স্বাধীনতা দিবসে মোদীবিরোধী বিক্ষোভ, সংঘর্ষ
২৬ মার্চ ২০২১নরেন্দ্র মোদীর আগমনেরপ্রতিবাদে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ এলাকা শুক্রবার রণক্ষেত্রে পরিণত হয়৷
গত শুক্রবারও বায়তুল মোকাররম মসজিদ এলাকায় জুমার নামাজের পর মোদীবিরোধী বিক্ষোভ হয়েছে৷ আর তা করেছিল কিছু ইসলামি দল৷ তবে সেদিন তাদের বিক্ষোভ ছিল শান্তিপূর্ণ৷ কিন্তু আজ ইসলামি দলগুলোর নেতা-কর্মীদের মসজিদের বাইরেই বের হতে দেয়নি পুলিশ৷ ফলে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে৷ পুলিশের সাথে লাঠি নিয়ে অনেক বহিরাগতকেও দেখা গেছে৷ তারা মোদীবিরোধীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়৷ দু পক্ষের সংঘর্ষে আহত হয়েছেন অনেকে৷
বুহস্পতিবারও পরিস্থিতি উত্তপ্ত ছিল৷ মতিঝিল ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় মোদীবিরোধীদের মিছিলে হামলা হয়েছে৷ সন্ধ্যায় শাহবাগ এলাকায় মশাল মিছিলেও হামলা হয়েছে৷ কিছু ইসলামি দল ও হেফাজতে ইসলাম ছাড়াও বামপন্থিদের বড় একটি অংশ এই মোদীর ঢাকা সফরের বিরুদ্ধে৷ বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নূরের অনুসারীরাও৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বৃহস্পতিবারের হামলার জন্য ছাত্রলীগকে দায়ী করা হচ্ছে৷
এই পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সাংবাদিক রাজীব নূর বলেন, ‘‘একজন অতিথি এসেছেন, তাকে তো সম্মান জানানোই উচিত৷ কিন্তু গুজরাটে নরেন্দ্র মোদী যা ঘটিয়েছেন, সেটা তো আমাদের স্মৃতিতে আছে৷ মোদী এর আগেরবার (২০১৫ সালে ঢাকা সফর) বক্তৃতায় অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলেছেন৷ তখন আমি লিখেছিলাম গুজরাটের খুনি আমাদের অসাম্প্রদায়িকতা শেখায়৷ মোদী অসাম্প্রদায়িতার কথা বলে, সম্প্রীতির কথা বলে আর আমাদের সীমান্তে মানুষ মারে৷ তার এই দ্বৈত নীতির তো প্রতিক্রিয়া হবেই৷ সেই প্রতিক্রিয়া হচ্ছে৷’’
রাজীব নূর আরো বলেন, ‘‘এমন একটি দেশের প্রধানমন্ত্রীকে আমরা আমাদের স্বাধীনতা দিবসে আমন্ত্রণ জানিয়েছি যে দেশের মানুষ আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে অনেক বড় ভূমিকা রেখেছেন৷ কিন্তু মোদী, তার সরকার ও তার দল কি সেই চেতনাকে ধারণ করে? ফলে স্বাভাবিকভাবেই বিরোধিতা হবে৷’’
তবে তিনি জানান, এই বিরোধিতাকারীদের ব্যাপারে তার পর্যবেক্ষণ আছে৷ তার মতে, ‘‘এক গ্রুপ আছে যারা আমার মতো মন থেকে বিরোধিতা করেন, চেতনার জায়গা থেকে বিরোধিতা করেন৷ আরেক গ্রুপ আছে যারা সাম্প্রদায়িক৷ তারা সাম্প্রদায়িকতার কারণে বিরোধিতা করেন৷ তারা নিজেরাও সাম্প্রদায়িক৷ তারাই আবার মোদীর সাম্প্রদায়িকতারও বিরোধিতা করেন৷’’
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনা তার সাথে নরেন্দ্র মোদীর অবস্থান এবং কাজ যায় কিনা- এমন প্রশ্নও উঠছে৷ এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, ‘‘নরেন্দ্র মোদীর অবস্থান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক৷ তিনি একটি হিন্দুত্ববাদী দলের নেতা৷ তিনি যদি কোনো গণতান্ত্রিক দলের নেতা হতেন, তাহলে এই বিরোধিতা হতো না৷ গুজরাট দাঙ্গায় এক হাজারের বেশি মুসলমান নিহত হন৷ নরেন্দ্র মোদী ছিলেন তার মাস্টারমাইন্ড৷ দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর তিনি নাগরিকত্ব আইন করে প্রায় ২০ কোটি মুসলমানকে নাগরিকত্বহীন করতে চান৷ তার দেশেও তিনি নানা সমালোচনার মুখে রয়েছেন৷’’
তার মতে, এটা ব্যক্তি নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ৷ ডনাল্ড ট্রাম্প ও বারাক ওবামা তো এক না৷ ইয়াহিয়া- আইয়ুব খান আর পাকিস্তানের কোনো গণতান্ত্রিক শাসক তো এক না৷ বলা হচ্ছে, তিনি সরকার প্রধান হিসেবে এসেছেন৷ কিন্তু তাতে তার যে বিতর্কিত কাজ, উগ্রপন্থা ও চরমপন্থাকে উসকে দিচ্ছে, তা তো মুছে যচ্ছে না৷
তবে তিনি মনে করেন, যারা রাস্তায় নেমে এই বিরোধিতা করছেন, তাদের মধ্যে একটা সমস্যাও আছে৷ কারণ, তাদের একটি অংশ দ্বিচারিতা করছে৷ তারাও সাম্প্রদায়িক এবং উগ্রবাদী৷ কিন্তু অসাম্প্রদায়িক চেতনা যারা ধারণ করেন, তারাও মোদীর এই সফরের বিরোধিতা করছেন৷
শহীদ বুদ্ধিজীবীর সন্তান জাহিদ রেজা নূরের চিন্তা একটু ভিন্ন৷ তিনি মনে করেন, ‘‘মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বন্ধু ছিল ভারত ও রাশিয়া৷ স্বাধীনতার ৫০ বছরে কোনো দেশকে আমন্ত্রণ জানানো হলে সবার আগে এই দুই দেশের কথাই তো ভাবা হবে৷’’
‘‘আমরা জানি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী একজন কট্টর হিন্দুত্ববাদের প্রতীক৷ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী, এখন নরেন্দ্র মোদী৷ এখন সেখানে কোন ধরনের শাসন চলছে সেটা বিবেচনার বিষয় হতে পারে না৷ এটা হলো একটি রাষ্ট্রকে সম্মান জানানো৷ আমাদের ভালোবাসার প্রকাশ,’’ বলেন তিনি৷
তার মতে, ‘‘জিয়াউর রহমানের সময় থেকে ভাবনা শুরু হয়ে মুসলমানিত্বের পরাজয় হয়েছে৷ এখন অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে হাসাহাসি করা হয়, গণতন্ত্র নিয়ে হাসাহাসি করা হয়৷ বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনা নষ্ট হয়ে গেছে ষড়যন্ত্র এবং ব্যর্থতায় শুরুতে গণতন্ত্রের বীজ ঠিকমতো বুনতে না পারায়৷’’
তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশে একটি পরিবর্তন হচ্ছে৷ কট্টর রক্ষণশীলতা প্রবল হচ্ছে৷ আমাদের সংস্কৃতি কাটছাট হচ্ছে৷ যাত্রাপালার জায়গায় ওয়াজ ঢুকে গেছে৷ যে ওয়াজের ৭০ ভাগ হলো নারী দেহের বর্ণনা এবং মিথ্যাচার৷ আপনি যদি স্বাধীনভাবে সত্যি কথা বলেন, আর সেটা যদি ধর্ম সংক্রান্ত হয়ে থাকে, তাহলে আপনাকে ধর্ম অবমাননায় ঢুকিয়ে দেয়া হবে৷’’ তার মতে, এই কট্টরপন্থিরাই এখন শক্তিশালী হচ্ছে৷ তাদের আবার সরকারি এবং বেসরকারি সব দিক থেকেই তৈল মর্দন করা হচ্ছে৷