1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

হায় বিমান বাংলাদেশ!

২০ ডিসেম্বর ২০১৬

আপনার যদি উড়োজাহাজে ভ্রমণের সামান্যতম অভিজ্ঞতা থাকে, তবুও বুঝতে পারবেন৷ ঢাকা অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইট যাওয়ার কথা সিলেটে৷ ছাড়ল সিলেটের উদ্দেশ্যে, কিন্তু চলে গেল কলকাতায়!

https://p.dw.com/p/2UaA1
Bangledesch GMG Airlines
ছবি: dapd

এটা কোনোভাবেই ভুল করে বা পথ হারিয়ে হতে পারে না৷ প্রথমত, সিলেট যে দিকে, কলকাতা প্রায় তার সম্পূর্ণ উল্টো দিকে৷ ম্যাপের দিকে তাকিয়ে দেখেন, পরিষ্কার বুঝতে পারবেন৷

দ্বিতীয়ত, ঢাকা থেকে ফ্লাইট ছাড়ার সময় সিলেট জানত যে একটি ফ্লাইট আসছে৷ আকাশে ওড়ার পর সিলেট বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সঙ্গে পাইলটের কথা হওয়ার কথা৷

তৃতীয়ত, যখন পাইলটের সঙ্গে বিমানবন্দর নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কথা হয়, তখন উভয়েই তাদের সম্পর্কে বলে৷ সিলেট বিমানবন্দর নিজের পরিচয় জানিয়েই কথা বলবে৷ পাইলট ফ্লাইট নম্বরসহ পরিচয় দিয়েই কথা বলবেন৷ সিলেট বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে বলা হবে না যে, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বিমানবন্দর থেকে বলছি৷ পাইলটও যখন ফ্লাইট নাম্বার বলবেন, নিয়ন্ত্রণ কক্ষ বুঝতে পারবে যে, এটা অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট৷

চতুর্থত, অভ্যন্তরীণ রুটের ফ্লাইট নম্বর আর আন্তর্জাতিক রুটের ফ্লাইট নম্বর আলাদা৷ পাইলট যদি অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট নম্বর বলতেন, কলকাতা বিমানবন্দর নিয়ন্ত্রণ কক্ষ বুঝে যেত যে, কিছু একটা ঝামেলা আছে, এই ফ্লাইটের তো এখন আসার কথা নয়৷ আকাশেই তা জানা যাওয়ার কথা৷

পঞ্চমত, একজন পাইলটের না বোঝার কোনো কারণ নেই যে, ভুল করে সিলেট নয় কলকাতায় চলে এসেছে৷ আকাশে থাকতেই তিনি বুঝতে পারবেন৷

ষষ্ঠত, পাইলট নিশ্চয়ই কলকাতা বিমানবন্দর নিয়ন্ত্রণ কক্ষকে ভুল ফ্লাইট নম্বর বলেছিলেন, ‘ভুল' তিনি ভুল করে করেননি, করেছেন সচেতনভাবে৷ চোরাচালান বা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে তিনি সিলেটে না গিয়ে কলকাতায় গিয়েছেন, অবতরণ করেছেন৷ কিছুক্ষণ পর আবার সিলেটে এসেছেন৷ কেন পাইলট কলকাতায় গেলেন, যাত্রীদের এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি পাইলট৷ বিমান বাংলাদেশের এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষও জানায়নি, এই প্রশ্নের উত্তর৷

২.
স্বাধীন দেশে ১৯৭২ সালে যাত্রা শুরু করা বাংলাদেশ বিমান কেমন চলছে, উপরের ঘটনাটি তার ছোট্ট একটি উদাহরণ৷ মাঝি ছাড়া নৌকার যে অবস্থা হয়! আপনি নৌকা যেদিকে নিতে চাইবেন, সেদিকে যাবে না – যদি না মাঝি হাল ঠিকমতো ধরেন৷

জন্মের পর থেকে বিমান সোজা হয়ে কখনো দাঁড়াতে পারেনি৷ অনিয়ম-দুর্নীতি-চুরির খনি হিসেবে পরিচিত পেয়েছে বাংলাদেশ বিমান৷ সুনামের সঙ্গে কখনো যাত্রী বহন করতে পারেনি, বহন করেছে দুর্নাম৷ বিভিন্ন সময়ে উড়োজাহাজ লিজ নেয়াকে কেন্দ্র করে নজিরবিহীন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে৷ পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ নাইজেরিয়া থেকে বিমানের কর্তারা কয়েকগুণ বেশি অর্থ ব্যয় করে বারবার লিজে নিম্নমানের বহু পুরনো উড়োজাহাজ এনেছেন৷ বিমানে যত রকমের কেনাকাটা হয়, সব কিছুতেই পুকুর বা সাগর চুরির ঘটনা ঘটে৷ দৃশ্যমান দুর্নীতির অভিযোগেরও তদন্ত হয় না৷ যখন যারা ক্ষমতায় থেকেছে, বাংলাদেশ বিমানকে নিজেদের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছে৷ এরশাদের সময়ে বিমানের অনিয়ম দুর্নীতির বিষয় সবচেয়ে বড়ভাবে আলোচনায় এসেছে৷

২০০৪ সালে এসে বাংলাদেশ বিমান তার ৪০ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করে দিতে চায়৷ তখন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছোট ভাই শামীম ইস্কান্দারের ইচ্ছেয় চলত বিমান৷ দেশি-বিদেশি কোনো উদ্যোক্তা বিমানের শেয়ার কিনতে আগ্রহী হয় না৷ শেয়ার বিক্রির প্রস্তাব প্রস্তুত করার জন্য ব্যয় করা হয় ১.৬ মিলিয়ন ডলার! এটা দুর্নীতি-অনিয়মের ছোট্ট একটি উদাহরণ৷

১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ বিমানে উড়োজাহাজের সংখ্যা ছিল আট-নয়টি৷ ব্যবস্থাপনায় কর্মকর্তার সংখ্যা ছিল ৫,২৫৩ জন!

ইতিহাসের বিরল দৃষ্টান্ত

২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে বিশ্বব্যাংক থেকে ৪০ মিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়ে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের আয়োজন করে বাংলাদেশ বিমান৷ এই সময় প্রায় ১,৯০০ কর্মী কমানো হয়৷

২০০৮ সালের ১০ সেপ্টেম্বর টাইমস ম্যাগাজিন একটি প্রতিবেদনে পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিমান সেবা হিসেবে বাংলাদেশ বিমানের নাম উল্লেখ করে৷ প্রতিবেদনে বলা হয়, লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে বিমানের প্রতিটি ফ্লাইট গড়ে ৩ ঘণ্টা দেরিতে পৌঁছায়৷

২০০৮ সালে জাতিসংঘ তার কর্মীদের উদ্দেশ্যে নিরাপত্তা, সুরক্ষা, সময়সূচি না মানার কারণে বাংলাদেশ বিমানে ভ্রমণে সতর্কতা জারি করে৷

প্রতিবছর কয়েক'শ কোটি টাকা লোকসান দিয়ে, চুরি-চোরাচালানিদের স্বর্গ হিসেবে চলছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স৷

২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে মাহবুব জামিল যখন উপদেষ্টা, তখন বিমান একটা দিক নির্দেশনা পায়৷ মাহবুব জামিল উদ্যোগী হয়ে বোয়িং কোম্পানি থেকে ১০টি নতুন উড়োজাহাজ কেনার উদ্যোগ নেন৷ পুরনো উড়োজাহাজ কেনা বা লিজে আনার অনিয়ম-দুর্নীতির ধারা থেকে বিমানকে বের করে আনার চেষ্টা করেন৷ বোয়িংয়ের সঙ্গে ১০টি উড়োজাহাজ কেনার বিশাল অঙ্কের চুক্তিটি হয় প্রায় নীরবে এবং কোনোরকম দুর্নীতি-অনিয়ম বা কমিশনের অভিযোগ ছাড়া৷ এর মধ্য দিয়ে মাহবুব জামিলের অসাধারণ যোগ্যতা, দক্ষতার বিষয়টি আরও একবার প্রমাণিত হয়৷ সেই চুক্তির ফসল হিসেবে বাংলাদেশ ইতিমধ্যে চার-পাঁচটি উড়োজাহাজ পেয়েছে৷ ২০১৯ সালের মধ্যে আরও পাঁচটি উড়োজাহাজ বিমান বহরে যুক্ত হবে৷

প্রধানমন্ত্রীকে বহন করছিল এরকমই একটি নতুন উড়োজাহাজ

প্রধানমন্ত্রীকে বহন করা উড়োজাহাজের নাট ঢিলা হয়ে যাওয়া তুঘলকি কাণ্ডের প্রথম তদন্তে কয়েকজনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে৷ দ্বিতীয় তদন্তে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধে৷ যদিও বিমান চলছে সম্পূর্ণ পুরনো রীতিতে৷

কুর্মিটোলা থেকে জিয়া, এখন শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরই পৃথিবীর একমাত্র বিমানবন্দর, যেখানে যাত্রীদের লাগেজ পাওয়ার জন্যে দেড় থেকে তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়৷ যেভাবে লাগেজ ছুড়ে ফেলে ক্ষতি করা হয়, তাও পৃথিবীর অন্য কোনো বিমানবন্দরে দেখা যায় না৷ আসলে ছয়-সাত হাজার কর্মকর্তার কাজ যে কী, তা জানা এবং ব্যবস্থা নেয়া জরুরি৷

