সিরিয়ার কারাগারে নারী নির্যাতন
১ মে ২০১৮মুনা মুহাম্মাদের এক একটি ক্ষণ মনে আছে৷ বন্দি জীবনের প্রতিটি ক্ষণ, প্রতিটি যন্ত্রণা আর অত্যাচার৷ ‘‘আমার মাথা একটি প্লাস্টিক ব্যাগ দিয়ে বাধা ছিল৷ এরপর উলটো করে সিলিং থেকে ঝুলিয়ে দিয়েছিল,'' বলছিলেন ৩০ বছর বয়সি মুনা৷
এই দুঃসহ স্মৃতি তাঁকে এখনো তাড়িয়ে বেড়ায়৷ কারাকক্ষের প্রহরী বলছিলেন, এভাবে মাথার ভেতর থেকে সব ‘কুচিন্তা' বেরিয়ে আসবে৷
সিরিয়ায় সংগীতের শিক্ষক ছিলেন মুনা৷ দাঈর এজ-জর-এ প্রেসিডেন্টবাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকরায় ২০১২ সালে গ্রেফতার হন তিনি৷ জিজ্ঞাসাবাদের পর ছেড়ে দেয়া হলেও সেনা গোয়েন্দারা পরে আবার তাঁকে গ্রেফতার করেন৷ তাঁকে দামেস্কে নিয়ে আসা হয়৷ সিরিয়ার সামরিক গোয়েন্দাদের যেই সেলটি তাঁকে গ্রেফতার করেছে, সেই সেলকে ‘ব্রাঞ্চ অফ হেল' বা ‘নরকের শাখা' বলে ডাকা হয়৷ যে লোকটি তাঁকে অত্যাচার করছিলেন, একদিন তিনি মুনাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘তোমার হৃৎপিণ্ড কোথায়?'' মুনার ভাষায়, ‘‘আমি আঙুল দিয়ে দেখাতেই, সেখানে আঘাত করা হলো৷''
নরকের শাখার দিনগুলি
মাসের পর মাস মুনাকে কখনো একটি নির্জন কক্ষে বা কখনো অন্যদের সঙ্গে বন্দি রাখা হতো৷
‘‘একদিন তারা এক ষোড়শী তরুণীকে জিজ্ঞাসাবাদ করছিলেন৷ আমরা তাঁর চিৎকার শুনছিলাম৷ মনে হচ্ছিল, তারা হয়তো মেয়েটিকে মেরে ফেলছে৷'' অনেক নারীকে ধর্ষণ করা হয়৷ অপরাধ স্বীকার না করলে তাঁকেও ধর্ষণ করার হুমকি দেয়া হয়েছিল বলে জানান মুনা৷
কারাগারে সবসময় টয়লেটে যাওয়া বা গোসল করার অনুমতি ছিল না মুনাদের৷ বন্দিদের সঙ্গে শিশুও ছিল৷ ‘‘এক মা ও মেয়ের কথা মনে আছে৷ অন্ধকার ঘরে শিশুটি সারাদিন কাঁদতো৷ আর দরজার নীচ দিয়ে আলো ধরার চেষ্টা করতো,'' বলছিলেন মুনা৷
এক সময় মুনাকে ছেড়ে দেয়া হয়৷ ২০১৬ সালে তিনি তুরস্কে পালিয়ে যান৷ আরো প্রায় পাঁচ লাখ সিরীয় নাগরিকের সঙ্গে তুরস্কের গাজিয়ানটেপ শহরে থাকেন তিনি৷
কত নারী সিরিয়ার কারাগারগুলোতে অন্তরীণ আছেন, তা নিশ্চিত নয়৷ তবে সেখানকার নাগরিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করে, এমন একটি এনজিও'র কর্ণধার ফাদেল আবদুল ঘানির মতে, সাত হাজারেরও বেশি নারীকে বন্দি করা হয়েছে৷
‘পরিকল্পিত নির্যাতন'
২০১৭ সালে প্রকাশিত অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কারাগারে সিরীয় গোয়েন্দা সংস্থার অত্যাচারে কমপক্ষে ১৭ হাজার নাগরিক মারা গেছেন৷ সেইদনায়া সামরিক কারাগারে প্রায় ১৩ হাজার নাগরিককে হত্যা করা হয়েছে৷ অ্যামনেস্টি এই হত্যাযজ্ঞকে সাধারণ নাগরিকের ওপর সরকারের ‘পরিকল্পিত নির্যাতন' বলে উল্লেখ করেছে৷
বাশার আল-আসাদ অবশ্য এই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন যে, এটি ভুয়া খবর৷
প্রতিকার প্রকল্প
সিরিয়ার কারাগারগুলোতে কী হচ্ছে তা বিশ্বকে জানাতে চান মুনা৷ তিনি বলেন, কথায় কথায় অপমান করা অত্যাচারের একটি অংশ ছিল৷ একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে তাঁর৷ এক ব্যক্তির কাছে তাঁর পেশা কী জানতে চাইলেন প্রহরী৷ লোকটি জানালেন, তিনি একজন ডাক্তার৷ এরপর ঐ প্রহরী তাঁকে বললেন, এক পায়ের ওপর লাফিয়ে লাফিয়ে বলতে যে, তিনি একটি খরগোশ৷
‘‘লোকটি প্রথমে আস্তে আস্তে বলছিলেন৷ প্রহরীরা তাই তাঁকে মারছিল৷ এরপর লোকটি জোরে জোরে বলছিল যে, আমি খরগোশ, আমি খরগোশ৷''
মুনা তাঁর জীবনের গল্পটি লিখেছেন৷ নির্যাতনের শিকার অন্য নারীদের ঘটনাগুলোও লিখে রাখছেন তিনি৷ এই নারীদের জন্য একটি ‘প্রতিকার প্রকল্প' চালু করেছেন তিনি৷
‘‘অনেকেই কারাগারে কী ঘটেছে, তা নিয়ে কথা বলতে চান না৷ অন্যরা এতটাই ভেঙে পড়েন যে, কান্না থামাতে পারেন না৷'' বলছিলেন মুনা৷ ‘‘আমি তাঁদের শক্ত থাকার পরামর্শ দিই৷ বলি যে, যা ঘটেছে তার জন্য তাঁরা দায়ী না৷'' তিনি বলেন, ‘‘আমি তাঁদের নতুন জীবন শুরু করার কথা বলি৷''
তুরস্কে মুনা তাঁর নতুন জীবন শুরু করেছেন৷ তবে একদিন তাঁর ওপর যে অত্যাচার হয়েছে, এর বিচার পাবেন সে প্রত্যাশা করেন তিনি৷
ইউলিয়া হান/জেডএ