নিঃশেষ হচ্ছে স্বচ্ছ জলের ভাণ্ডার
২৪ মে ২০১৮যুক্তরাষ্ট্রের নাসা এবং জার্মানির অ্যারো-স্পেস সেন্টারের এক যৌথ প্রকল্পে উঠে এসেছে এই তথ্য৷ জানা গেছে, যে সব দেশে জলের অত্যধিক ব্যবহারের ফলে ভূগর্ভস্থ স্বচ্ছ জলের ভাণ্ডার বিপদের মুখে, ভারত তার অন্যতম৷ স্বচ্ছ জলের লভ্যতা ক্রমশই উদ্বেগজনকভাবে কমে যাচ্ছে এ দেশে৷
‘নেচার' পত্রিকায় প্রকাশিত এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, জলের যথেচ্ছ ব্যবহার, জলবায়ুর পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক বিবর্তনের ফলে আর্দ্র এলাকা আরও বেশি আর্দ্র হয়ে উঠছে এবং খরাপ্রবণ এলাকা হয়ে উঠছে আরও বেশি শুকনো৷
বিশ্বের অনেক দেশের মতো ভারতের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে এর অন্যতম কারণ গম ও ধান চাষে ভূগর্ভস্থ জলের অত্যধিক ব্যবহার৷ এমনকি সারা বছর স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হওয়া সত্ত্বেও৷ ভূগর্ভে যে পরিমাণ জল চুঁইয়ে পড়ে তার থেকে অনেক বেশি পরিমাণ জল খরচ হয়৷ অর্থাৎ মজুতের চেয়ে খরচ বেশি৷ ফলে ভবিষ্যতে খরার আশঙ্কা তৈরি হয়৷ প্রায় ১৪ বছর ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাসা এবং জার্মান অ্যারো-স্পেস সেন্টারের যৌথ প্রকল্পে এই তথ্য সামনে এসেছে৷ বিশ্বের ৩৪টি অঞ্চলে একাধিক উপগ্রহ পর্যবেক্ষণে সামনে এসেছে এই তথ্য৷ একাধিক উপগ্রহ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এই ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা বিশ্বে এই প্রথম৷ ইউরেশিয়ার ৩৩টি দেশের মধ্যে ৫০ শতাংশ দেশে একই ধরনের জলসংকট৷ আর ভারতের অবস্থা আরও খারাপ৷ বিজ্ঞানিরা এর কারণ সম্পর্কে বলেছেন, ভারতের ৮০ শতাংশ সংরক্ষিত এলাকা, অর্থাৎ যেসব এলাকা প্রকৃতি ও জৈব-বৈচিত্র্যের জন্য সংরক্ষিত, সেইসব এলাকা মানুষের বিভিন্ন কাজকর্মের দরুণ খুবই চাপের মুখে৷ যেমন রাস্তাঘাট তৈরি, গবাদি পশুর চারণ ভূমি এবং নগরায়ণ৷
গোদের ওপর বিষ ফোঁড়ার মতো স্বচ্ছ জল বা পানির ঘাটতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভূগর্ভস্থ জলে আর্সেনিকের বিষক্রিয়া, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের ২৪-পরগণা অঞ্চলে৷ চিকিত্সা বিজ্ঞানে যার নাম আর্সেনিকোসিস৷ পশ্চিমবঙ্গের ন'টি জেলায় আনুমানিক এক কোটি মানুষ আর্সেনিক দূষিত জল খেয়ে নানা ধরনের রোগের কবলে৷ জলে আর্সেনিকের বিপদ সম্পর্কে একাধিক টাস্কফোর্স সরকারকে সতর্ক করা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সরকার যথেষ্ট তত্পরতা দেখায়নি৷ আর্সেনিক এক নিঃশব্দ যমদূত, অর্থাৎ ‘সাইলেন্ট কিলার’৷ বাচ্চা বুড়ো কাউকেই রেহাই দেয় না আর্সেনিক৷ ক্ষতি করে দেহের ভেতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ৷ যেমন ফুসফুস, কিডনি ইত্যাদি৷ এছাড়া শিশুদের ক্ষেত্রে মেধা বা বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশও ব্যাহত করে আর্সেনিক৷
এই বিষের প্রধান কারণ অগভীর নলকূপ৷ কারও কারও মতে, কীটনাশক৷ রাজ্য সরকার ২০০৭ সাল পর্যন্ত প্রায় লাখ দেড়েক অগভীর নলকূপের জল পরীক্ষা করে দেখেছে বটে, কিন্তু তা চিহ্নিত করেনি৷ পরিবর্তে সরকার বসিয়েছে বিকল্প নলকূপ৷
পশ্চিমবঙ্গে ভূগর্ভস্থ জলে আর্সেনিক দূষণজনিত পরিস্থিতি নিয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ গবেষণা বিভাগের বিজ্ঞানী তড়িত রায়চৌধুরী৷ তিনি জানান, উত্তর ২৪-পরগণার ২২টি ব্লকের মধ্যে ২১টি ব্লকের ভূগর্ভস্থ জলে আর্সেনিক পাওয়া গেছে৷ তাঁর কথায়, ‘‘গবেষণায় দেখেছি আর্সেনিকের মাত্রা সবথেকে বেশি কম পাইপের অগভীর নলকূপে৷ অগভীর মানে ২০ ফুট, ৩০ ফুট, ৪০ ফুট থেকে ১০০ ফুট পর্যন্ত৷ এমনকি ৩০০ ফুটেও পেয়েছি৷ দেখেছি এর থেকে বেশি গভীর হলে আর্সেনিকের মাত্রা তুলনামূলকভাবে কম হয়৷ কিছু কিছু বিশেষ ভৌগলিক এলাকায়, যেমন গাইঘাটা, দেগঙ্গা ব্লকে গভীর নলকূপ নেই৷ সঠিক সংখ্যা জানা না থাকলেও আর্সেনিক আক্রান্ত বহু রোগী পেয়েছি সেখানে৷ কেউ কেউ মারা গেছেন, কেউ আবার মরে বেঁচে আছেন৷
আর্সেনিক বিষক্রিয়ার লক্ষণ কী জানতে চাইলে তড়িত রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘গোটা শরীরে ছোপ ছোপ দাগ৷ যাবার সময় দেহের ভেতরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে রেখে যায় ক্ষতচিহ্ন৷ হাতের চেটোয় ছোপ ছোপ দাগকে বলা হয় কেরাটোসিসি৷ পায়ের তলায় হলে সেটাকে বলি মেলানোসিস৷ এটার শেষ পরিণতি বিভিন্ন টাইপের ক্যানসার৷ আসলে এর ওষুধ সেই অর্থে কিছু নেই৷ বিশুদ্ধ জলপান করা ছাড়া৷’’
এর প্রতিকারে সরকার কী ব্যবস্থা নিয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘বিজ্ঞানী হিসেবে বলতে পারি, বিকল্প ব্যবস্থা কিছু কিছু নেওয়া হয়েছে৷ আর্সেনিক টাস্কফোর্স কাজ করছে৷ পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করছে৷ সার্ভে করে পাইপলাইন ওয়াটার ট্রিটমেন্ট জলসাপ্লাই করছে, বিশেষ করে গঙ্গার জল৷ আমাকে যদি বলা হয়, এর প্রতিকারে কী করণীয়, তাহলে ভূগর্ভস্থ জলে যে আর্সেনিক বিষ আছে, প্রথমেই সে বিষয়ে মানুষকে সচেতন করে তোলার কথা বলবো৷ তবে এটাও ঠিক, অনেক সময় দেখেছি জেনে শুনেও রান্না-বান্নায় আর্সেনিকযুক্ত জল ব্যবহার করা হচ্ছে৷ আসলে আর্সেনিকের বিষক্রিয়া কতটা বিপজ্জনক সে বিষয়ে মানুষ এখনও অজ্ঞানতার অন্ধকারে৷ তাদের এটা ভালো করে বোঝানো দরকার যে, এটা বিষজল৷ অর্থাৎ আমরা এটা খাব না৷’’