পথে পথে দুধ, ফল, সবজি!
৬ জুন ২০১৮নরেন্দ্র মোদী সরকারকে চাপে রেখে নিজেদের দাবি আদায়ের জন্য গত ১ জুন থেকে ১০ দিনের হরতাল শুরু করেছে কয়েকটি রাজ্যের কৃষক সংগঠন৷ ৭টি রাজ্যে ইতিমধ্যেই আন্দোলন শুরু করেছে তারা৷ অত্যধিক প্রভাব পড়েছে মহারাষ্ট্রসহ উত্তর ভারতের সাতটি রাজ্যে৷ তবে, বিন্দুমাত্র হেলদোল নেই সরকারের৷ শাক-সবজি, ফল ও দুধের জোগান প্রায় বন্ধ৷ পথে ছুঁড়ে ফেলা হচ্ছে উৎপাদিত পণ্য৷ ওদিকে চাহিদা অনুযায়ী জোগান না মেলায় বাজারে হু হু করে দাম বাড়ছে৷ চূড়ান্ত নাজেহাল আম জনতা৷ মূল্যবৃদ্ধিতে নাভিশ্বাস উঠেছে সাধারণ মানুষের৷
রাজ্য বা কেন্দ্র সরকার কৃষকদের জন্য কোনও প্যাকেজ ঘোষণা তো দূর, বরং বিক্ষোভকে কটাক্ষ করে ‘অসম্মানজনক' মন্তব্য করেছেন খোদ কৃষিমন্ত্রী৷ সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে কৃষিমন্ত্রী রাধামোহন বলেছেন, ‘‘সংবাদমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই অহেতুক বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন কৃষকরা৷'' তাঁর এমন মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় রাস্তায় দুধ ঢেলে প্রতিবাদে শামিল হয়েছেন বিভিন্ন রাজ্যের কৃষকরা৷ রাষ্ট্রীয় জনতা দলের মুখপাত্র মনোজ ঝা বলেছেন, ‘‘কৃষক যখন হতাশ, তখন চোখ বন্ধ করে রেখেছেন কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী৷ তাঁকে অবিলম্বে বহিষ্কার করা উচিত৷'' নির্দিষ্ট সময়ের চার দিন আগেই পাঞ্জাবের কৃষক সংগঠনগুলি হরতাল প্রত্যাহার করে নিয়েছে৷ পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে তা ঠিক করতে রাজ্যের মোট ১৭২টি কৃষক সংগঠন বৈঠকে বসছে বলে জানিয়েছেন ‘ভারতী কিসান ইউনিয়ন'-এর রাজ্য সভাপতি বলবীর সিং৷ তবে, জানা গেছে, মূলত দুধ বিক্রেতাদের লোকসানের কথা মাথায় রেখেই এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন তাঁরা৷
কয়েকটি রাজ্যে কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে অবশ্য ভিন্নমত বামপন্থি সংগঠন ‘সারা ভারত কৃষক সভা'-র সর্বভারতীয় নেতা হান্নান মোল্লাহর৷ ডয়চে ভেলেকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘‘গত তিন বছর ধরে বামপন্থি সংগঠনগুলি দেশজুড়ে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে যে তীব্রতর আন্দোলন চালিয়ে আসছিল, মহারাষ্ট্রের কিসান লং মার্চের পর ইদানীং সরকারি স্তরে তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে৷ দিন কয়েক আগে রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের সঙ্গে দেখা করে স্মারকলিপিও জমা দিয়েছে একটি প্রতিনিধি দল৷ আমরা সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছি কৃষকের স্বার্থ রক্ষার্থে সংসদে নতুন একটি বিল আনার জন্য৷ সরকার বিবেচনার আশ্বাসও দিয়েছে৷ এই পরিস্থিতিতে আচমকা কয়েকটি রাজ্যের গুটি কয়েক সংগঠন আন্দোলন শুরু করেছে৷ আমাদের সব আন্দোলনের প্রতি সমর্থন আছে৷ কিন্তু, সরকারি মদতে আন্দোলন করে সংবাদমাধ্যমকে ভুল বোঝানো আর প্রকৃত দাবি আদায়ের লড়াই মোটেই এক নয়৷ যেভাবে কৃষিজ পণ্য ও দুধ রাস্তায় ফেলে ছবি তোলা হচ্ছে, তা নিন্দনীয়৷ এটা কাম্য নয়৷ এইভাবে দাবি আদায় করা সম্ভব নয়৷''
রাস্তায় গড়াগড়ি খাচ্ছে সবজি৷ দুধ রাস্তায় ঢেলে দেওয়া হচ্ছে৷ সংবাদমাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে এই ছবি ছড়িয়ে পড়েছে গোটা বিশ্বে৷ লিটার লিটার দুধ রাস্তায় ফেলার ঘটনায় সমাজে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে৷ কৃষকের আন্দোলনে সহমর্মিতা দেখালেও সবজি, ফল ও দুধ নষ্টের সমালোচনা করছেন বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ৷ অভুক্ত শিশু ও মানুষের কথা স্মরণ করাচ্ছেন কেউ কেউ৷ দাবি আদায়ে খাদ্যশষ্য বা সবজি নষ্টে সায় নেই সমাজের একটা অংশের৷ তবে, আন্দোলনকারীরা বলছেন, এমনটা করা হচ্ছে সরকারের নজর কাড়ার উদ্দেশ্যে৷
বিক্ষোভের পেছনে কংগ্রেসের মদতের অভিযোগ উঠলেও কংগ্রেস অবশ্য সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছে৷ তাদের দাবি, বিক্ষোভ স্বতঃপ্রণোদিত৷ পাঞ্জাব, মহারাষ্ট্র ও হরিয়ানাসহ বিভিন্ন রাজ্যের সড়কে দুধ, ফল ও সবজি ফেলে দিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করছে কৃষকরা৷ আন্দোলনকারীকৃষকদের বক্তব্য, বনধের কর্মসূচিতে টানা ১০ দিনকোনও কৃষিজ পণ্য বিক্রি করবেন না তাঁরা৷ এমনকি কৃষিজ পণ্য যেখানে উৎপন্ন হয়, সেই গ্রামীণ এলাকা থেকে শহর এলাকায় সবজি ও অন্যান্য কৃষিজ উৎপাদন পরিবহনেও বাধা দেবেন তাঁরা৷ তাঁদের দাবি, কৃষিঋণ মকুব করতে হবে৷ নূ্ন্যতম বিক্রয়মূল্য হিসেবে শস্য উৎপাদনে ব্যয়ের দেড় গুণ দাম দিতে হবে৷ প্রান্তিক কৃষকের উপার্জন নির্দিষ্ট করতে হবে৷ সেইসঙ্গে ফলমূল, শাকসব্জি ও দুধের ক্ষেত্রে উৎপাদকের কমপক্ষে দেড়গুণ লাভ নিশ্চিত করতে হবে৷
এদিকে, কৃষকের এই আন্দোলনকে উপেক্ষা করার মনোভাব দেখাচ্ছে মোদী সরকার৷ ফলে উত্তর ভারতের রাজ্যগুলিতে কৃষক সংগঠনগুলি এই আন্দোলন চালাচ্ছে জোর কদমে৷ যোগ দিয়েছে ছত্তিশগড়ের ‘প্রগতিশীল কৃষক সংগঠন'ও৷ তাদের সঙ্গে যুক্ত আছেন ৩৫,০০০ কৃষক৷ এছাড়াও ওই রাজ্যের আরও ৭টি কৃষক সংগঠন হরতালে শামিল হয়েছে৷ যদিও এই কৃষক আন্দোলনের পেছনে কংগ্রেসের ‘হাত' আছে বলে অভিযোগ করছে ভারতীয় জনতা পার্টি৷ মধ্যপ্রদেশের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান এই আন্দোলনকে ‘কংগ্রেসের ষড়যন্ত্র' বলে অভিহিত করেছে৷ তাঁর দাবি, ‘‘সমস্ত কৃষক এই আন্দোলনে যোগ দেননি৷'' হরিয়ানাতেও চলছে কৃষক আন্দোলন৷ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মনোহরলাল খট্টর যেন মুখে কুলুক এঁটে বসে আছেন৷
