1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

স্বাধীনতার এত বছর পরও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক

রেজোয়ান হক রাজা ঢাকা
২৬ মার্চ ২০১৯

আর মাত্র দু’বছর পর, ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করবে বাংলাদেশ৷ অথচ দেশের স্বাধীনতার ইতিহাস নিয়ে দুর্ভাগ্যজনক বিতর্ক এখনও শেষ হয়নি৷ এক কথায় বললে এর মূল কারণ রাজনীতি৷

https://p.dw.com/p/3FZAL
ছবি: Journey/M. Alam

প্রথমে রাজনৈতিক গণ-আন্দোলন, তারপর সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে জন্ম নেয়া এই দেশটি তার বেড়ে ওঠার সময় ক্রমাগতভাবে রাজনৈতিক বিভক্তির মধ্যে দিয়ে এগিয়েছে, যা এখন আর শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই – প্রশাসন, ডাক্তার, প্রকৌশলী, আইনজীবী, সাংবাদিকসহ পেশাজীবী বিভিন্ন সংগঠন, এমনকি বিচার বিভাগেও এ বিভক্তি ষ্পষ্ট৷ তাই প্রায় সবকিছুর বিশ্লেষণই যার যার রাজনৈতিক আদর্শ বা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে করা হয়, যা থেকে স্বাধীনতার ইতিহাসও রেহাই পায়নি৷ 

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সবচেয়ে গৌরবময় এবং গুরুত্বপূর্ণ অংশ মুক্তিযুদ্ধের কয়েকটি বিষয় নিয়ে বিতর্ক এই রাজনৈতিক বিভক্তি উসকে দিয়েছে৷ স্বাধীনতা আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর এর বড় সুবিধাভোগী জেনারেল জিয়াউর রহমানের গড়া দল বিএনপির কিছু দাবি এ বিতর্কের সূচনা করে৷ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে বঙ্গবন্ধু তাঁর ধানমন্ডির বাড়ি থেকে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে গ্রেপ্তার হবার আগ মুহূর্তে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন – আওয়ামী লীগের পাশাপাশি দেশ-বিদেশের নানা তথ্য-উপাত্ত এই দাবিটিই সমর্থন করে৷ তবে জন্মের পরপরই রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের একক আধিপত্য চ্যালেঞ্জ করে আসা বিএনপির দাবি বঙ্গবন্ধু নয়, স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন তৎকালীন মেজর জিয়া, ২৭শে মার্চ চট্টগ্রামে কর্মরত অবস্থায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পক্ষ-ত্যাগ, অর্থাৎ বিদ্রোহের পর কালুরঘাট রেডিও স্টেশনে গিয়ে৷ এই দিনটি যে ২৭শে মার্চ ছিল তা বরাবরই বলে এসেছেন ঐ সময় মেজর জিয়ার সঙ্গে থাকা কয়েক সহকর্মী, যারা পরে তাঁর দলে যোগ দিয়েছিলেন, যেমন জেনারেল মীর শওকত, কর্নেল অলি প্রমুখ৷ কিন্তু স্বাধীনতা দিবস যেহেতু ২৬শে মার্চ পালিত হয়ে আসছে, তাই তার সঙ্গে সাযুজ্য রাখতে ২০০১ থেকে ২০০৬ মেয়াদের বিএনপির আমলে দিনটি এগিয়ে এনে সেটি ২৬শে মার্চ ছিল বলে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হয়েছিল, স্কুলের পাঠ্যবইতে ছাপানোও হয়েছিল, তবে শেষ পর্যন্ত তা টেকেনি

মেজর জিয়া ওইদিন স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন ঠিকই, তবে তা বঙ্গবন্ধুর পক্ষে৷ তাঁর স্বকণ্ঠের সেই ঘোষণার অডিও রেকর্ড এখনো রয়েছে৷ আওয়ামী লীগ তাই বলে – জিয়া ছিলেন স্বাধীনতার ঘোষণার পাঠক মাত্র৷ তবে এটি ঠিক যে, সাধারণ মানুষের কাছে জিয়ার এই ঘোষণা অন্যরকম আবেদন তৈরি করেছিল৷ কারণ, তিনি ছিলেন সেনা কর্মকর্তা আর সেনাবাহিনীর বাঙালি কর্মকর্তা-সৈনিকরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে রয়েছে, এটি জানতে পেরে মানুষ আশ্বস্ত হয়েছিল৷ পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি যতটা জনপ্রিয় হতে পেরেছিলেন, তাতে সাহায্য করেছিল তাঁর এ রকম একটি ‘দেশপ্রেমিক ইমেজ'৷ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত দেশের প্রথম সরকার মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য যেসব মুক্তিযোদ্ধাকে নানা খেতাবে ভূষিত করেছিল, তার মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ খেতাব বীর উত্তম পেয়েছিলেন জিয়া৷ কিন্তু তাঁর গড়া দল বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক এখন এতটাই তিক্ত যে, দলটির নেতাদের কেউ কেউ এখন জিয়া মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক বাহিনীর চর ছিলেন বলে অভিযুক্ত করছেন৷ বড় দল দু'টো এভাবেই স্বাধীনতা সংগ্রাম, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়েছে৷

স্বাধীনতার ঘোষণার সঙ্গে জিয়াউর রহমান জড়িত ছিলেন বলে তাঁকে ঘোষক দাবি করার কিছুটা ভিত্তি থাকলেও মুক্তিযুদ্ধে শহিদদের সংখ্যা নিয়ে একাধিকবারের প্রধানমন্ত্রী, বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া যে বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন, তার সমর্থনে কোনো যুক্তিই নেই৷ বছরখানেক আগে এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতায় তিনি বলে বসেন, মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ নয়, ৩ লাখ মানুষ নিহত হয়েছে৷ ৩০ লাখ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি – এই বাক্যটি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথমদিন থেকেই উচ্চারিত হচ্ছে৷ হতে পারে সংখ্যাটি পুরোপুরি সঠিক নয়৷ ঐ সময় সঠিক হিসেব করা সম্ভবও ছিল না৷ বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া খবর থেকে সত্যের কাছাকাছি আনুমানিক এই সংখ্যাটি স্থির হয়েছে এবং এটি অনেক আগেই প্রতিষ্ঠিত৷ মীমাংসিত এই বিষয়টি নিয়ে বেগম জিয়া কেন বিতর্ক সৃষ্টি করলেন, তা তাঁর দলের অনেক নেতার কাছেও বোধগম্য নয় বলে ব্যক্তিগত আলাপে জেনেছি৷ মুক্তিযুদ্ধে শহিদদের সংখ্যা ৩০ লাখের পরিবর্তে ৩ লাখ হলে বিএনপির কী সুবিধা হবে তা ভেবেও কুল কিনারা পাচ্ছেন না কেউ-ই৷ বরং এই বিতর্ক তোলায় বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে হওয়া মামলার সংখ্যা একটি বেড়েছে৷ কোনো যুদ্ধে শহিদদের সংখ্যা নিয়ে মীমাংসিত বিষয়ে অহেতুক বিতর্ক তোলা এবং এ নিয়ে মামলার ঘটনা পৃথিবীর আর কোথাও ঘটেছে বলে আমার জানা নেই৷

স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব দিয়েছিল বলে এর কৃতিত্ব দলটি সঙ্গত কারণেই দাবি করতে পারে৷ স্বাধীনতার সাত বছর পর ১৯৭৮ সালে বিএনপি গঠন করার সময় মুক্তিযোদ্ধা হয়েও জিয়া তাঁর দলে স্বাধীনতাবিরোধীদের অনেককে নিয়েছিলেন, রাষ্ট্রপতি হিসেবে সংবিধান সংশোধন করে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজনীতি করার সুযোগ ফিরিয়ে দেয়ার মাধ্যমে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামীকে পুনর্বাসন করেছেন – এ রকম অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে৷ তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া দলের হাল ধরার পর জামায়াতে ইসলামীকে রাজনৈতিক মিত্র হিসেবে বেছে নেন, ঘরে-বাইরে অনেক সমালোচনার পরও যা এখনো বহাল রয়েছে৷ এসব মিলিয়ে বিএনপিকে ‘পাকিস্তানপন্থি' হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টাও করা হয়ে থাকে৷ এ অপবাদ কাটাতে বিএনপির নেতারা তাঁদের দলকে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডারের দল হিসেবে উল্লেখ করেন, কখনো কখনো ছেলেমানুষির মতো দাবি করেন তাঁদের দলে সবচেয়ে বেশি মুক্তিযোদ্ধা আছে৷ 

মুক্তিযোদ্ধা, যাঁদেরকে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বলা হয়, তাঁদের স্বীকৃতি দেয়া নিয়েও বিতর্ক রয়েছে এবং বিষয়টি অমীমাংসিত রয়ে গেছে এ রকম পালটাপালটির কারণে৷ বড় এই দল দু'টি যে যখন ক্ষমতায় এসেছে তখনই মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা বদল অথবা সংশোধন হয়েছে৷ গত ৪৭ বছরে ছ'বার মুক্তিযোদ্ধা তালিকা সংযোজন-বিয়োজন হয়েছে৷ মুক্তিযোদ্ধার বয়স, সংজ্ঞা ও মানদণ্ড পাল্টেছে ১১ বার৷ আগামী ২৬শে মার্চ আরেকটি মুক্তিযোদ্ধা তালিকা প্রকাশ করার ঘোষণা দিয়েছে সরকার৷ ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ আরেক মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এ পর্যন্ত নতুন করে সরকারি গেজেটভুক্ত হয়েছেন ৩৫ হাজার ৪৮৯ জন৷ একই সময়ে ভাতা পাওয়া মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১ লাখ থেকে বেড়ে ১ লাখ ৮৬ হাজার হয়েছে৷জনপ্রতি ভাতার পরিমাণ, ২০০৯ সালে ছিল ৯০০ টাকা আর এখন ১০ হাজার৷ এই ভাতা এবং আরো কিছু সুযোগ-সুবিধা পাবার কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় বারবার পরিবর্তন এসেছে৷

Bangladesch Journalist Rejoan Haq
রেজোয়ান হক রাজা, সাংবাদিকছবি: facebook/Shipon Halder

মুক্তিযোদ্ধাদের পাকা বাড়ি তৈরি করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় ঋণ দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার৷ সরকারের পরিকল্পনা হচ্ছে, প্রত্যেককে ১০ লাখ টাকা করে বিনা সুদে ঋণ দেওয়া৷ এছাড়া দেশের রাস্তাঘাটগুলোর নামকরণ মুক্তিযোদ্ধাদের নামে করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে৷ ভারতের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে বিনা খরচে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দেয়ার৷ এর আওতায় প্রতি বছর নির্দিষ্ট সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা ভারতে যাবেন৷ সবচেয়ে বড় সুবিধা ছিল সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা বা তাঁদের পোষ্যদের কোটা৷ সরকারি চাকরিতে থাকা মুক্তিযোদ্ধারাও দু'বছর বেশি চাকরিতে থাকার সুবিধা পেয়েছেন, এখনো পাচ্ছেন৷ এসব সুবিধা পাবার কারণে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম তোলার জন্য প্রতিযোগিতা চলেছে, অনেকে মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও নানা উপায়ে এবং প্রভাবশালীদের পৃষ্ঠপোষকতায় এ তালিকায় অন্তর্ভূক্ত হতে সক্ষম হয়েছেন৷

প্রশ্ন হচ্ছে, স্বাধীনতা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা – এসব বিষয়ে তোলা,থাকা এবং বাড়িয়ে চলা বিতর্ক কি বন্ধ হবে না? সমাজ যেভাবে বহুধা বিভক্ত, প্রধান দুই রাজনৈতিক ধারা যেভাবে বিবাদে লিপ্ত, তাদের মধ্যে সম্পর্ক যেরকম তিক্ত এবং তা যেভাবে বেড়েই চলেছে, তাতে এসব ক্ষেত্রে মতৈক্যে পৌঁছানো দুরুহ৷ বেশ আগে একবার আলোচনা উঠেছিল নিরপেক্ষ ইতিহাসবেত্তাদের নিয়ে একটি কমিশন গঠন করে তাঁদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঠিক ইতিহাস লিখতে বলা হোক৷ কিন্তু এমন ‘নিরপেক্ষ' ব্যক্তি বাংলাদেশে থাকলেও তাঁরা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবেন এমন নিশ্চয়তা দেয়া যায় না৷

১৯৯১ সালে দেশে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারা পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির মধ্যেই ক্ষমতার পালাবদল হচ্ছে৷ নিকট ভবিষ্যতে এ ধারার পরিবর্তনের কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না৷ তাই এই দুই দল যতক্ষণ কিছু বিষয়ে ন্যূনতম সমঝোতায় না পৌঁছাচ্ছে, ততক্ষণ ইতিহাসের বিকৃতি বন্ধ হবার কোনো আশা নেই৷

প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য