সীতাকুণ্ডে মালিকপক্ষকে বাদ দিয়ে দুর্বল ধারায় মামলা
৯ জুন ২০২২আর মামলার ধারা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে৷ হত্যা মামলা না করে অবহেলাজনিত মৃত্যুর অপরাধে মামলা করা হয়েছে৷
মামলার বাদি সীতাকুণ্ড মডেল থানার সাব-ইন্সপেক্টর মো. আশরাফ ছিদ্দিক ডয়চে ভেলেকে বলেন,"ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে পরামর্শ করে তারা যেভাবে বলেছেন আমি সেভাবেই মামলা করেছি৷ মামলার ধারা ঠিক করেছেন ওসি সাহেব৷”
আইন বিশ্লেষকেরা বলছেন, এর মাধ্যমে মামলাটিকে দুর্বল ও প্রভাবশালী মালিকদের রক্ষা করা হয়েছে৷
মামলায় আসামি নয় মালিকপক্ষের কেউ
ঘটনার চার দিন পর মঙ্গলবার দিবাগত রাতে সীতাকুণ্ড মডেল থানায় মামলা হয়৷ মামলা যে আট জনকে আসামি করা হয়েছে তারা হলেন বি এম কনটেইরার ডিপোর ডিজিএম(অপারেশন) নুরুল আক্তার, ম্যানেজার(অ্যাডমিন) খালেদুর রহমান, সহকারী অ্যাডমিন ম্যানেজার আব্বাস উল্লাহ, সিনিয়র এক্সিকিউটিভ(আ্যাডমিন এন্ড কমপ্লায়েন্স) মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন, সহকারী ব্যবস্থাপক(ইনল্যান্ড কন্টেইনার ডিপো, আইসিডি) আব্দুল আজিজ, সিএফএস ইনচার্জ সাইফুল ইসলাম, সিএফএস এক্সিকিউটিভ নজরুল ইসলাম খান এবং জিএম (সেলস এন্ড মার্কেটিং) নাজমুল আক্তার খান৷ মামলায় অজ্ঞাতনামা আরো কর্মকর্তা-কর্মচারীর কথা বলা হলেও বি এম ডিপোর এমডি চট্টগ্রাম দক্ষিণ আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ মুজিবুর রহমানসহ মালিকপক্ষের কাউকে আসামি করা হয়নি৷
মামলার দুর্বল ধারা
মামলাটি করা হয়ছে দন্ডবিধির ৩৩৭,৩৩৮,৩০৪(ক) এবং ৪২৭ ধারায়৷
৩৩৭ ধারায় অবহেলা বা বেপরোয়াভাবে আঘাতের অপরাধ৷ সর্বোচ্চ শাস্তি ছয় মাসের কারাদণ্ড ও পাঁচশ' টাকা জরিমানা৷
৩৩৮ ধারায় গুরুতর আঘাতের অপরাধে দুই বছরের কারাদণ্ডের বিধান আছে৷
৩০৪(ক) ধারায় অবহেলা জনিত মৃত্যুর অপরাধ৷ শাস্তি সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড৷ তবে উদ্দেশ্য না থাকলে ১০ বছরের কারাদণ্ড৷
৪২৭ ধারায় ৫০ টাকা বা তার বেশি ক্ষতি করার অপরাধ৷ সর্বোচ্চ শাস্তি দুই বছরের কারাদণ্ড৷
প্রতিটি ধারাই আসলে অনিচ্ছাকৃত অপরাধের জন্য৷ কিন্তু মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়েছে, কনটেইনার ডিপো কর্তৃপক্ষ তথ্য গোপন করায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা মারা গেছেন৷ নিহতের সংখ্যাও বেড়েছে৷ আর ডিপোতে অনেক কেমিকেল ছিলো৷ কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা, অগ্নি নিরাপত্তা এবং প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত কর্মচারী ছিল না৷ ছিল না পর্যাপ্ত নিরপত্তা সুবিধা৷
তাহলে মামলায় কর্তৃপক্ষ হিসেবে মালিকপক্ষের কাউকে আসামি কেন করা হলো না? আর অভিযোগে তো জেনে শুনেই ডিপো অনিরাপদ রাখার বিষয়টি স্পষ্ট৷ তাহলে ৩০২ ধারায় হত্যা মামলা কেন হলো না? এর জবাবে বাদী সাব-ইন্সপেক্টর মো. আশরাফ ছিদ্দিক বলেন,"তদন্ত করে পরে নতুন আসামি করা যাবে৷ অজ্ঞাত আসামির বিষয়টি তো এজাহারে আছে৷ আর প্রমাণ হলে ধারাও পরিবর্তন করা যাবে৷”
