‘সুন্দরবনের ক্ষতি হবে না’
১৩ ডিসেম্বর ২০১৪সুন্দরবনের আশপাশের নদীতে এবং ভিতরের খালে ছড়িয়ে পড়া তেল সরানোর কাজ এখনো চলছে স্থানীয় পদ্ধতিতে৷ এলাকার সাধারণ মানুষ ফোম বা অন্য কোনো উপায়ে ছড়িয়ে পড়া তেল সংগ্রহ করে ৩০ টাকা লিটার দরে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের কাছে বিক্রি করছেন৷ আর এই আর্থিক সুযোগ দেয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে তেল সংগ্রহে ব্যাপক সাড়াও পড়েছে৷ তাঁরা নৌকাযোগে হাড়ি-পাতিল নিয়ে যে যাঁর মতো ছড়িয়ে পড়া তেল সংগ্রহ করছেন৷
দুর্ঘটনা কবলিত অয়েল ট্যাংকার ‘ওটি সাউদার্ন স্টার-৭'-এ ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৬৬৪ লিটার ফার্নেস অয়েল ছিল এবং ট্যাংকারের তলদেশ ফেটে যাওয়ায় পুরো তেলই ১০০ কিলোমিটার এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে৷ কিন্তু গত দু'দিনে এর সামান্য পরিমাণ তেলই স্থানীয় পদ্ধতিতে অপসারণ সম্ভব হয়েছে৷
সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে কর্তৃপক্ষ
গত মঙ্গলবার ভোরে দুর্ঘটনা ঘটে এবং এরইমধ্যে চার দিন পার হয়ে গেলেও শুধু ট্যাংকারটি টেনে তোলা ছাড়া দুর্যোগ মোকাবেলায় কার্যকর কোনো পদ্ধতি চোখে পড়ছে না৷ ছড়িয়ে পড়া ফার্নেস অয়েলের কার্যকারিতা রোধে কোনো কেমিকেল ব্যবহার করা হবে কিনা – সে ব্যাপারে শনিবার অবধি সিদ্ধান্ত নেয়নি সরকার৷
সুন্দরবন (পশ্চিম) বিভাগীয় বন কর্মকর্তা জহির উদ্দিন আহমদ ডয়চে ভেলেকে জানান, বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ‘‘ফার্নেস অয়েলের কার্যকারিতা রোধে কেমিকেল ব্যবহার করা হলে সুন্দরবনের ইকোসিস্টেমের ওপর প্রভাব পড়তে পারে৷ এমনিতেই ফার্নেস অয়েলের কারণে সেখানে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গেছে৷ আবার যদি কোনো কেমিকেল ব্যবহার করা হয় তবে অক্সিজেনের পরিমাণ আরও কমে যাবে৷''
বিভাগীয় এই বন কর্মকর্তা বলেন, ‘‘আমরা এখন পর্যন্ত মনে করছি ম্যানুয়ালি যতটা তেল অপসারণ করা যায় তা করব৷ ন্যাচারালি এক থেকে ছয় সপ্তাহ পর তেল পানির নীচে পড়ে যাবে৷''
ফার্নেস অয়েলের প্রভাবে এরইমধ্যে জলজ প্রাণি ক্ষতির মুখে পড়ছে৷ মরে যাচ্ছে কাঁকড়া এবং কচ্ছপ৷ সুন্দরবন এলাকার নদীতে ইরাবতী ডলফিন দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না৷ আর গাছের ঠেসমূল জাপটে ধরেছে তেলের পুরু আস্তরণ৷ মাছও দুর্বল হয়ে পড়ছে৷ এর প্রভাব পড়বে অন্য স্থল ও জলজ প্রাণি এবং গাছপালার ওপর৷
‘সুন্দরবনের তেমন ক্ষতি হবে না'
নৌ-মন্ত্রী শাহজাহান খান অবশ্য দাবি করেছেন, তেলের প্রভাবে সুন্দরবনের তেমন ক্ষতি হবে না৷ শনিবার দুপুরে সুন্দরবন এলাকার জয়মনি নদীর তীরে দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে তদন্ত কমিটির সঙ্গে বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘তেলের কারণে সুন্দরবনে খুব বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না৷ ডলফিনেরও ক্ষতি হবে না৷ তেল বনের ভেতর বিস্তৃত হয়নি৷ খালের মুখে জাল (মাছধরা জাল) দিয়ে বাধা দেয়ায় তেল বনে ডুকতে পারেনি৷ ভাসমান তেল চলে যাচ্ছে, তাছাড়া স্থানীয়রা তেল উঠিয়ে নেয়ায় আস্তে আস্তে তেলের প্রভাব কমছে৷''
অন্যদিকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এ কে এম মাকসুদ কামাল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘অদক্ষতা এবং কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণে এরইমধ্যে সুন্দরবনের পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র হুমকির মুখে পড়েছে৷ শুধু স্বল্পমেয়াদেই নয় দীর্ঘমেয়াদেও এই ক্ষতি অব্যাহত থাকবে৷''
তিনি বলেন, ‘‘তেলের ট্যাংকার ডুবে যাওয়ার পর এটা যে ক্ষতির কারণ হতে পারে সে ব্যাপারে সজাগ করে গণমাধ্যম৷ শুরুতেই যদি সরকারের নীতি নির্ধারকরা বিষয়টি বুঝে ব্যবস্থা নিতে পারতেন তাহলে তেল ছড়িয়ে পড়তো না৷ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই ধরনের দুর্যোগ মোকাবেলায় কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হয়৷ আর আমরা চেয়ে চেয়ে দেখছি৷''
অধ্যাপক মাকসুদ কামাল বলেন, ‘‘এ নিয়ে কাজ করার জন্য সরকারে দক্ষ এবং যোগ্য লোকের অভাব আছে সত্য৷ তবে তার চেয়ে বড় অভাব হলো সচেতনতার৷ উদাসীনতা৷''
এই বিশেষজ্ঞ মনে করেন, সরকারে সক্ষম ও দক্ষ বিশেষজ্ঞ না থাকলেও সুন্দরবনের তেল বিপর্যয় প্রতিরোধে সক্ষম অনেক বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞ আছেন৷ তারা দেশের বাইরেও এ নিয়ে কাজ করেছেন৷ সরকারের উচিত হবে দ্রুত তাদের পরামর্শ নিয়ে এই বিপর্যয় মোকাবেলায় কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া, বলেন মাকসুদ কামাল৷