দক্ষিণপন্থি প্রবণতা
৯ ডিসেম্বর ২০১২‘নাৎসিরা নিপাত যাক', ‘অনেক হয়েছে, আর নয়' – বিক্ষোভকারীদের মুখে শোনা যাচ্ছিল এমন স্লোগান৷ গ্রাম থেকেও অনেক মানুষ এসে রাজধানী বুদাপেস্ট'এ এই নব্য-ফ্যাশিস্টদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে অংশ নিয়েছে৷ হিটলারের নাৎসি জার্মানিতে ইহুদিদের যে ‘স্টার অফ ডেভিড' চিহ্ন পরতে বাধ্য করা হতো, বিক্ষোভকারীরাও সেরকম চিহ্ন পরে ছিল৷ হাঙ্গেরির গণতান্ত্রিক দলগুলির প্রতিনিধিরা নিজেদের মতভেদ ভুলে একসঙ্গে অঙ্গীকার করলেন৷ তাঁরা বললেন, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দেশের সব মানুষকে চরম দক্ষিণপন্থিদের হাত থেকে রক্ষা করা হবে৷ হাঙ্গেরি আর কখনো বর্ণবাদ ও গণহত্যা বরদাস্ত করবে না৷ গত রবিবার বুদাপেস্টে সংসদ ভবনের সামনে দেখা গেল সচেতন নাগরিকদের এই সমাবেশ৷
বিতর্কের সূচনা হাঙ্গেরির চরম দক্ষিণপন্থি ‘জবিক' পার্টির সংসদীয় দলের উপ প্রধান মার্টন জিয়নজিয়োশি'র মন্তব্যকে ঘিরে৷ সংসদে তৃতীয় বৃহত্তম শক্তি হিসেবে এই দলের ১২ শতাংশ আসন রয়েছে৷ সেই সাংসদ দাবি করেন, দেশে ইহুদিদের আলাদা করে এক তালিকায় নথিভুক্ত করতে হবে৷ একবিংশ শতাব্দীর ইউরোপে এক জনপ্রতিনিধি সংসদে দাঁড়িয়ে এমন কথা বলায় বলাই বাহুল্য, চরম প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে৷ বিভিন্ন মহল থেকে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে৷ প্রায় ৩০টি দল ও সংগঠনের ডাকে হাজার হাজার মানুষ সমবেত হন৷ আয়োজকরা আরও বেশি মানুষ আশা করলেও শেষ পর্যন্ত প্রায় ১০,০০০ মানুষ এই সমাবেশে উপস্থিত হয়েছিলেন৷ প্রায় দুই বছর পর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদেরও একই মঞ্চে দেখা গেল৷ ছিলেন ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলের নেতারা৷ চরম দক্ষিণপন্থিদের দৌরাত্ম্য তাঁদের যেভাবে ঐক্যবদ্ধ করেছে, তা সকলের নজর কেড়েছে৷ বিষয়টিকে ‘মন্দের ভালো' হিসেবেই দেখছে তাঁরা৷
গাজায় ইসরায়েলের অভিযানের বিষয়ে সংসদে আলোচনা চলছিল৷ সে সময়ে ‘জবিক' পার্টির জিয়নজিয়োশি সরকারের কাছে এক অভিনব দাবি জানান৷ তিনি বলেন, হাঙ্গেরিতে যে সব ইহুদি বসবাস করে, তাদের আলাদা তালিকায় নথিভুক্ত করতে হবে৷ তারা দেশের জন্য ঝুঁকি হয়ে উঠতে পারে কি না, তাও পরীক্ষা করে দেখতে হবে৷ সরকার ও সংসদের মধ্যে যে সব ইহুদি রাজনীতিক আছেন, তাদেরও বাদ দিলে চলবে না৷ এমন প্ররোচনার ফলে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়৷ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, মধ্যপ্রাচ্য সংকটের সঙ্গে হাঙ্গেরিতে ইহুদিদের সংখ্যার কোনো সম্পর্ক নেই৷