কিন্তু এখন মালিকপক্ষকে আসামি করে ৩০২ ধারায় হত্যা মামলা করে তদন্তে প্রমাণ না হলে তখনো তো তা পরিবর্তন করা যেত৷ এর জবাবে তিনি বলেন," হ্যাঁ তাও করা যেত৷ কিন্তু আমি আমরা হায়ার অথরিটির সাথে কথা বলে মামলা করেছি৷ তারা যেভাবে বলেছেন সেভাবেই করেছি৷ আর মামলার ধারা ওসি সাহেব ঠিক করে দিয়েছেন৷”
সীতাকুণ্ড সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আশরাফুল কবীর এক প্রশ্নের জবাবে বলেন," আমরা কোনো রাজনৈতিক চাপে বা প্রভাবের কারণে মালিকপক্ষকে আসামি করিনি তা নয়৷ সরকারের আরো কয়েকটি তদন্ত কমিটি কাজ করছে৷ আমরাও তদন্ত করছি৷ তদন্তে তাদের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পেলে তাদেরও এজাহারভুক্ত করা যাবে৷ আর হত্যার উদ্দেশ্যে যদি এই ঘটনার প্রমাণ পাওয়া যায় তাহলে ধরাও পরিবর্তন করে ৩০২ করা যাবে৷ আইনে সেই সুযোগ আছে৷”
আইনজীবীরা যা বলেন
সাবেক বিচারক ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আজিজুর রহমান দুলু বলেন," যাদের আসামি হওয়ার কথা তাদের আসামি না করে এবং ৩০২ ধরায় মামলা না করে শুরুতেই মামলাটি দুই দিক থেকে দুর্বল করে দেয়া হয়েছে উদ্দেশ্যমূলকভাবে৷ এজাহারে বি এম কনটেইনার ডিপো কর্তৃপক্ষ বলা হয়েছে৷ আইনে ডিপোর মালিকপক্ষ বিধিবদ্ধ কর্তৃপক্ষ৷ তাই মালিকপক্ষের লোকজন আসামি হবেন৷ কিন্তু করা হয়নি৷ আর ৩০২ ধারায় হত্যা মামলা না করে অবহেলা জনিত মৃত্যুর মামলা করা হয়েছে৷ যা ঠিক হয়নি৷ ৩০২ ধারায় মামলা হওয়ার দুইটি শর্ত আছে জ্ঞাতসারে এবং উদ্দেশ্যমূলকভাবে ( নলেজ এন্ড ইনটেনশন)৷ এর যেকোনো একটি থাকলেই হবে৷ নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকার কারণে মানুষের মৃত্যু হতে পারে এটা তো জানা বিষয়৷ মানুষকে মৃত্যুর মুখে রাখা এবং সেই পরিস্থিতিতে মৃত্যু তো সরাসরি হত্যার অপরাধ৷ আবার জানার পরও রাসায়নিকের তথ্য গোপন করা হয়েছে৷ ফলে এখানে ৩০২ ধরায়ই মামলা হওয়া উচিত ছিলো৷ চাইলে এখনো সুযোগ আছে৷”
সুপ্রিম কোর্টের আরেকজন আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন,"এর আগে আমরা দেখেছি রূপগঞ্জের হাসেম ফুডস কারখানায় আগুনের ঘটনায় মালিককে আসামি করা হয়েছে, গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ কিন্তু সীতাকুণ্ডের ঘটনায় মালিককে আসামি করা হয়নি৷ এর কারণ হলো রূপগঞ্জের হাসেম ফুডস-এর মালিক সরকার সমর্থক ছিলেন না আর বি এম কন্টেইনারের মালিক সরকারি দলের প্রভাবশালী নেতা৷ আইনে এখানে মালিকপক্ষের লোকজনই আগে আসামি হয়৷ কিন্তু তাদের বাঁচিয়ে দেয়া হলো৷ আপনারা সাংবাদিকরাও হাসেম ফুডস-এর আগুনের সময় বলেছেন মালিককে কেন আসামি করা হচ্ছেনা, গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না৷ কিন্তু এখন তো সেভাবে বলছেন না৷”
তিনি আরো বলেন," সীতাকুণ্ডের ঘটনায় ৩০২ ধারায় মামলা করে পরে তদন্তে প্রমাণ না হলে ৩০৪ ধরায় নেয়া যেত৷ কিন্তু আগেই ৩০৪ ধরায় করে সুবিধা করে দেয়া হলো৷ তবে আমাদের আইনেও সমস্যা আছে৷ জেনেশুনে অবহেলা আর না জেনে অবহেলার মধ্যে পার্থক্য আছে৷ কিন্তু আইনে সেই পার্থক্য করা হয়নি৷”