্ধ করা হয়৷ ২০১৬ সালে একই পরিণতি বরণ করতে হয় বদ্বীপ প্রকাশনীকে৷ তখন লেখক ও প্রকাশক গ্রেপ্তারের শিকার হন৷ এই ঘটনার প্রতিবাদে এগিয়ে আসেন শ্রাবণ প্রকাশনীর কর্ণধার রবিন আহসান৷ এই কারণে শ্রাবণকে বইমেলায় দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ করেছিলো একাডেমি৷ অবশ্য মেলা আসার আগেই সেই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেয় তারা৷
এসব ঘটনায় বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতে এক ধরনের ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে৷ স্বেচ্ছা-শৃঙ্খলে আছেন প্রকাশকরা৷ তবে সতর্কতার মধ্যে ইতিবাচক দিকও দেখছেন শ্রাবণ প্রকাশনীর কর্ণধার রবিন আহসান৷ এ প্রসঙ্গে ডয়চে ভেলের বাংলা বিভাগকে তিনি বলেন, ''আমরা দেখছি এটা আমাদের সমাজের জন্য ক্ষতিকর কিনা৷ এমন একটা বই আমরা ছাপালাম যে কারণে হাজার হাজার মুসলমান আমাদের বিরুদ্ধে চলে গেল এবং দেখা গেল শ্রাবণ প্রকাশনী উৎখাত করার জন্য তারা রাস্তায় নামল৷ তখন ঘটনাটা কী ঘটবে? আমরা তো দেখেছি তসলিমা নাসরিন দেশের বাইরে চলে গেছে৷ দাউদ হায়দারকে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই দেশ ছাড়তে হয়েছে৷’’
বই যাচাইয়ে বাংলা একাডেমির প্রক্রিয়া নিয়ে তিনি বলেন, ‘‘আমরা যারা বই প্রকাশ করছি তাদের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি৷ যেমন একটা বই প্রকাশ হওয়ার পরে তা বাংলা একাডেমিতে যায়৷ তাদের বইমেলায় কখন তারা বইটাকে নিষিদ্ধ করে- যখন আমরা ছাপাই তারপর হঠাৎ করে ওইটার রিঅ্যাকশনে৷ বই নিজে পড়ে যে নিষিদ্ধ করবে, এমন ক্ষমতা কিন্তু বাংলা একাডেমির নেই৷ কারণ বই মেলায় হাজার হাজার বই ছাপা হবে৷ বাংলা একাডেমি সব বই পড়ে তো আর নিষিদ্ধ করতে পারছে না৷ তারা যেটা করছে, রাষ্ট্র যেটা করছে পুলিশি-ভীতি তৈরি করছে৷ পুলিশও কিন্তু সেটা দেখতে পারে না৷ এতো যে বই সেটাতো পুলিশের পক্ষেও দেখা সম্ভব নয়৷’’
এবছর বইমেলায় অংশ নিচ্ছে না শ্রাবণ প্রকাশনী৷ কিন্তু বইমেলার অসঙ্গতি নিয়ে সোশ্য্যাল মিডিয়ায় সোচ্চার রবিন আহসান৷ মেলার স্টল বরাদ্দ নিয়ে কথা বলছেন৷ প্যাভিলিয়নের নামে বই বিক্রির বাজারি আয়োজনের বিরোধিতা করছেন৷ এক মাসের বদলে মেলা ১৫ দিনে নামিয়ে আনার প্রস্তাব রাখছেন৷ এ বিষয়ে তার ভাষ্য, ''বইমেলা ১৫ দিন হলে অনেক গোছানো হবে৷ এখন এক মাসে রাষ্ট্রের কিন্তু অনেক বড় একটা ক্ষতি হচ্ছে৷ এখানে লেখক-প্রকাশক হত্যা হওয়ার ফলে রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা, পুলিশ থাকে। বিদ্যুৎ সাপ্লাই থাকে। নানা ধরনের প্রতিষ্ঠান এখানে জড়িত থাকে৷ তাই ১৫ দিন হলে তারাও বাঁচে৷ এটা হলে যেটা হবে আমরা আগে থেকে কিছু ভালো বই বের করে রাখতে পারবো৷ এক মাস হওয়ার ফলে এমন হয়েছে অনেক প্রকাশকের নতুন নতুন বই ১৫-২০ তারিখের পরে বের হওয়া শুরু হয়।এখানে আমাদের যেমন ভুল হয়, তেমন অন্যদেরও ভুল হয়৷’’