১৭ দিন পর উত্তরকাশীর সুড়ঙ্গ থেকে উদ্ধার ৪১ শ্রমিক
২৮ নভেম্বর ২০২৩উদ্ধারকর্মীদের দল, ইঞ্জিনিয়ার, র্যাট হোল মাইনার্স, ট্রাকচালক, সেনাসদস্য, সরকারি কর্মী, মেশিন ও তার চালকরা, রাস্তা তৈরি করেছেন যারা এবং ১৮টি সরকারি বিভাগের অসংখ্য কর্মীর মিলিত চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত সুড়ঙ্গ থেকে বের হতে পারলেন আটকে পড়া ৪১ জন শ্রমিক। মঙ্গলবার রাতে যখন তারা সুড়ঙ্গ থেকে বেরোবার পর তখন তাদের মুখে ফুটে উঠলো হাসি, স্বস্তির হাসি, নতুন জীবন ফিরে পাওয়ার হাসি।
গত ১৭ দিন ধরে এই ৪১ জন মানুষ ও তাদের আত্মীয়রা তো বটেই, পুরো দেশ অপেক্ষা করছিল এই শুভ মুহূর্তের জন্য। সমানে প্রার্থনা করা হচ্ছিল, তারা যাতে বাইরে বেরোতে পারেন তার জন্য। বারবার বলা হয়েছে, সেই শুভক্ষণ আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আসতে চলেছে। এই ৪১ জন বিভিন্ন রাজ্যের মানুষ। বিহার, উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড-সহ বেশ কয়েকটি রাজ্যের মানুষ সেখানে কাজ করছিলেন। হঠাৎ ধসের ফলে তারা টানেলে আটকা পড়ে যান। তারপর থেকে তাদের সেখান থেকে বের করে আনার চেষ্টা চলছিল।
পাইপ পৌঁছে গেল
দুপুর সওয়া দুটো নাগাদ ঘোষণা করা হয়, ৪১ জন আটক ব্যক্তি যেখানে আছেন, তার খুব কাছে পাইপ পৌঁছে গেছে। দুই ফুট বাই দুই ফুটের পাইপ। সেই পাইপ শেষপর্যযন্খত আটকদের কাছে পৌঁছয়। তখন জাতীয় বিপর্নযয় মোকাবিলার কর্মীরা প্রথমে সেখানে য়ান। তারপর স্রমিকদের বিশেষ স্ট্রেচারে করে একে একে বের করা হয়। প্রথমেই তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়। তারপর গলায় মালা পরিয়ে দেয়া হয়। মুখে তুলে দেয়া হয় মিষ্টি।
সাড়ে তিনটে নাগাদ জানানো হয়, কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের বিপর্যয় মোকাবিলা টিমের সদস্য ও সেনার জওয়ানরা পুরো অপারেশন নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছে। তারাই আটকদের বাইরে নিয়ে আসবেন।
র্যাট হোল মাইনার্সদের কামাল
শেষ পর্যায়ে অসাধ্যসাধন করেন র্যাট হোল মাইনার্সরা। যখন অ্যামেরিকা থেকে আনা যন্ত্র ভেঙে পড়ে, তখন এই র্যাট হোল মাইনার্সদের কাজে লাগানো হয়। তারা শাবল, গাঁইতি দিয়ে কাজ শুরু করেন। তারাই শেষ ১০-১২ মিটার খননের কাজটা করেন ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ে।
প্রশ্ন হলো এই র্যাট হোল মাইনার্সদের কেন আগে কাজে লাগানো হলো না? আসলে এই মাইনার্সদের কাজ নিয়ে বিতর্ক আছে। অনেকে মনে করেন, তাদের কাজ আদৌ নিরাপদ নয়। এই মাইনার্সরা সাধারণত উত্তর পূর্ব ভারতে কাজ করেন। ভারতে র্যাট মাইনার্সদের কয়লাখনিতে কাজ করতে দেয়া হয় না। কিন্তু এখানে জীবন বাঁচানোর জন্য তাদের দক্ষতাকে ব্যবহার করা হয়েছে। এখানে বিশেষ ট্যালেন্টের দরকার ছিল। তারা ছোট পাইপের মধ্য়ে দিয়ে গিয়ে কাজ করেছেন। তাদের সালাম জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় বিপর্যয় মোকাবিলা কর্তৃপক্ষ এনডিআরএফের প্রধান।
তাই প্রথমে যন্ত্র, বিশেষ করে বিদেশি যন্ত্রের উপর ভরসা রাখা হয়েছিল। সেই যন্ত্র অনেকটা কাজ করলেও তা শেষ করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত অন্য উপায় না থাকায় র্যাট হোল মাইনার্সকে নিয়ে আসা হয়। তারা অস্বাভাবিক দ্রুততার সঙ্গে অসাধারণ কাজ করেছেন।
টানেলেই হাসপাতাল
আটকে পড়া মানুষরা গত ১৭ দিন ধরে সুড়ঙ্গে ছিলেন। তাই তাদের প্রথমেই বাইরে নিয়ে আসা হবে না। টানেলের ভিতরে একটা অস্থায়ী হাসপাতাল তৈরি করা হয়েছে। সেখানে তাদের এক এক করে নিয়ে আসা হবে। টানেলের ভিতরে তাপমাত্রা বেশি। টানেলের বাইরে তাপমাত্রা কম। তাছাড়া এতদিন ধরে আটকে পড়ে থাকার পর তাদের মানসিক ও শারীরিক অবস্থা কেমন তা আগে পরীক্ষা করে দেখা হবে।
বাইরে তখন অপেক্ষা করছিল অ্যাম্বুলেন্সগুলি। যাদের শরীর খারাপ, তাদের দূরের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সে জন্য গ্রিন চ্যানেল তৈরি করা হয়েছে। যাতে অ্যাম্বুলেন্সগুলির হাসপাতাল পর্যন্ত যাওয়ার ক্ষেত্র কোনো বাধা না থাকে। কোথাও আটকে পড়তে না হয়। দরকার হলে ঋষিকেশের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে।
পুরো জায়গাটা ঘিরে রেখেছেন সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মীরা। সকলের নজর ছিল সিল্কিয়ারা টানেলের দিকে। সেখান থেকেই ৪১ জনকে বাইরে নিয়ে আসা হবে।
আটকে পড়া মানুষদের উদ্ধার করার জন্য পাঁচটা জায়গা থেকে চেষ্টা করা হচ্ছিল। উপর থেকেও চেষ্টা চলছিল। উপর থেকে ৪৫ মিটার পর্যন্ত খনন করা হয়েছে।
গব্বর সিং নেগির প্রয়াস
সাবেক সেনা কর্মী ও আটকে পড়া দলের সুপারভাইজার গব্বর সিং নেগি এর আগেও তিনবার এরকম সুড়ঙ্গে আটকে পড়েছিলেন। তিনিই বাকি ৪০ জনকে নেতৃত্ব দেন। তিনি সবাইকে বোঝান, তারা একসময় বাইরে বেরোতে পারবেন। তার জন্য ধৈর্য রাখতে হবে। মনোবল বজায় রাখতে হবে। মনোবল চলে গেলে শরীর খারাপ হয়ে যাবে। মানসিকভাবে ভেঙে পড়বেন তারা।
তিনি টানেলের মধ্যে সকলকে নিয়ে হাঁটতেন। যোগব্যায়াম করাতেন।
তারপর যখন ছোট পাইপ সেখানে পৌঁছে যায়, ফোন চলে আসে, তখন পরিজনদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন তারা। গরম খাবারও পান। মানসিকভাবে অনেক চাঙ্গা হয়ে ওঠেন।
টানেলে মুখ্যমন্ত্রী
পৌনে তিনটে নাগাদ মুখ্যমন্ত্রী পুস্কর সিং ধামি টানেলের কাছে যান। টানেলের ঠিক বাইরে গাড়ি থামে। মুখ্যমন্ত্রী গাড়ি থেকে নেমে হেলমেট পরে টানেলের ভিতরে ঢোকেন।
ততক্ষণে অ্যাম্বুলেন্সের কাছে নিয়ে আসা হয় ওই ৪১ জনের আত্মীয়দের। তারা ব্যাগ হাতে অপেক্ষা করতে থাকেন। সেই ব্যাগের মধ্যে গরম জামাকাপড় ছিল।
দুপুর তিনটে নাগাদ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ভি কে সিং টানেল থেকে বেরিয়ে এসে নিজের টিমের লোকেদের পিঠ চাপড়ে চলে য়ান। তিনিই চিলেন কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি। গত কয়েকদিন ধরে তিনি এখানেই ছিলেন।
চারটে বেজে ১৫ মিনিটে
জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা দলের তরফ থেকে লেফটোন্যান্ট জেনারেল সৈয়দ হাসানিয়ান জানান, ''আর দুই মিটার পাইপ যাওয়া বাকি। সেটা গেলেই পৌঁছে যাওয়া যাবে আটকদের কাছে। আগে কিছু ক্ষেত্রে খননের সময়ও কিছু বাধা এসেছিল। এখন কোনো বাধা আসবে না বলেই আমি মনে করি। আটক মানুষরাও খননের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছেন। মাটি থেকে আট মিটার উঁচুতে পাইপ যাচ্ছে। ভিতরেও দুই মিটার পাইপ ঢোকাতে হবে। যাতে কোনো অসুবিধা না হয়।''
তিনি জানিয়েছেন, যখন স্ট্রেটারে করে মানুষদের নিয়ে আসা হবে, তখনো কিছু বাধা আসতে হবে।
তিনি জানিয়েছেন, ''এক এক জন করে আটক ব্যক্তিকে বাইরে নিয়ে আসা হবে। ফলে তার জন্য বেশ কয়েক ঘণ্টা সময় লাগবে। কোনোরকম তাড়াহুড়ো করা হচ্ছে না। পুরো কাজ শেষ হতে চার-পাঁচ ঘণ্টা সময়ও লেগে যেতে পারে।''
পরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন
এই মানুষরা উদ্ধার করা সম্ভব হলো, সেটা নিশ্চয়ই খুব বড় বিষয়। কিন্তু তারপরেও যে প্রশ্নটা থেকে গেল, সেটা হলো, ভারতে হিমালয়ের বুকে এইভাবে টানেল বানিয়ে পরিবেশের কথা না ভেবে রাস্তা তৈরির কাজ কতটা ঠিক? গত কয়েকদিন ধরে ডিডাব্লিউর কাছে একাধিক বিশেষজ্ঞ এই প্রশ্ন তুলেছেন। উত্তরাখণ্ডে চার ধাম য়াত্রীদের জন্য চার লেনের রাস্তা তৈরির জন্য এই টানেল তৈরি করা হচ্ছিল।
পরিবেশবিদ এবং সিভিল ইঞ্জিনিয়ার বিভাংশু কাপারওয়ানি ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন, ''যত্রতত্র যাতে সুড়ঙ্গ তৈরি করা না হয়, সে দিকে নজর দেওয়া দরকার। হিমালয়কে রক্ষা করা দরকার।''
তিনি ঘটনাস্থলেও গিয়েছিলেন। বিভাংশু জানিয়েছেন, ''যে অঞ্চলে এই সুড়ঙ্গ তৈরির কাজ চলছে, সেখানে পাথর নরম। এমনিতেই এই অঞ্চল ধসপ্রবণ। তার মধ্যে এমন সুড়ঙ্গ তৈরি অত্যন্ত বিপজ্জনক।'' বিভাংসুর বক্তব্য, সুড়ঙ্গ তৈরি হওয়ার পরেও বিপদের আশঙ্কা আছে। আরো বেশি ধস নামারো আশঙ্কা আছে।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞ দীপায়ন দে ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ''উন্নয়নের নামে সরকার পরিবেশকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিচ্ছে। যেভাবে হিমালয় কাটা হচ্ছে তা ভয়াবহ।'' দীপায়নের বক্তব্য, পাহাড়ে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে। তারপরেও কারও টনক নড়ছে না। এই মুহূর্তে এই ধরনের কাজ বন্ধ করে দেওয়া উচিত। বস্তুত, দীপায়নের বক্তব্য, যে ধরনের সয়েল টেস্ট করে এই ধরনের প্রজেক্ট হওয়া উচিত, অনেক ক্ষেত্রেই তা হচ্ছে না। হলে এমন বিপর্যয় ঘটতো না। ওই অঞ্চলে এমন সুড়ঙ্গের নির্মাণই হতো না।
জিএইচ/এসিবি (পিটিআই)