সোশ্যাল নেটওয়ার্কে স্কুল ছাত্রদের ধর্ষণ-পরিকল্পনা
৫ মে ২০২০তাদের বয়স ১৫-১৬ বছর। দক্ষিণ দিল্লির নামী স্কুলের ছাত্র। তারা ইনস্টাগ্রামে একটা চ্যাট গ্রুপ তৈরি করেছিলো। আর সেখানেই বেশ কিছু ছাত্র অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের ছবি দিয়ে তাঁকে গণধর্ষণ করা নিয়ে আলোচনা করছিল। সেই গ্রুপের এক নতুন সদস্য এই সব কার্যকলাপ ফাঁস করে দেয় একটি মেয়ের কাছে। সেই সাহসিনী বিষয়টা প্রকাশ্যে নিয়ে আসেন ও সামাজিক মাধ্যমে ওই গ্রুপের আলোচনার স্ক্রিনশট প্রকাশ করে দেন। তারপর স্কুলের তরফে পুলিশকে জানানো হয়, তাঁরা এরকম একটি অভিযোগ পেয়েছেন। এটা যেন তদন্ত করে দেখা হয়। পুলিশ সাইবার ক্রাইম শাখার সাহায্য নেয়। তদন্তে নেমে ওই গ্রুপের অন্যতম প্রধান চরিত্র ১৫ বছরের একটি ছেলেকে আটক করা হয়েছে। তার কাছ থেকে ২২ জনের নাম ও ফোন নম্বর পেয়েছে পুলিশ। তাদেরও জেরা করা হবে। ইতিমধ্যে সাইবার আইন ভঙ্গ, জালিয়াতি, মেয়েদের মর্যাদাহানি সহ বিভিন্ন অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছে। ইনস্টাগ্রামকে বলা হয়েছে, তারা যেন এ ব্যাপারে সব তথ্য পুলিশকে দেয়।
ভারতে সম্প্রতি বেশ কয়েকটা ঘটনায় দেখা গিয়েছে, অপ্রাপ্তবয়স্করা ধর্ষণ ও গণধর্ষণের সঙ্গে জড়িত ছিল। নির্ভয়া-কাণ্ডেও ধর্ষণকারীদের মধ্যে একজন অপ্রাপ্তবয়স্ক ছিল। সম্প্রতি মধ্যপ্রদেশে ১৮ বছর বয়সী একটি মেয়েকে গণধর্ষণকরা হয়েছে। সেখানেও গণধর্ষণকারী সাতজনের মধ্যে তিনজন অপ্রাপ্তবয়স্ক। আর অপ্রাপ্তবয়স্করা এরকম গুরুতর অপরাধ করার পরেও লঘু শাস্তি পায়। নির্ভয়ায় ধর্ষণকারী চারজনের সম্প্রতি ফাঁসি হয়েছে। কিন্তু অপ্রাপ্তবয়স্ক বলে আরেক ধর্ষক তিন বছর জেল খেটে ছাড়া পেয়ে গিয়েছে। অথচ, নির্ভয়ার ওপর সেই সব চেয়ে বেশি অত্যাচার করেছিল বলে অভিযোগ।
অপ্রাপ্তবয়স্কদের বিচার জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ডে হয়। সেখানে ধর্ষণের সব চেয়ে বেশি সাজা হলো তিন বছর জেল। এই লঘু শাস্তির কারণেই কি অপ্রাপ্তবয়স্করা ধর্ষণ করার, ধর্ষণের পরিকল্পনা করার সাহস পায়? এ নিয়ে সংসদে প্রচুর বিতর্ক হয়েছে। নির্ভয়ার ঘটনার পর জুভেনাইল জাস্টিস আইন সংশোধনকরা হয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে, ১৬ থেকে ১৮ বছর বয়সীরা যদি ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ করে, তা হলে তাদের প্রাপ্তবয়স্ক বলে ধরে নিয়ে বিচার করতে হবে।
