1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

স্পেতসেসের বাতাসে আজও ওড়ে সুগন্ধী মশলার ঘ্রান

৩১ জুলাই ২০১০

পুব থেকে আসত সেইসব দুর্লভ, সুগন্ধী অপরূপ মশলা৷ দারুচিনি, জিরা, জাফরান বা হিং-এর সুগন্ধ বাতাসে ভেসে থাকে আজও ক্ষনিকের জন্য ৷ মশলারা সেদিন আসত ইটালিয় জাহাজে৷ দ্বীপটা কিন্তু গ্রিসের সমুদ্রসীমায়৷ নাম তার স্পেতসেস৷

https://p.dw.com/p/OZ1s
শ্বাস বন্ধ করেই তাকে দেখতে হচ্ছে দূর থেকে, এতটাই সুন্দরী দ্বীপ সেছবি: picture alliance/Rainer Hackenberg

স্পেতসেস৷ মানে হল স্পাইসেস৷ মশলারা৷ সে অনেক আগের কথা৷ ভূমধ্যসাগরের নীল জলে চারদিক মোড়া একটা খাড়া পাহাড় ছোট্ট দ্বীপের চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল৷ তার বুকেই সেই ১৩০০ খৃস্টাব্দে গড়ে উঠেছিল বন্দর৷ পুব থেকে আসা সুগন্ধী মশলারা সেখানে নামত, তারপর আবার চলে যেত গোটা ইউরোপের পথে, জাহাজে ভেসে৷

ইটালিয়রাই নাম দিল স্পেতসেস৷ দ্বীপটা কিন্তু গ্রিসের মানচিত্রে৷ রাজধানী এথেন্সের পেরিয়ুস সমুদ্রবন্দর থেকে ফ্লাইং ডলফিনে সওয়ার হলে সে আপনাকে দুই ঘন্টা বিশ মিনিটে প্রায় উড়িয়ে নিয়ে যাবে নীল জলের ওপর দিয়ে৷ উড়িয়ে নেবে বলছি কারণ জলের ওপর এই জলযান দুশো যাত্রী নিয়ে যেভাবে স্কিয়ের সাহায্যে জল ছুঁয়ে যায়, তাতে একে দুর থেকে দেখলে মনে হয় জাহাজটা বুঝি উড়েই যাচ্ছে৷

তো, এই জাহাজ যেখানে গিয়ে থামল, শ্বাস বন্ধ করেই তাকে দেখতে হচ্ছে দূর থেকে৷ এতটাই সুন্দরী দ্বীপ সে৷ দ্বীপে কোন গাড়ি চলার অনুমতি নেই, স্পেতসেসের পথে তাই ঘোড়ায় টানা রঙিন টাঙার ছড়াছড়ি৷ কচিৎ কদাচিৎ এক আধটা মোটরবাইকের ভোঁভোঁ, টাঙ্গার টুংটাং নূপুর, আর সমুদ্রের ছলাচ্ছল ঢেউ৷ পথ উড়ে গেছে পাহাড়ের ছোটখাটো ঢাল বেয়ে বেয়ে৷ আঁকাবাঁকা সেই পথের ওপরে নিচে বাড়িঘরদোরের দাঁড়ানো যেন অযাচিত বিভঙ্গের মত৷ আর সব ছোটবড় বাড়িতেই রঙিন বাগানের বুকে কিছু প্রজাপতির সারি৷

ITB Berlin 2010 Flash-Galerie
অস্তসূর্যের আবীর সেখানে এবার ধুসরে ঢাকা পড়তে থাকেছবি: picture alliance / ZB

বেলাভূমি অনুগত স্পেতসেসের বড়রাস্তাটি সমুদ্রের সঙ্গেই আধখানা চাঁদের মত বাঁক খেয়ে নতুন বন্দর থেকে নিয়ে চলে যায় পুরানো বন্দরে৷ যেখানে সেই সাতশো বছর আগে এসে থামত মশলার জাহাজেরা৷ পুরানো বন্দরের গা ঘেঁষে দেশবিদেশের ইয়টের সারি৷ আর শ্যাওলাধরা বাতিঘরের মাথায় বসে থাকা সন্ধানী বাজপাখির চোখে ধূসর স্মৃতির ছায়া৷

