শুধু প্রসূতিবিদদের দায়ী করলে চলবে না
১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭ইতিহাস বলে সিজারিয়ান অপারেশন প্রসূতি বিদ্যার এক গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার৷ ল্যাটিন শব্দ থেকে এর উত্পত্তি৷ অনেকে বলে থাকেন, সম্রাট জুলিয়াস সিজার এভাবে জন্মেছিলেন৷ রোমান রাজ্যে কোনো গর্ভবতী মারা গেলে তার পেট কেটে মৃত বাচ্চা বের করা হতো৷ প্রায় ৪০০ বছর আগে সর্বপ্রথম জীবিত একজন মায়ের শরীরে এ ধরনের অপারেশন করা হয়৷
বাংলাদেশে সিজারিয়ান
২০১৪ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে আমাদের দেশে সিজারিয়ান অপারেশনের হার প্রায় ২৩ শতাংশ এবং এখন ২০১৭ সালে হয়ত ৩০ শতাংশের কাছাকাছি৷ এর বিশাল অংশ জুড়ে আছে শহরের সিজারিয়ান সেকশন৷ শহরের অনেক ক্লিনিক বা হাসপাতালে দেখা যায়, ডেলিভারির প্রায় ৮০ শতাংশই হয় সিজারিয়ান সেকশনের মাধ্যমে৷
তবে ডক্টররা বলেন অন্য কথা৷ তাঁদের মতে, বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যুর যে হার, সেই হারের সাথে এবং ডেমোগ্রাফিক হিসেবে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ সিজারিয়ান অপারেশনের হার থাকা জরুরি৷
যে কোনো একজন সাধারন মানুষের মনে একটি প্রশ্ন জাগে, সেটি হলো, এই পদ্ধতিতে ডেলিভারি কতটা যৌক্তিক? আপনার বাচ্চাকে পৃথিবীর মুখ আপনি দেখাতে পারেন তিনটি উপায়ে, যেমন, নর্মাল ডেলিভারি, অ্যাসিসটেড নর্মাল ডেলিভারি বা সিজারিয়ান ডেলিভারির মাধ্যমে৷
কখন সিজারিয়ান অপারেশন প্রয়োজন
প্রকৃতির নিয়মের চেয়ে মানুষের তৈরি নিয়ম কখনোই ভালো হতে পারে না৷ তবে যখন নর্মাল ডেলিভারি সম্ভব নয় বা নর্মাল ডেলিভারি মা বা বাচ্চার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ, সেক্ষেত্রে সিজারিয়ান অপারেশরের প্রয়োজন হতে পারে৷ এক্ষেত্রে যে কারণগুলো উঠে আসে তার মধ্যে রয়েছে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যথেষ্ট চেষ্টার পরও যদি স্বাভাবিক প্রসব না হয়, গর্ভাবস্থায় বাচ্চার শ্বাসকষ্ট বা ফেটাল ডিসট্রেস, বাচ্চার ওজন এবং মায়ের নর্মাল ডেলিভারি পথের অসামঞ্জস্যতা, গর্ভফুল জরায়ুর মুখকে ঢেকে রাখা, মায়ের খিচুনি ইত্যাদি৷ পূর্বে ২ বা তার বেশি সিজারিয়ান অপারেশনের ইতিহাস, জরায়ুর বড় কোনো টিউমার, মায়ের হৃদরোগ, ডায়াবেটিসসহ অন্যান্য শারীরিক সমস্যার কারণে যদি নর্মাল ডেলিভারি সম্ভব না হয়, সেক্ষেত্রেও সিজারিয়ান করাতে হয়৷
সিজারিয়ান অপারেশনের প্রস্তুতি:
আপনার সিজারিয়ান অপারেশন লাগবে কিনা তার অনেকটা ধারনা গর্ভাবস্থায় চেক আপের মাধ্যমে বোঝা যায়৷ এক্ষেত্রে রক্তের গ্রুপ, হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ, ডায়াবেটিস, হেপাটাইটিস বি বা প্রস্রাবের রুটিন পরীক্ষা ইত্যাদি করিয়ে নিতে হবে৷ অনেক সময় অপারেশনের কারণ অনুযায়ী রক্ত জোগার রাখতে হতে পারে৷ স্বামী এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের উচিত প্রসূতিকে মানসিক শক্তি যোগান দেওয়া৷ প্রসূতিকেও সাহস রাখতে হবে৷ চিকিত্সকের উপরে বিশ্বাস এবং আস্থা রাখতে হবে৷ প্রয়োজনীয় টাকা হাতে রাখুন এবং রক্তের জন্য ডোনারকে বলে রাখুন৷ কিভাবে হাসপাতালে যাবেন সেজন্য প্রয়োজনীয় যানবাহনের ব্যবস্থা রাখতে হবে৷ তাছাড়া কোন হাসপাতাল থেকে সেবা নিবেন তা আগে থেকে জেনে রাখাও জরুরি৷
অপারেশনের সময় প্রসূতির ভয়ের কিছু নেই৷ তাঁর কোমরের নিচের অংশ অবশ করে সাধারণত এই অপারেশন করা হবে৷ কোনো সমস্যা হলে অবশ্যই ডাক্তারকে জানাতে হবে৷ সাধারনত অপারেশনে ৩০-৪৫ মিনিট সময় লাগে৷ অপারেশনের টেবিলেই আমরা বাচ্চাকে মায়ের বুকের শালদুধ দেবার এবং মায়ের কাছাকাছি বাচ্চাকে রাখার চেষ্টা করি৷ অপারেশনের পরেও মায়ের যত্ন অত্যন্ত জরুরি৷ ব্যান্ডেজ খুলে দেবার পরে মা-কে গোসল করতে হবে৷
সিজারিয়ানের পরে যে বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ
তিন মাস পর থেকে স্বাভাবিক কাজকর্ম শুরু করা যাবে৷ দেড় মাস পর থেকে অস্থায়ী জন্মনিয়ন্ত্রন ব্যবস্থা শুরু করা যাবে৷ ২-৩ বছর পরে দ্বিতীয় সন্তানের জন্য চেষ্টা করা যেতে পারে৷ পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে৷ যাঁরা বাচ্চাকে বুকের দুধ দিচ্ছেন, তাঁদের খাবারে বাড়তি আমিষ, আয়রন এবং ক্যালসিয়ামের প্রয়োজন হবে৷ তিন মাস পর থেকে ব্যায়াম শুরু করা যাবে৷
তবে সিজারিয়ান অপারেশনের বর্তমান প্রেক্ষাপটের জন্য শুধুমাত্র প্রসূতিবিদদের দায়ী করলে চলবে না৷ চলমান পুরো ব্যবস্থা কঠোর নিয়ন্ত্রন এবং ব্যক্তিগত ও সামগ্রিকভাবে কাজ করতে হবে৷
করণীয়
১. সঠিক নির্দেশনা বুঝে সিজারিয়ান অপারেশনের সিদ্ধান্ত নিতে হবে৷
২. গর্ভাবস্থায় চেকআপের হার বাড়াতে হবে৷
৩. মিডওয়াইফ এবং স্পিলড বার্থ অ্যাটেনডেন্ট বাড়াতে হবে৷
৪. গর্ভাবস্থায় গর্ভবতী এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের কাউনসেলিং করে নর্মাল ডেলিভারির জন্য বোঝাতে হবে৷
৫. ডেলিভারি কোন উপায়ে হবে সে সিদ্ধান্ত যেন ধাত্রীবিদ নিজে নেন৷ ক্লিনিক মালিক বা অদক্ষ কারো সিদ্ধান্তে যেন অপারেশন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে৷
৬. একটি রোগীকে কখন, কোথায় রেফার করতে হবে সেটির সঠিক নির্দেশিকা থাকতে হবে৷
শেষকথা
সকল প্রসুতিবিদের প্রথম পছন্দ নর্মাল ডেলিভারি৷ সিজারিয়ান ডেলিভারি একটি বিকল্প পদ্ধতি যা আধুনিক এবং নিরাপদ৷ এই পদ্ধতিতে ডেলিভারির মাধ্যমে অনেক মা ও শিশুর জীবন রক্ষা হয়েছে৷ একজন দক্ষ প্রসুতিবিদের হাতে এই অপারেশন কখনোই ঝুঁকিপূর্ণ নয়৷ তাই আপনি সচেতন হোন এবং সচেতন করুন আপনার চারপাশকে৷ একটি নিরাপদ পদ্ধতিতে দক্ষ প্রসুতিবিদের হাতে যেন একজন মায়ের সুস্থ বাচ্চা ডেলিভারি হয় আমরা সেই আশা করি৷ জয় হোক মাতৃত্বের৷
ডা. শারমিন আব্বাসি, প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষক, সহকারী অধ্যাপক, আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল