স্বত্ব সংরক্ষণে ভারতে ‘প্রথাগত জ্ঞানের ডিজিটাল গ্রন্থাগার’
১ জানুয়ারি ২০১০স্বত্ব সুরক্ষার লক্ষ্যে ঔষধি ফলের রসের চিকিৎসা থেকে শুরু করে যোগাসন পর্যন্ত ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় ওষুধপ্রত্র এবং প্রথাগত চিকিৎসা জ্ঞানের এক বিশাল ডিজিটাল তথ্যভাণ্ডার গড়ে তুলছে তাঁরা৷ এ উদ্যোগ সফল হলে সর্বসাধারণ যেমন এই জ্ঞানভাণ্ডারের সুফল পাবে অন্যদিকে শত শত বছর ধরে চর্চিত জ্ঞান নিয়ে দু'একটি কোম্পানির একচেটিয়া ব্যবসাও বন্ধ করা সহজ হবে৷
‘‘আমাদের জ্ঞান নিয়ে নেওয়ার, তা পুনপ্রক্রিয়াজাত করার এবং নিজেদের বলে দাবি করার অধিকার বিশ্বে অন্য কারোরই নেই৷''
এভাবেই প্রথাগত জ্ঞানস্বত্ত্বে নিজেদের অধিকারের কথা তুলে ধরছিলেন ভারতের সর্বোচ্চ বিজ্ঞান গবেষণা সংস্থা ‘কাউন্সিল অফ সায়েন্টিফিক এন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ' বা ‘সিএসআইআর'-এর ভি. কে. গুপ্ত৷
‘ট্র্যাডিশনাল নলেজ ডিজিটাল লাইব্রেরি' (টিকেডিএল) বা ‘প্রথাগত জ্ঞান ডিজিটাল গ্রন্থাগার' প্রকল্পের প্রধানের দায়িত্বে রয়েছেন গুপ্ত৷ বার্তা সংস্থা এএফপিকে গুপ্ত বলছিলেন, এই ডিজিটাল তথ্যভাণ্ডার ভারতের প্রাকৃতিক চিকিৎসাশাস্ত্রের ওপর ভর করে দাবি করা নানা কোম্পানির ‘ভুল পেটেন্ট' প্রতিরোধে সুলভ এবং সহজ উপায় হতে পারে৷
২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রথম জনসমক্ষে আসা এ উদ্যোগের প্রাথমিক পর্যায়েই সাফল্য পেয়েছে ভারত৷ জুলাই মাসে দুটি বিদেশি কোম্পানির স্বত্ব দাবি বাতিল করে দিতে সক্ষম হয়েছে তাঁরা৷ ভারতে প্রচলিত তরমুজের নির্যাস থেকে তৈরি একটি ত্বকের ক্রিম এবং পেস্তাবাদাম থেকে তৈরি ক্যান্সারের ওষুধে স্বত্ব দাবি করেছিল ওই কোম্পানিদু'টো৷
এছাড়া আরও ৩০টি এমন স্বত্বদাবির ঘটনায় বিশ্বব্যাপী নানা কোম্পানির সঙ্গে ভারতের লড়াই চলছে৷ ভারতে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে প্রাকৃতিক চিকিৎসায় এসব জ্ঞানের প্রচলন এবং এর পক্ষে নানা তথ্যপ্রমাণ তুলে ধরে এই তথ্যভাণ্ডার বিশ্ব দরবারে এটা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে যে, এসব বিষয়ে ভিন্ন কোনো দেশের কোনো কোম্পানিকে স্বত্ব বা একচেটিয়া ব্যবসায়িক অধিকার দেওয়ার এখতিয়ার কারও থাকতে পারে না৷
এই গ্রন্থাগারেরের তথ্যভাণ্ডারে ইতোমধ্যেই যুক্ত হয়েছে প্রায় ৩ কোটি পৃষ্ঠার তথ্যউপাত্ত৷ যেখানে ভারত এবং বিশ্বের অন্যত্র উদ্ভাবিত এবং চর্চিত আয়ুর্বেদ, ইউনানি, সিদ্ধ ও যোগ সাধনার মতো কলাকৌশল এবং প্রাকৃতিক চিকিৎসাশাস্ত্রের দুই লাখ নিয়মকানুন-বিধিবিধান লিপিবদ্ধ করা হয়েছে৷
ভাগবত গীতা, বেদ, উপনিষদ থেকে শুরু করে সংস্কৃত, ফার্সি, তামিল এমনকী ইংরেজিসহ অন্যান্য ভাষায় ভারতের সমৃদ্ধ প্রাচীন গ্রন্থাবলীতে চিরুনি অভিযান চালাচ্ছেন এবং সেখান থেকে তথ্যসংগ্রহ করে সংরক্ষণ ও ভাষান্তর করছেন এই প্রকল্পের গবেষকরা৷
এসব প্রাচীন জ্ঞানভাণ্ডারের যেসব অংশকে পেটেন্ট করতে হবে তা চিহ্নিত করে সেসব সাঙ্কেতিক ভাষায় রূপান্তর এবং ডিজিটাল তথ্যভাণ্ডারে সংযুক্তকরণের কাজ চলছে বলেও জানান তাঁরা৷
১৯৯৭ এবং ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে নিমপাতা ও হলুদের ঔষধি ব্যবহারের পেটেন্ট করা নিয়ে ‘বায়োপাইরেসি' প্রশ্নটি সামনে চলে আসে এবং ভারত ও বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যেমের প্রচারণায় স্থান করে নিয়ে এই বিতর্কটি বাড়তে থাকে৷
ভারতের বিজ্ঞান গবেষণা সংস্থা সিএসআইআরসহ নানা প্রতিষ্ঠান ওই উদ্যোগকে চ্যালেঞ্জ করে এবং শেষপর্যন্ত এ বিষয়ে পেটেন্ট বাতিল করতে বাধ্য হয় সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো৷ নিমপাতা ও হলুদের এই ঔষধি ব্যবহার কোনোভাবেই মৌলিক উদ্ভাবন নয় এবং ভারতসহ বহু স্থানেই তা যুগ যুগ ধরে প্রচলিত বলে স্বীকার করে নিয়ে ওই পেটেন্ট বাতিল করা হয়েছিল৷
গত বছরের জুলাইতে চর্মরোগের একটি ক্রিমের বিষয়ে একটি স্পেনীয় কোম্পানিকে দেওয়া পেটেন্ট বাতিল করে ইউরোপীয় পেটেন্ট অফিস৷ ভারতে বদ্যিকবিরাজ থেকে সাধারণ গৃহবধূরা শত শত বছর ধরে ওই চিকিৎসা চর্চা করে আসছেন বলে প্রমাণ পাওয়ার পর তা বাতিল করা হয়৷
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পশ্চিমের দেশগুলোসহ বহুস্থানে ভারতের এসব প্রাকৃতিক চিকিৎসা জ্ঞান সম্পর্কে কোনো ধারণা না থাকাটাও পেটেন্ট সংকটের অন্যতম কারণ৷
ভারতের ‘প্রথাগত জ্ঞান ডিজিটাল গ্রন্থাগার' একটি নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়ে এই সংকট অনেকটাই কাটিয়ে উঠতে পারে বলেও আশা করা হচ্ছে৷ এই ‘টিকেডিএল' প্রকল্প ইতোমধ্যেই জাপান এবং ইউরোপের পেটেন্ট সংস্থাগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষর করেছে৷ এর ফলে কোনো কোম্পানিকে এ ধরণের কোনো বিষয়ে পেটেন্ট দেওয়ার আগে এই গ্রন্থাগারের তথ্যভাণ্ডারের সহায়তা নেওয়ার এবং তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করে নেওয়ার সুযোগ পাবে সংশ্লিষ্টরা৷
এক্ষেত্রে চূড়ান্তভাবে কোনো স্বত্বপ্রদান বা বাতিলের বিষয়ে যে মূলনীতিটি মেনে চলা হবে তা হল এমন তথ্যপ্রমাণ নিশ্চিত হওয়া যে, আবেদন করা স্বত্বের বিষয়টি নতুন বা মৌলিক আবিষ্কার কিংবা তা একটি প্রচলিত জ্ঞান হিসেবে কোনো জাতি বা সম্প্রদায়ে বহু সময় ধরে চর্চিত হয়ে আসছিল৷
প্রতিবেদন: মুনীর উদ্দিন আহমেদ
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক