স্তন ও জরায়ু মুখের ক্যানসার: আমাদের করণীয়
২৭ আগস্ট ২০১৮চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির প্রেক্ষাপটে আমরা জানি যে, স্তন এবং জরায়ু মুখের ক্যানসারে আক্রান্ত নারীদের ম্যামোগ্রাফি এবং রেডিওথেরাপির মতো কিছু ডায়গনিস্টিক এবং চিকিত্সা সেবা দেয়া সম্ভব৷ বিশেষ করে প্রাথমিক অবস্থার ক্যানসার মোকাবিলা করার জন্য এসব সেবা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে৷ কিন্তু এই চিকিৎসাপদ্ধতি অনেক ব্যয়বহুল হওয়ার কারণে প্রতি বছর লাখো নারীর মৃত্যু হয়৷
গবেষকরা বলছেন, এ প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এগিয়ে না এলে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশের নারীদের এই প্রাণঘাতী রোগ থেকে বাঁচানো মুশকিল হবে৷ গবেষকরা তাই আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টার আহ্বান জানাচ্ছেন, যাতে করে ২০৩০ সালের মধ্যে স্তন এবং জরায়ু মুখের ক্যানসার প্রতিরোধে এবং মৃত্যুর হার কমানোর ক্ষেত্রে উন্নতি সাধন করা যায়৷
জরায়ু মুখ ক্যানসার প্রতিরোধে করণীয়
জরায়ু মুখে ক্যানসার বিশ্বব্যাপী নারী মৃত্যুর অন্যতম কারণ৷ বাংলাদেশেও প্রতি বছর প্রায় ১৮ হাজার নারী নতুন করে জরায়ু মুখ ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন এবং প্রতি বছর প্রায় ১২ হাজার নারী এই ক্যানসারে মৃত্যু বরণ করেন৷
প্যাপ টেস্ট নামের একটি পরীক্ষার মাধ্যমে জরায়ু মুখের কোষের পরিবর্তন নির্ণয় করা হয়৷ ‘ব্রাশ' অথবা ‘স্পেকুলাম' নামক সরঞ্জাম জরায়ু মুখে প্রবেশ করিয়ে জরায়ু থেকে কোষ সংগ্রহ করা হয় এবং তা পরীক্ষার জন্য ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয়৷ জরায়ু কোষে যে কোনো ধরনের পরিবর্তন ধরা পড়লেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দ্রুত সুনিদির্ষ্ট চিকিৎসা শুরু করতে পারেন, যাতে ভবিষ্যতে রোগীটির ক্যানসারে আক্রান্ত হবার আশঙ্কা না থাকে৷
যৌন সংস্পর্শ জরায়ু মুখের ক্যানসার ছড়ানোর প্রধান কারণ৷ যৌন সক্রিয় প্রতিটি নারীই তাই এই ঝুঁকির আওতাভুক্ত৷ যৌন সক্রিয় সকল নারীর দৈহিক মিলন শুরুর তিন বছর পর থেকে বছরে একবার প্যাপ টেস্ট করা প্রয়োজন৷ যদি পরপর তিনটি পরীক্ষার ফলাফলে কোনো সমস্যা চিহ্নিত না হয়, সেক্ষেত্রে প্রতি তিন বছরে একবার প্যাপ টেস্ট করা যেতে পারে৷ মেনোপজ অথবা জরায়ুর আংশিক অপসারণের পরেও প্যাপ টেস্ট অব্যাহত রাখা প্রয়োজন৷ তবে সত্তরোর্ধ নারীদের জন্য যদি বিগত দশ বছরে পর পর তিনটি পরীক্ষার ফলাফলে কোনো সমস্যা না থাকে, তাহলে তাঁদের আর প্যাপ টেস্ট করার প্রয়োজন নেই৷ গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রেও চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্যাপ টেস্ট করা যেতে পারে৷
জরায়ু মুখের ক্যানসার কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়৷ হিউম্যান প্যাপিলোমা নামক একটি ঘাতক ভাইরাস এই রোগের প্রধান কারণ৷ সাধারণত অধিকাংশ নারীই জীবদ্দশায় একাধিকবার এইচপিভি ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়৷ একজন নারীর সহজাত প্রতিরোধ ক্ষমতা বা কনডমের ব্যবহার কখনোই এই ইনফেকশনের বিরুদ্ধে স্থায়ী প্রতিরোধ হিসেবে কাজ করতে পারে না৷ সম্প্রতি জরায়ু মুখ ক্যানসার প্রতিরোধে অতি কার্যকর টিকা আবিষ্কৃত হয়েছে৷ পর পর তিন ডোজ টিকা, নিয়মিত প্যাপ টেস্টের মাধ্যমে স্ক্রিনিং, চিকিৎসকের পরামর্শ এবং সাবধানতা জরায়ু মুখের ক্যানসার প্রায় সম্পূর্ণরূপে প্রতিরোধ করতে পারে৷