কৃষকের প্রতি সরকারের এই ‘উপেক্ষা'র প্রতিবাদের কথা বলে পথে নেমেছে কংগ্রেস৷ প্রকাশ্য রাস্তায় কৃষক-বিক্ষোভে অংশ নিয়ে গায়ে আগুন ধরানোর চেষ্টা করেছেন মহারাষ্ট্রের অমরাবতী জেলার কংগ্রেস বিধায়ক যশোমতী ঠাকুর৷
মহারাষ্ট্রেরই সিল্লোদ কেন্দ্রের আরেক কংগ্রেস বিধায়ক আবদুল সাত্তার আবদুল গনি গত বছর জুনে জমি বিতর্কে কয়েকজন কৃষককে মারধর করার ঘটনায় মূল অভিযুক্ত ছিলেন৷ ইদানীং তিনিই অন্যদের তুলনায় বেশি কৃষকদরদী সেজে বালতি বালতি দুধ ফেলছেন রাস্তায়৷ যার ফলে, মোদী সরকারের পাশাপাশি দেশের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের ‘কৃষক দরদ' নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে৷ কয়েকদিন আগেই কৃষকের দাবি না মানায় মৌনমিছিল করেছিলেন স্থানীয় কংগ্রেস নেতারা৷ প্রশাসনিক কর্তাদের সময়সীমা দিয়েছিলেন তাঁরা৷ কিন্তু সময়সীমার মধ্যে জেলা প্রশাসনের তরফে কৃষকদের সুবিধার্থে কোনও পদক্ষেপ না নেওয়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে যান জেলার ধামাগাঁও ও টেওসা কেন্দ্রের দুই বিধায়ক৷ তাঁদের নেতৃত্বে বিক্ষোভ চলাকালীন নিজেদের গায়ে কেরোসিন তেল ঢেলে আগুন লাগানোর চেষ্টা করেন বীরেন্দ্র জগতাপ ও যশোমতী ঠাকুর৷প্রতিবাদের অঙ্গ হিসেবে কৃষিপণ্য রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলা নিয়ে অনেকেই আপত্তি জানিয়েছেন৷ বিশেষত ভারতের মতো দেশে যেখানে বহু মানুষের দু-বেলা পেট ভরে খাবার পায়না , সেখানে ফল, সবজি, দুধ নষ্টকে সমর্থন করতে পারছেন না অনেকেই৷
বলিউড অভিনেত্রী রবিনা ট্যান্ডনের এক টুইট ঘিরে বিতর্ক তৈরি হয়েছে৷ তিনি বলেছেন, ‘‘আমি ইউনিসেফসহ বহু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে যুক্ত থেকে দেখেছি, দেশের বহু শিশু অপুষ্টির শিকার৷ সেখানে সামান্য দুধ, ফুল ও সবজি অনেকের পেট ভরাতে পারে৷ এভাবে কৃষিজ পণ্য ফেলে দেওয়া সমর্থনযোগ্য নয়৷'' রবিনার এই মন্তব্যের পরে অবশ্য অনেকেই তাঁর মন্তব্যের বিরোধিতা করেছেন৷ সমালোচিত হয়েছেন অভিনেত্রী৷ পাশাপাশি বহু মানুষ তাঁর বক্তব্য সমর্থন করেছেন৷ যদিও কৃষকেদর দাবি-দাওয়া নিয়ে রাজনীতি থামার নাম নেই৷ কংগ্রেস নেতা সদানন্দ সিং বলছেন, ‘‘কেন্দ্রীয় সরকার সমস্যার সমাধান না করে কৃষকদের উপহাস করছে৷ তার ওপর কৃষিমন্ত্রীর মন্তব্য অসংবেদনশীল৷ ওঁর পদত্যাগ করা উচিত৷'' প্রশ্ন থেকেই যায়, কংগ্রেস ও বিজেপি'র টানাপোড়েনে কৃষকের দুর্দশা আদৌ ঘুচবে কি?