গোলাম মোর্তোজা
গোলাম মোর্তোজা, সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক এবং টিভি টকশো-র মডারেটরছবি: Golam Mortoza

প্রধানমন্ত্রী যেদিন গেছেন সেদিনই কলকাতাগামী একটি ফ্লাইটে উড়ার আগে দুইবার ত্রুটি ধরা পড়েছে৷ উড়ার পর আবার ত্রুটি ধরা পড়ায় যশোর থেকে ঢাকায় ফিরে এসেছে৷ এমন ঘটনা প্রায় প্রতিদিন ঘটে, আলোচনায় আসে না৷ প্রধানমন্ত্রীর ফ্লাইটের ত্রুটির কারণে সুযোগ এসেছে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার৷

বাংলাদেশ বিমান পরিচালনার জন্যে সবসময় বিমানবাহিনী থেকে একজনকে নিয়ে আসা হয়৷ কেন এই কর্ম করা হয়, তার উত্তর নেই৷ বিদেশি সিইও আনা হলেও স্বাধীনভাবে কাজ করতে না দিয়ে, নানা বাধা প্রতিকূলতা তৈরি করা হয়৷ অলাভজনক জানা সত্ত্বেও এমন কিছু রুটে কেন ফ্লাইট পরিচালনা করা হয়, অনুসন্ধান করা প্রয়োজন৷

ছয়-সাত হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী থাকা সত্ত্বেও কেন নিরাপত্তার দায়িত্ব ব্রিটিশ কোম্পানিকে দিতে হয়? নেপথ্যের কারণ বা অযোগ্যতাটা কোথায়? বাংলাদেশের কেউ লাগেজ স্ক্যান করতে পারবে না ঠিকমতো, এই অপবাদ মেনে নেয়া যায় না৷

ইমিগ্রেশন পুলিশের কাজের গতি এবং দক্ষতা বৃদ্ধি করার উদ্যোগ নেয়া দরকার৷ শামুক গতির ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা দিয়ে বিমানবন্দর চলতে পারে না৷

সাধারণ যাত্রীদের সঙ্গে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য এবং কলকাতা থেকে আসা যাত্রীদের সঙ্গে (চোরাচালানিদের কথা বলছি না) কাস্টমসের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে হবে৷ চোরাচালানিদের থেকে অর্থ নিয়ে, সাধারণ যাত্রীদের হয়রানি করে কাজ দেখানোর মানসিকতা পরিহার করার উদ্যোগ নেয়া দরকার৷

স্বর্ণ চোরাচালানের ট্রানজিট রুট হিসেবে বাংলাদেশ বিমান এবং বিমানবন্দর যাতে ব্যবহৃত হতে না পারে, তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া জরুরি৷

৩.
ঢাকা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের যা সক্ষমতা, ব্যবহার হয় তার মাত্র ৩৫ শতাংশের মতো৷ কমপক্ষে ৬৫ শতাংশ অব্যবহৃত থাকে৷ তবুও আমরা নতুন বিমানবন্দর বানানোর পরিকল্পনা করছি৷ বিমানবন্দরের জায়গা অন্যদের লিজ দিয়ে, অন্যত্র নতুন বিমানবন্দরের নেপথ্যে আর যাই হোক সৎ কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে না৷

আধুনিক সিঙ্গাপুরের জনক লি কুয়ান ইউ-র একটি পর্যবেক্ষণ দিয়ে লেখা শেষ করি৷ ১৯৭৩ সালে টরেন্টোতে কমনওয়েলথ সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু৷ গিয়েছিলেন লি কুয়ান ইউ-ও৷ লি কুয়ান ইউ টরেন্টো বিমানবন্দরে দেখেন ‘বাংলাদেশ বিমান' লেখা একটি উড়োজাহাজ দাঁড়িয়ে আছে৷ সাত দিন পর তিনি যখন ফিরছিলেন সেদিনও দেখলেন উড়োজাহাজটি দাঁড়িয়েই আছে৷ তিনি অবাক হলেন, একটি উড়োজাহাজ ব্যবহার না করে এভাবে সাত দিন বসিয়ে রাখা হয়েছে৷

এই বিস্মিত হওয়ার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক নেতৃত্বের দূরদৃষ্টি এবং সক্ষমতার প্রমাণ মেলে৷ এত বছর পর বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স শত শত কোটি টাকা লোকসান দেয়া চরম অরাজকতাপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান৷ আর সিঙ্গাপুর পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো এয়ারলাইন্সগুলোর একটি, এবং বিপুল লাভজনক প্রতিষ্ঠান৷

গোলাম মোর্তোজা

আপনি কি লেখকের সঙ্গে একমত? জানান আমাদের, লিখুন নীচের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান