কিউবার ব্লগার সানচেস
১৩ মে ২০১৩সেন্সরশিপ প্রতিরোধের নানা উপায় জানাতে বিশ্বভ্রমণের অংশ হিসেবেই গত সপ্তাহে বার্লিনে হাজির হন ইওয়ানি সানচেস৷ এই ব্লগারের মুখ বন্ধ রাখতে অনেক চেষ্টাই করেছিল কিউবার কর্তৃপক্ষ৷ তাঁকে পেটানো হয়েছে৷ পুলিশ অনেকবার তাঁকে ধরেও নিয়ে গেছে৷ অবশ্য কিউবায় যারা স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে চান, তাদের জন্য এসব নিত্যদিনের ব্যাপার৷
সানচেস তাঁর দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন৷ ভবিষ্যতে তিনি তাঁর নাতিকে বলতে চান না যে, কিউবার শাসকগোষ্ঠীর দমনপীড়নের প্রতিবাদ তিনি করেননি৷ তাই প্রতিবাদের মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন ব্লগ৷ আর ইন্টারনেটে লেখালেখির কারণে কিউবার শাসকগোষ্ঠীর কাছে তাঁর পরিচয় ‘ভিন্নমতাবলম্বী, মিথ্যুক এবং বিদেশিদের ভাড়াটে সৈনিক'৷
‘জেনারেশন ওয়াই' শিরোনামের ব্লগে মূলত কিউবায় নিত্যদিনের জীবন নিয়ে লেখেন সানচেস৷ কাস্ত্রো পরিবার নিয়েও নানা কথা তিনি লিখেছেন৷ কিউবার শাসকগোষ্ঠীর খেপে যাওয়াটা তাই খুব স্বাভাবিক৷ ফলে সানচেস-এর উপর আরোপ হয় দেশত্যাগের নিষেধাজ্ঞা৷
চলতি বছরের শুরুতে পরিস্থিতি খানিকটা বদলে যায়৷ অনেকবার বিদেশ সফরের অনুমতি চেয়ে ব্যর্থ হওয়ার পর এবছর দেশত্যাগের অনুমতি পান সানচেস৷ এখন তিনি বিশ্ব সফরে রয়েছেন৷
ছদ্মবেশে হোটেলে
গত সপ্তাহান্তে বার্লিনে কথা হচ্ছিল সানচেস-এর সঙ্গে৷ টুইটারে তাঁর অনুসারীর সংখ্যা পাঁচ লাখের বেশি৷ এসব অনুসারীর বেশিরভাগের অবস্থান কিউবায়৷ তাহলে কি নিজের দেশে তেমন একটা জনপ্রিয় নন সানচেস? বিষয়টি আসলে সেরকম নয়৷ আসলে কিউবায় ব্যক্তিপর্যায়ে ইন্টারনেট সংযোগ নেওয়ার সুযোগ নেই৷ শুধুমাত্র সাইবার ক্যাফে আর হোটেলে ইন্টারনেট সহজলভ্য৷ ক্যাফেতে ঘণ্টা প্রতি ইন্টারনেট ব্যবহারের খরচ ছয় থেকে বারো মার্কিন ডলার৷ গড়ে মাসিক মাথাপিছু বিশ ডলার আয়ের একটি দেশে এত টাকা খরচ করে ইন্টারনেট ব্যবহারের সাধ্য অধিকাংশ মানুষেরই নেই৷ তাছাড়া সে দেশে ইন্টারনেটের গতি এখনো নব্বইয়ের দশকের মতো৷
এরকম পরিস্থিতিতে ইন্টারনেট ব্যবহারে একটু কৌশলী হতে হয়৷ সানচেস বার্লিনে আলাপচারিতার মাঝেই জানালেন তাঁর কৌশলের কথা৷ খানিকটা জার্মান জানেন তিনি৷ এই জার্মান কাজে লাগিয়ে নিজের দেশে বিদেশি পর্যটকের ছদ্মবেশে হোটেলে উঠতেন তিনি৷ এরপর হোটেলের ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবহার করে ইন্টারনেটে প্রবেশ করতেন৷
