হ্যাঁ, 'শকড', স্তম্ভিত লাগছে
২৩ মার্চ ২০২২নন্দীগ্রামে যেদিন গুলি চলেছিল, মহাকরণের বারান্দায় দাঁড়িয়ে মন্ত্রী ক্ষিতি গোস্বামী সেদিন একটিই শব্দ ব্যবহার করেছিলেন-- ছিঃ। এরপর নানা কথার ভিড়েও ওই উচ্চারণটি কান থেকে যায় না। বড় তীক্ষ্ণ ছিল সেই 'ছিঃ'। প্রায় ১৫ বছর পর আজ আরেকটি শব্দ বার বার ফিরে বাজছে কানে-- শকড। কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি রামপুরহাট কাণ্ড নিয়ে এই একটি শব্দই ব্যবহার করেছেন। 'শকড', একজন পশ্চিমবঙ্গবাসী হিসেবে ভীষণ শকড হয়েছি। স্তম্ভিত লাগছে।
রামপুরহাটের বগটুই গ্রাম এখন গোটা দেশের খবরের শিরোনামে। সোমবার এক তৃণমূল নেতা খুন হওয়ার পরে গ্রামের একের পর এক বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাড়ির ভিতর থেকে যে মৃতদেহগুলি বের করা হয়েছে, তা চেনা যাচ্ছে না। পুড়ে কালো কঙ্কালে পরিণত হয়েছে দেহগুলি। ফরেনসিক পরীক্ষার পর হয়তো সকলের পরিচয় জানা যাবে। তবে স্থানীয় মানুষের অনেকেই বলছেন, যেদিন আগুন লাগানো হলো, তার আগে গ্রাম কার্যত পুরুষশূন্য হয়ে গেছিল। ফলে যারা মারা গেছেন, তাদের অধিকাংশই সম্ভবত নারী এবং শিশু।
ভয়াবহ। এই ভয়বহতা প্রথম দেখছি, এমন নয়। এর আগে এই পশ্চিমবঙ্গেই নন্দীগ্রাম দেখেছি, নেতাই দেখেছি, নানুর দেখেছি। গত কয়েকবছরে একের পর এক রাজনৈতিক খুন দেখেছি। মনে পড়ছে নেতাইয়ের কথা। বাম আমলে নেতাইয়ের হত্যার পর সংবাদসংগ্রহ করতে গিয়ে একটি বাচ্চা মেয়ের আর্তনাদ ক্যামেরায় বন্দি করেছিলাম। দিনের পর দিন যে কান্না খবরের চ্যানেলে প্রোমোয় ব্যবহার হতো। এখনো রাতের ঘুম ভেঙে যায় ওই কান্নার দৃশ্য মনে পড়লে।
বাম আমলের শেষ সময়ে অধুনা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মৃতদেহ শহরে নিয়ে এসে মিছিল করতেন। তাকে সিঙ্গুরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি বলে সংবিধান হাতে বিধানসভায় ঢুকে পড়েছিলেন। তারপরের ঘটনা কলঙ্কিত ইতিহাসের অধ্যায় হয়ে থেকে যাবে। তছনছ করা হয়েছিল বিধানসভা ভবন।
মনে পড়ে, কেন তাকে উপদ্রুত অঞ্চলে যেতে দেওয়া হচ্ছে না, এই প্রশ্ন সামনে নিয়ে ধর্মতলায় হরতালে বসেছিলেন তৎকালীন তৃণমূলনেত্রী। আর এখন? রামপুরহাটের ঘটনার পর তারই প্রশাসন বিরোধীদের এলাকায় ঢুকতে দিচ্ছে না। বিরোধীরা এসে অশান্তি সৃষ্টি করছেন বলে টুইট করছেন রাজ্যের মন্ত্রী-সান্ত্রি-নেতার দল। টিভি ফেটে ঘরের পর ঘর জ্বলে গেছে বলে অবলীলায় দায় এড়াচ্ছেন মাথায় কম অক্সিজেন ওঠা নেতা। অকাতরে যিনি বলে দেন, পুলিশের দিকে বোমা মারো।
অবাক লাগে ভাবতে, ঘটনার পর এতঘণ্টা কেটে যাওয়ার পরেও প্রশাসন সামান্য একটি তথ্য ঠিকমতো প্রকাশ করে উঠতে পারছে না-- ঠিক কতজনের মৃত্যু হয়েছে? কিছু পুড়ে যাওয়া শব গোনা এত কঠিন?
অবাক লাগে ভাবতে, এক দশক আগে এই তৃণমূলই দেহ লোপাট, মৃতদেহ সরিয়ে দেওয়ার অভিযোগ তুলতো। আজ তারাই সে কাজে লিপ্ত হয়েছে। সামান্য তথ্য ঠিকমতো প্রকাশ করতে পারছে না। পারছে না কারণ, রাজনীতিতে এটাই দস্তুর। রাজনীতিতে মৃতদেহের গায়েও পতাকা লাগানো থাকে। পোড়া শরীরেও রং মেশানো থাকে। মৃতদেহেও ওরা-আমরা।
রাজ্যের বিরোধী দলনেতা তথা বিজেপি নেতা শুভেন্দু অধিকারীও বুঝিয়ে দিয়েছেন, মৃত্যুর শোক নিয়ে তার বিশেষ মাথাব্যথা নেই। আগ্রহ আছে মৃত্যু ঘিরে রাজনীতিতে। যেভাবে হাসতে হাসতে তিনি আসানসোলের ভোটের সঙ্গে রামপুরহাটের ঘটনার তূল্যমূল্য বিচার করেছেন, তা দেখলে অবাক লাগে। আরও একবার শকড হতে হয়।
টেলিভিশনের পর্দায় এক আশ্চর্য দৃশ্য লাইভ হয়ে আছে এখন। শঙ্কিত, ভীত গ্রামের মানুষ কার্যত গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছেন। দুই-এক ঘর মানুষ এখনো হারিয়ে যাওয়া আত্মীয়ের অপেক্ষায় হয়তো বসে আছেন। আর গোটা এলাকা ঘিরে ফেলেছে পুলিশ, মিডিয়া আর রাজনীতির লোকেরা। মুখ্যমন্ত্রীও ঘটনাস্থলে যাবেন বলে জানিয়েছেন। সকালে এলাকায় পৌঁছেছিলেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। রাজ্য সরকারের দিকে আঙুল তুলে সেই কথাগুলোই বলেছেন, একসময় তাদের দিকে আঙুল তুলে বিরোধীরা যা বলতেন।
অবাক লাগছে দেখেও না দেখার ভান করে থাকা একদল বিশিষ্ট মানুষের দিকে তাকিয়ে। একদিন তাদেরই বিশ্বাস করে রাস্তায় নেমেছিলেন তো হাজার হাজার সাধারণ মানুষ। সমাজের অভিভাবক মনে করেছিলেন তাদের। মানবতার বাণী ছড়ানো সেই বিশিষ্টরাও কি অন্ধ হয়ে গেলেন? নাকি তারা সেই তিন বাঁদরের মতো-- দেখেন না, শোনেন না, বলেন না।
দল আসে, দল যায়। পতাকার রং বদল হয়। রাজনীতি বদলায় না। আর উলুখাগরার মতো বলি হতে থাকে সাধারণ গরিব মানুষ। তাদের কোনও নাম নেই। তারা কেবলই সংখ্যা। ময়নাতদন্তের টেবিলে তাদের পায়ের আঙুলে সেই সংখ্যা ঝুলতে থাকে।
এই পশ্চিমবঙ্গ আমার দেশ নয়। এই রক্ত উপত্যকা আমার দেশ নয়। অথবা, এটাই বোধ হয় আমার দেশ ছিল!