স্মৃতির মতই অলিগলিময় স্পেতসেসের বিপনি সারণি৷ মাথার ওপর চাঁদোয়ার ছায়া, পাথরে বাঁধানো প্রাচীন দিনের উঁচুনিচু পথের দোকানপাটে ঝিনুক থেকে মুক্তো সবেতেই সমুদ্রের ভিজে গন্ধ৷ মাঝে মাঝে পানীয়চুমুকের বিরতি, মাঝে মাঝে এতোলবেতোল হাওয়া, মাঝে মাঝে বাতাস টেনে আনে অতীতদিনের সুগন্ধী জাফরানের গন্ধ৷

রাত করেই নামে সন্ধ্য৷ ভূমধ্যসাগরের দ্বীপে সূর্য পাটে নামেন অনেক দেরিতে৷ ঘড়ি যখন সাড়ে আটটা বলছে৷ তারপর উচ্ছল অনাবিল রাত নেমে আসে চুপি চুপি৷ পাহাড়ের মাথা থেকে একটা পা সে রাখে দুর্গের চুড়ায়৷ তার পরের পাটা আরেকটু বেড়ে এগিয়ে যায় দূর সমুদ্রের দিকে৷ অস্তসূর্যের আবীর সেখানে এবার ধুসরে ঢাকা পড়তে থাকে৷ আর সেই প্রায় ধূসর গভীর সমুদ্র থেকে বন্দরের দিকে মুখ ঘোরায় একটা শাদা জাহাজ৷ দ্বীপ থেকে তাকে তখনও ছোট্ট একটা ফুটকির মত দেখায়৷

Deutschland Insel Mainau Bodensee Flash-Galerie
স্পেতসেস, মানে হল স্পাইসেস, মশলারাছবি: Mainau GmbH

আলোগুলো জ্বলে উঠছে৷ টাঙ্গার গায়ে চৌখুপি আলো, ছোট্ট নৌকোর টেমি লন্ঠনটি, জ্বলে উঠেছে পথবাতিরা, হাল্কা হলুদ হয়ে জ্বলে ওঠা আলোরা, রেস্তোঁরার আলোর মালারা এবার সমুদ্রের কালো জলে প্রতিফলিত হচ্ছে৷ জ্বলে উঠেছে পশ্চিমের আকাশে আরেকটা গোল রুপোলি বাতি৷ ওঃ! আজ তো চতুর্দশী৷ কাল পূর্ণিমা৷ চাঁদের ভরা যৌবন যে আজ! মায়াবী সেই আলো চারপাসকে ক্রমশ আরও অবিশ্বাস্য করে দিতে থাকে৷

স্পেতসেসের মশলাগন্ধী বাতাসে ততক্ষণে ধীর লয়ে এক পথশিল্পীর মনকেমন করানো ভায়োলিনের আওয়াজ মিশে যাচ্ছে৷ চেনা চেনা সুর৷ গ্রাম থেকে আসা এক বোকা যুবক তার শহুরে প্রণয়িনীকে বলছে, ‘তোমার হাসির মধ্যে কী যে আছে, আমি চোখ ফেরাতে পারিনা৷'...সুরটা চেনা চেনা লাগে, কারণ, গ্রিক লোকগান আর আমাদের লোকগানের ভাষা ছাড়া আর কোনকিছুতেই তেমন পার্থক্য নেই৷ একরকম প্রাণদোলানো সুর, একরকম ভাবভঙ্গি৷ সেই সুর শুনতে শুনতেই রাত ক্রমশ ডানা মেলে নেমে আসে৷ কালো থেকে ঘনকালো হয়ে যায় সাগরের জল৷

সাগরের বুকে ততক্ষণে ভেসে এসেছে আরেকজন৷ মাঝসমুদ্রে মুখ ফেরানো সেই ঝকঝকে শাদা জাহাজ৷ বন্দরে ভিড়েছে তার মানুষেরা সকলে৷ অনেকদিন পর আবার প্রিয় মাটিতে পা৷ প্রিয় পৃথিবীর কাছে ফিরে আসা৷ ফিরে আসা উষ্ণতার কাছে৷ জীবনের ছন্দের কাছে৷

মশলার গ্রিক দ্বীপ স্পেতসেস সেই ঘরে ফেরা মানুষদের বুকে টেনে নেয়৷ তার পায়ের কাছে আছড়ে পড়তে থাকে সমুদ্রের অক্লান্ত ঢেউ৷

প্রতিবেদন: সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়

সম্পাদনা: আরাফাতুল ইসলাম