প্রশ্নটা হলো, অপ্রাপ্তবয়স্কদের এই ধরনের অপরাধ প্রবণতা কেন দেখা যাচ্ছে? ছোটদের মনস্তত্ত্ব নিয়ে কাজ করেন লিপিকা ভট্টাচার্য। ডয়চে ভেলের কাছে তাঁর ব্যাখ্যা, ''গোটা বিশ্ব এখন সেনসেশনের ওপর চলছে। সকলে এখন গুরুত্ব পেতে চায়। গুরুত্ব পেতেই তাঁরা সেনসেশন তৈরি করে। এই বাচ্চারা বয়ঃসন্ধির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে তারা যাচ্ছে। এই বাচ্চারা অপরাধ করবে বলে এই কাজটা করেনি। সেনসেশন তৈরি করে বন্ধুদের মধ্যে নিজেদের ক্ষমতা জাহির করতেই এ কাজ তারা করেছে। এবং অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। এ ভাবেই বাচ্চাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা গড়ে উঠতে শুরু করে।''
আবার মনোসমাজবিদ মোহিত রণদীপ ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ''আসলে সমাজে এই বিষয়গুলি সর্বক্ষণ ঘটে চলেছে। টিভি থেকে ইন্টারনেট, এমনকী অনেক সময় পরিবারের ভিতরেও বাচ্চারা দেখছে নারীকে পণ্য হিসেবে দেখা হচ্ছে। সেটা তাদের মাথায় ঢুকে যাচ্ছে। তার বহিঃপ্রকাশ ভয়াবহ হলে আলোচনা হয়। তারপর আবার তা স্তিমিত হয়ে যায়। এই ক্ষেত্রেও ভয়াবহ বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। এর থেকে বাচ্চাদের বের করে আনার জন্য অনেকে নানা ধরনের শিক্ষার কথা বলেন। আমরা সেগুলিকে গুরুত্ব দিই না। ঘটনা ঘটলে বোঝা যায়, সেই শিক্ষা কতটা জরুরি।''
এই অপরাধের পরেও দিল্লির নামী স্কুলের ওই বাচ্চারা পার পেয়ে যাবে। কারণ, অধিকাংশের বয়সই ১৫ বছর। সে ক্ষেত্রে তাদের জুভেনাইল জাস্টিস আইন অনুসারেই বিচার হবে। সেন্টার ফর সোশ্যাল রিফর্মস বা সিএসআরের ডিরেক্টর রঞ্জনা কুমারী ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ''এই বাচ্চারা দিল্লির অভিজাত স্কুলে পড়ে, পয়সাওয়ালা ঘর থেকে এসেছে। এই সব স্কুলে অনেক ঝাড়াই বাছাই করে বাচ্চাদের নেওয়া হয়। তারপর তাদের কী শিক্ষা দেওয়া হয়েছে? বাড়িতেই বা তারা কী মূল্যবোধের শিক্ষা পেয়েছে? এই বয়সে তারা কী করে এই ধরনের অপরাধের দিকে চলে যাচ্ছে? মেয়েদের ছবি পোস্ট করে ধর্ষণের পরিকল্পনা করা থেকে বোঝা যাচ্ছে, অসুখ কতটা গভীরে চলে গিয়েছে। এদের বাড়িতেও এতটাই স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে যে, তারা যা খুশি তাই করতে পারে। ওরা ফুটপাথে ঘুমন্ত মানুষের ওপর গাড়ি চালিয়ে দিতে পারে।''
সাইবার আইন বিশেষজ্ঞ পবন দুগ্গল ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ''চাইল্ড পর্নোগ্রাফিও অপরাধ। বয়েস লকার রুমে ওরা মেয়েদের ছবি পোস্ট করত, তারপর নানা ধরনের অনুচিত ও বেআইনি কথা বলতো। ফলে তারা আইন ভেঙেছে। অভিযুক্তরা অপ্রাপ্তবয়স্ক হলে জুভেনাইল জাস্টিস আইন অনুসারে বিচার হবে। আর প্রাপ্তবয়স্ক হলে স্বাভাবিক আইন অনুসারে বিচার হবে।''
জিএইচ/এসজি(পিটিআই, এএনআই, এনডিটিভি)