স্তন ক্যানসার প্রতিরোধে করণীয়
নারীদের অন্যতম আর একটি ক্যানসার হলো স্তন ক্যানসার৷ সারা বিশ্বের নারীদের প্রতি ৮ জনের মধ্যে একজন স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত৷ বাংলাদেশেও প্রতি বছর প্রায় ২২ হাজার নারী নতুনভাবে স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছে এবং প্রায় ১৭ হাজার নারী স্তন ক্যানসারে মৃত্যুবরণ করছে৷ যে কোনো বয়সের নারীই স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হতে পারেন৷ তবে মাঝ বয়সি নারীদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি৷ বয়স বাড়ার সাথে সাথে ঝুঁকিও বাড়ে৷ সাধারণত পঞ্চাশোর্ধ্ব নারীদের স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে৷
পারিবারিক ইতিহাস না থাকলেও স্তন ক্যানসার হতে পারে৷ এছাড়া বিআরসি এ -১ এবং বিআরসি এ -২ জিন দু'টির বিবর্তন বা মিউটেশনের কারণেও স্তন ক্যানসার হতে পারে৷ স্তন ক্যানসার প্রতিরোধে সর্বপ্রথম যে জিনিসটির প্রয়োজন, তা হলো নারীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা৷ নিয়মিত ব্রেস্ট স্ক্রিনিং করতে হবে৷ ২০ বছর বয়স থেকে প্রত্যেক মহিলার উচিত স্তনের সুস্থতা সম্পর্কে সচেতন হওয়া৷ এজন্য প্রতি মাসে মাসিক শেষ হওয়ার ৫ম থেকে ৭ম দিনের যে কোনো দিন তাঁকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বা গোসলের সময় স্তন ও বগলের নিচের অংশ পরীক্ষা করতে হবে এবং যে কোনো সমস্যা থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে৷ ৪০ বছর বয়স থেকে প্রত্যেক নারীর বছরে একবার ম্যামোগ্রাম নামের বিশেষ পরীক্ষাটি করাতে হবে৷ সম্ভব না হলে স্তনের আল্ট্রাসনোগ্রাম করা যেতে পারে৷ এছাড়া, এই বয়সকালে বছরে একবার অন্তত চিকিৎসক দিয়ে স্তন পরীক্ষা করাতে হবে৷ নিয়ন্ত্রিত ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, নিয়মিত স্তন পরীক্ষা এবং নির্দেশনা অনুযায়ী ম্যামোগ্রাম করলে স্তন ক্যানসার প্রতিরোধ এবং প্রাথমিক অবস্থার রোগ নির্ণয় করা সম্ভব৷
বিশ্বব্যাপী সার্বজনীন স্বাস্থ্য কর্মসূচী বাস্তবায়ন করা এবং এক্ষেত্রে স্থায়ী উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনের জন্য নারীদের স্তন ক্যানসার এবং জরায়ু মুখের ক্যানসার চিকিৎসায় আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে৷ বিশেষত নিম্ন এবং মধ্যম আয়ের দেশে নারীদের জরায়ু মুখ ও স্তন ক্যানসার চিকিৎসায় সার্বিক সহায়তা করা প্রয়োজন৷
নিম্ন এবং মধ্যম আয়ের দেশে এই দু'টি ক্যানসারের ভয়াবহতার মাত্রা এবং প্রকৃতি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের অভাব রয়েছে৷ জরায়ু মুখ ও স্তন ক্যানসারের প্রকৃত চিত্র পাওয়ার জন্য এক্ষেত্রে যথেষ্ট উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন৷ লক্ষ লক্ষ নারী প্রতি বছর বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছেন৷ তাঁদেরকে সাশ্রয়ী মূল্যে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা দেয়া প্রয়োজন, যাতে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী নারীরা এই দু'টি ঘাতক ব্যাধির ভয়াবহতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে৷