সানচেস দু'বছর সুইজারল্যান্ডেও বসবাস করেছেন৷ সেসময় অবশ্য ইন্টারনেটে প্রবেশে সমস্যা ছিল না৷ তবে কিউবায় বসে টুইটার ব্যবহারের এক উপায়ের কথাও জানিয়েছেন তিনি৷ সানচেস এবং অনেকে কিউবা থেকে মোবাইল মেসেজ আকারে ইউরোপের কোন দেশের মোবাইলে পাঠান টুইটার বার্তা৷ এরপর ইউরোপের সেই নম্বর হয়ে টুইটারে চলে যায় সেই বার্তা৷ সরকারি সেন্সরশিপের মধ্যে থেকেও ইন্টারনেটে তথ্য পাঠানোর এক ভালো উপায় এটি৷ কিন্তু সমস্যা ছিল অন্যত্র৷ এই প্রক্রিয়া ‘ইন্টারঅ্যাক্টিভ' নয়৷ অর্থাৎ শুধু মেসেজ পাঠানো যায়, কিন্তু সেই মেসেজ কোথায় পৌঁছালো কিংবা প্রতিক্রিয়াই বা কি হলে, সে সম্পর্কে কিছু জানা যায় না৷
ইউএসবি স্টিকের ক্ষমতা
ইন্টারনেট ব্যবহারের সীমাবদ্ধতা মোকাবিলায় আরো অনেক পথ খুঁজে নিয়েছেন সানচেস৷ কিউবায় ঘরে বসে ল্যাপটপে অফলাইনে নিবন্ধ লিখেছেন তিনি৷ এরপর ইউএসবি স্টিকে ভরে সেই লেখা তুলে দিয়েছেন বিশ্বস্ত কারো হাতে৷ সেই বিশ্বস্ত ব্যক্তি সুযোগ বুঝে তা প্রকাশ করেছেন ইন্টারনেটে৷
এরকম নানা উপায়ে ব্লগ লিখেছেন, লিখছেন সানচেস৷ বার্লিনে রি:পাবলিকা সম্মেলনে এক আলোচনায় কিউবা সফরে আগ্রহী পর্যটকদেরকে একটি অনুরোধ করেছেন এই ব্লগার৷ তা হচ্ছে, পর্যটকরা সম্ভব হলে যেন পুরনো ল্যাপটপ, মুঠোফোন সঙ্গে নিয়ে যান৷ এরপর কিউবার রাস্তায় কোন সাধারণ নাগরিককে যেন সেগুলো দিয়ে আসেন৷ এ ধরনের সহায়তা এখন কিউবার জনগণের বড় প্রয়োজন৷
অবশেষে পুরস্কার গ্রহণ
বার্লিনের রি:পাবলিকা সম্মেলনে গত মঙ্গলবার ডয়চে ভেলের সেরা অনলাইন অ্যাক্টিভিজম অ্যাওয়ার্ড ‘দ্য বব্স' ২০১৩ এর বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়৷ সেই অনুষ্ঠানে ইওয়ানি সানচেস-এর হাতে পুরস্কার তুলে দেন ডয়চে ভেলের প্রধান সম্পাদক উটে শেফার৷ এই পুরস্কারটি তাঁর পাওয়ার কথা ছিল ২০০৮ সালে, কিন্তু সেসময় কিউবার কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে জার্মানি সফরের অনুমতি পাননি তিনি৷ তাই পাঁচ বছর পর সম্মাননা গ্রহণ৷
বিদেশ সফরের অনুমতি পেলেও সানচেস এখনো কিউবার কর্তৃপক্ষের নজরদারির মধ্যেই আছেন৷ তাঁর গতিবিধির প্রতি গোপনে নজর রাখছে তারা, এমনটাই মনে করেন সানচেস৷ দিনকয়েক আগে তিনি ইটালিতে এক সম্মেলনে বক্তব্য রাখার সময় একদল কিউবান অবজ্ঞাসূচক ধ্বনি করতে থাকে৷ এক পর্যায়ে সেই সম্মেলন কক্ষের দর্শকের সারি থেকে কিউবার দলটিকে সরিয়ে দেওয়া হয়৷
সরকারের নজরদারি নিয়ে অবশ্য ভীত নন ইওয়ানি সানচেস৷ স্বাধীনভাবে নিজের মত প্রকাশের ক্ষেত্রে কোন বাধাই মানবেন না তিনি৷ বরং নিজের অবস্থার কথা নিয়মিত জানাবেন গোটা বিশ্বের মানুষের মাঝে৷ সেই লক্ষ্যেই এগিয়ে যাচ্ছেন সানচেস৷