তবে আসল বিতর্কের কারণ জিয়নজিয়োশি'র দাবি নয়৷ সেই মন্তব্য শুনে বেশিরভাগ সংসদ সদস্য নীরব ছিলেন৷ এমনকি সরকারি দল ‘ফিদেস'এর সদস্যরাও প্রতিবাদ জানান নি৷ ২০১০ সালের নির্বাচনে ‘জবিক' পার্টি প্রায় ১৭ শতাংশ ভোট পায়৷ ইসরায়েলের কড়া সমালোচনার আড়ালে তারা ইহুদি বিদ্বেষ ছড়ানোর চেষ্টা করে৷ এবার ইহুদিদের তালিকার দাবি করে তাদের আসল রূপ বেরিয়ে পড়লো বলে মনে করা হচ্ছে৷ তারা নাৎসি জার্মানির বর্ণবাদের প্রবক্তা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হাঙ্গেরির নিজস্ব নাৎসি পার্টির প্রতিও তাদের সহানুভূতি রয়েছে৷
সমস্যা হলো, রাজনীতির মূল স্রোতে একটি দল এমন খোলামেলাভাবে চরম দক্ষিণপন্থি ভাবধারা তুলে ধরছে, এমন ঘটনা বিরল নয়৷ কিন্তু খোদ প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অর্বান ও তাঁর সরকারি দলও দক্ষিণপন্থি মতবাদের সমর্থক৷ এমনকি তারা কখনো ‘জবিক' পার্টি'র অবস্থানের সঙ্গে স্পষ্টভাবে দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টাও করে না৷
দেশের মধ্যে ইহুদিদের তালিকাবদ্ধ করার দাবির প্রেক্ষিতে ব্যাপক প্রতিবাদ-বিক্ষোভের পর সরকারি দলের কিছুটা টনক নড়েছে৷ সংসদীয় দলের প্রধান আন্তাল রোগান রবিবারের বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন৷ প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ও সমাজতান্ত্রিক দলের নেতাদের সঙ্গে এক মঞ্চে উপস্থিত হয়ে তাঁর অবশ্য বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল৷ রোগান এমনকি ‘জবিক' পার্টি ও ইহুদি বিদ্বেষের প্রকাশ্য সমালোচনাও করেন৷ এর আগে ‘ফিদেস'এর কোনো নেতার মুখে এমন স্পষ্ট ভাষায় এ সব কথা শোনা যায় নি৷ তিনি হাঙ্গেরির সব নাগরিকের সুরক্ষার অঙ্গীকার করেন৷ উপস্থিত বিরোধী নেতারা অবশ্য তাঁকে মনে করিয়ে দেন যে, প্রধানমন্ত্রী অর্বান এখনো ‘জবিক' পার্টির দাবি সম্পর্কে মুখ খোলেন নি৷ দলের অন্যান্য নেতারাও ইহুদি-বিদ্বেষী লেখকদের তোয়াজ করে চলেন৷
হাঙ্গেরির নির্বাচিত সরকারের বিতর্কিত দক্ষিণপন্থি অবস্থান ও গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করার প্রচেষ্টা গত প্রায় দুই বছর ধরে ইউরোপে বহুল আলোচিত বিষয়৷ সংবাদ মাধ্যমের কণ্ঠ রোধ করায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন তার সদস্য হিসেবে হাঙ্গেরির তীব্র সমালোচনা করেছে৷ সাম্প্রতিক এই ঘটনার পরও সরকারের অবস্থানে কোনো রদবদল আশা করছে না বিরোধীরা৷ তাদের দৃষ্টিতে এমন এক দল দেশের জন্য এর কলঙ্ক৷ ইউরোপের বুকে এমন এক সরকারের কারণে ইইউ স্তরেও অস্বস্তি কাটার সম্ভাবনা আপাতত দেখা যাচ্ছে না৷