‘হত্যা বন্ধে প্রধানমন্ত্রীকেও এমন বার্তা দিতে হবে’
৩ মার্চ ২০২০ঢাকা সফরে সোমবার ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সাথে সাক্ষাৎ করেন৷ তখন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সীমান্ত হত্যা প্রসঙ্গে তাকে বলেন, ‘‘আপনারা আমাদের বন্ধু মানুষ৷ এই বন্ধুদের মধ্যে কিলিং হওয়া ঠিক না৷’’ তিনি আরো বলেন, ‘‘আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম জিরো কিলিং হবে আমাদের বর্ডারে৷ কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এ বছরে কিলিং অনেক বেড়ে গেছে, এটা আমাদের জন্য দুঃখজনক৷’’
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষক এবং মানবাধিকার কর্মীরা মনে করেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্য বাংলাদেশের দিক থেকে অবশ্যই এক সাহসি বার্তা৷ তবে তারা মনে করেন, এটার প্রতিফলন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে থাকতে হবে, থাকতে হবে কূটনৈতিক সম্পর্কেও৷ দুই দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা যখন বিভিন্ন ফোরামে এক হবেন, তখন বাংলাদেশের দিক থেকে এরকম ‘সোজাসাপ্টা কথাই’ বলতে হবে বলে তারা মনে করেন৷
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘‘পররাষ্ট্রমন্ত্রী যা বলেছেন, ঠিকই বলেছেন৷ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে কি সীমান্ত হত্যা হয়? কিন্তু ভারতের সাথে আমাদের কূটনীতি ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এর প্রতিফলন হবে কিনা বলা মুশকিল৷ কারণ, কয়েকদিন আগেও আমাদের অনেক অফিসিয়াল সীমান্ত হত্যাকে স্বাভাবকি বলেই বক্তব্য দিয়েছেন৷ শুধু তাই নয়, তারা বিএসএফ-এর সীমান্ত হত্যাকে যৌক্তিকতা দেয়ার চেষ্টা করেছেন৷ তারা বলেছেন, চোরাচালান করতে যায় কেন? ভালো লোক তো মারা যায় না৷’’
তিনি বলেন, ‘‘তারা হতে পারেন চোরচালানি৷ কিন্তু তারা কি কোনো সন্ত্রাসী কাজ করছে যে, গুলি করে হত্যা করতে হবে? পৃথিবীর কোন বড় বর্ডারে এরকম অবৈধ যাতায়াত হয় না? কিন্তু বাংলাদের সীমান্ত ছাড়া আর পৃথিবীর আর কোথাও আপনি গুলি করে হত্যার ঘটনা দেখাতে পারবেন?’’
তৌহিদ হোসেন মনে করেন, ‘‘ভারত আমাদের ভালো বন্ধু বলেই সীমান্ত হত্যার কিরুদ্ধে আমাদের আরো শক্ত অবস্থান নেয়া উচিত৷ এখানে চুপচাপ থাকলে কোনো কাজ হবে না৷ বন্ধু বলে হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে নীরব থাকার সুযোগ নেই৷ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাহস করে সোজাসাপ্টা সত্য কথা বলে ফেলেছেন৷ ভালো করেছেন৷’’
তৌহিদ হোসেনের মতে, ‘‘ভারত আমাদের বন্ধু, শক্তিশালী বন্ধু, এই বিবেচনায় অনেক সময়ই আমরা ঘুরিয়েফিরিয়ে কথা বলি৷ আমি মনে করি, ভারত আমাদের বন্ধু বলেই আমাদের ঘুরিয়েফিরিয়ে না বলে সোজাসাপ্টা বলা উচিত৷ এতে পরস্পরের বোঝাপাড়া আরো ভালো হওয়ার সম্ভাবনা আছে৷ বরং কথা না বললে দূরত্ব সৃষ্টির আশঙ্কা বেশি৷বন্ধুর কষ্ট তো বন্ধুর বোঝা উচিত৷’’
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর হিসেবে ২০১৯ সালে সীমান্তে ৪৩ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন৷ তাদের মধ্যে গুলিতে ৩৭ জন এবং নির্যাতনে ছয় জন৷ এছাড়া আহত হয়েছেন ৪৮ জন এবং অপহৃত হয়েছেন ৩৪ জন৷ ২০১৮ সালে নিহত হয়েছেন ১৪ জন আর ২০১৭ সালে ২৪ জন৷ পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেও সীমান্তে হত্যা বেড়ে যাওয়ার কথা বলেছেন৷
মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও আইনের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান মনে করেন, সীমান্ত হত্যা নিয়ে ভারতের পররাষ্ট্র সচিবকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে কথা বলেছেন অতীতে বাংলাদেশের সরকারি পর্যায় থেকে এরকম কথা শোনা যায়নি৷ তাই পরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছ থেকে এই ধরনের কথা উৎসাহ জোগায়৷ তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথার জবাবে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব যা বলেছেন, তাতে তিনি অসন্তুষ্ট৷ তিনি বলেন, ‘‘ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বলেছেন, শুধু ভারতের দিকে নয়, সীমান্তে বাংলাদেশের দিকেও হত্যা হয়৷ বাস্তবতা তার কথার প্রমাণ দেয় না৷তিনি বলে দিলেন, আমাদের হাতেও ভারতীয় নাগরিকদের মৃত্যু হচ্ছে৷ এটা সত্য নয়৷ খুবই একপেশেভাবে সীমান্ত হত্যা হচ্ছে বছরের পর বছর ধরে৷ তিনি একটা সত্যকে এভাবে কথার মারপ্যাঁচে আড়ালের চেষ্টা করবেন, তা খুবই দুঃখজনক এবং অগ্রহণযোগ্য৷’’
ড. মিজানুর রহমানের মতে, ‘‘পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন বটে, কিন্তু এটা রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায় থেকেও বলতে হবে৷ আমাদের প্রধানমন্ত্রী যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বসেন, কথা বলেন, তখন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেন এভাবেই বার্তা দেন৷ তিন যেন এই বার্তাটি স্পষ্ট করে দেন যে, বছরের পর বছর এভাবে হত্যাকাণ্ড চলা বন্ধুত্বের প্রতিফলন হতে পারে না৷’’
গত অক্টোবরের ছবিঘরটি দেখুন...