৬ বছরে পোশাক খাতের দুর্নাম কতটা ঘুচল
২৪ এপ্রিল ২০১৯ঢাকার কাছে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় অবস্থিত একটি পোশাক কারখানা৷ তবে দেখে তা বোঝার উপায় নেই৷ সুবিশাল বাগান, চারদিকে সবুজ প্রকৃতি, ঝরনা আর দৃষ্টিনন্দন নকশার ভবন দেখে বরং অবকাশ যাপন কেন্দ্র ভেবেও ভুল হতে পারে৷ সাত একর জায়গার উপর গড়ে ওঠা প্লামি ফ্যাশনস নামের এই কারখানাটি বিশ্বের সবচেয়ে ‘সবুজ' নিট কারখানা হিসেবে পরিচিতি পয়েছে৷
‘‘রানা প্লাজা যেদিন ধ্বংস হয়, সেইদিনই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এমন একটা কিছু করব যেটা দিয়ে এই বদনাম আর দুর্নামটা ঘোঁচাতে পারি, সেই প্রক্রিয়ায় আমরা পৃথিবীর সেরা গ্রিন কারখানা করার প্রত্যয় নিয়েছিলাম,'' বলেন প্লামি ফ্যশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল হক৷ পরিকল্পনার দু'বছরের মধ্যেই তারা কারখানাটি গড়ে তোলেন৷ প্লামি ফ্যাশনস ৪০ ভাগ জ্বালানি ও পানি সাশ্রয়ী, কার্বন নিসরণ হয় ৩৫ ভাগ কম৷
যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিলের' সর্বোচ্চ সনদ ‘লিড প্লাটিনাম' অর্জন করেছে কারখানাটি৷ ‘‘প্লামি ফ্যাশনস পৃথিবীর একমাত্র নিট কারখানা যাদের এই সর্বোচ্চ সনদটা আছে,'' দাবি তাঁর৷ এরপর বাংলাদেশের আরো ১৩টি পোশাক কারখানা লিড প্লাটিনাম সনদ পেয়েছে, ৭০টি পেয়েছে লিড সনদ৷ সবুজ কারখানার সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান এখন সবার উপরে বলে জানান তিনি৷
রানা প্লাজা ধসের পর বাংলাদেশে তৈরি পোশাক খাতের কর্মপরিবেশ উন্নয়নের এমন অনেক ইতিবাচক উদাহরণ তৈরি হয়েছে৷ ফজলুল হকের মতো অনেক কারখানা মালিক স্বপ্রণোদিত ভাবেই আধুনিক ও উন্নত মানের কারখানা গড়ে তুলেছেন৷ ক্রেতাদের চাপে সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হয়েছে বাকিদেরও৷
‘বাংলাদেশের পোশাক খাত ফিনিক্স পাখি'
ছ'বছর আগে ঢাকার সাভারে রানা প্লাজা ধসে অন্তত ১,১৩৪ জন শ্রমিকের নির্মম মৃত্যু হয়৷ গোটা বিশ্বে বাংলাদেশের পোশাক খাতের কর্মপরিবেশ সেসময় প্রশ্নের মুখে পড়ে৷ সমালোচনার মুখে পড়ে বাংলাদেশ থেকে পোশাক কেনা বিদেশি ব্র্যান্ডগুলোও৷ দেশের প্রধান রপ্তানি খাতটিকে ঘিরে বড় ধরনের বিপর্যয়ের শংকা তৈরি হয় তখন৷ ‘‘বাংলাদেশের পোশাক খাতটি আসলে ফিনিক্স পাখির মতো৷ উই অলওয়েজ রাইজ ফ্রম দি অ্যাশেস,'' বলেন তৈরি পোশাক শিল্পের রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ-র নতুন সভাপতি রুবানা হক, যার পরিচিতি আছে কবি হিসবে সাহিত্য অঙ্গনেও৷
রানা প্লাজা ধসের পর আন্তর্জাতিক সংস্কার উদ্যোগের অংশ হিসেবে ইউরোপীয় ব্র্যান্ড ও সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে গঠন করা হয় অ্যাকর্ড, আর অ্যামেরিকার প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাধান্যে গড়ে ওঠে অ্যালায়েন্স৷ তাদের এই কার্যক্রমের মেয়াদ ছিল পাঁচ বছর৷ দুই জোটের অধীনে প্রায় আড়াই হাজার কারখানা ছিল৷ পরিদর্শনের মাধ্যমে কাঠামোগত, অগ্নি ও বৈদ্যুতিক ত্রুটিগুলো চিহ্নিত করে জোট দু'টি৷ যার প্রায় ৯০ ভাগই সংশোধন করেছে কারখানাগুলো৷ প্রাথমিক সংস্কার কাজ পুরোপুরি শেষ করেছে ৬২৫টি ৷ রুবানা বলেন, ‘‘এই অগ্রগতিকে আমাদের ধরে রাখতে হবে, সাসটেইনেবল করতে হবে৷''
অগ্রগতি নেই সরকারি তত্ত্বাবধানে থাকা কারখানাগুলোতে
অ্যাকর্ড আর অ্যলায়েন্সের বাইরে থাকা রপ্তানিমুখী ৭৪৫টি কারখানার সংস্কার কার্যক্রমের দায়িত্ব নেয় সরকার৷ গত পাঁচ বছরে এ সব কারখানা মাত্র ৩৬ ভাগ ত্রুটি সংশোধন করেছে৷ যা হতাশাজনক হিসেবে দেখছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ সিপিডির গবেষক ড. গোলাম মোয়াজ্জেম৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘এই কারখানাগুলো পরিদর্শন করে সমাধানের ক্ষেত্রে যেভাবে মনিটরিং করা উচিত ছিল, সেগুলো সেভাবে মানা হয়নি৷ ফলশ্রুতিতে গত এক বছরে মাত্র ১০ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে৷ অথচ জানুয়ারির ভেতরে সমস্ত কাজ শেষ হওয়ার কথা৷''
মোয়াজ্জেম বলেন, ২১৯টি কারখানা সংস্কার উদ্যোগে সাড়া না দেয়ায় তাদের ইউটিলাইজেশন ডিক্লারেশন বা ইউডি সুবিধা যাতে বন্ধ করে দেয়া হয় সেজন্য মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ-কে বলেছিল সরকারের সংস্কার সমন্বয় কেন্দ্র বা আরসিসি৷ কিন্তু বিজিএমইএ থেকে তাদের জন্য আরো সময় চাওয়া হয়েছে৷ এতে হতাশা প্রকাশ করে ড. মোয়াজ্জেম বলেন, ‘‘(সংস্কার কাজে) আগের বছরগুলোতে যতটা উদ্যোম দেখা গেছে সেখানে এক ধরনের স্লথ গতি এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে উলটো যাত্রার কিছু ইঙ্গিত রয়েছে৷''
নতুন দায়িত্ব নেয়া রুবানা বিষয়টি খতিয়ে দেখার প্রতিশ্রুতি দেন৷ তিনি বলেন, কারখানা মালিকদের কেউ যথেষ্ট আর্থিক সংগতি না থাকার কারণে সংস্কার কাজটি করতে পারছে না, আবার অনেকে ইচ্ছাকৃতভাবে করছেন না৷ ‘‘আমরা খতিয়ে দেখব কয়টি কারখানা আসলেই পারছে না, যারা পারছে না তাদের পাশে আমরা দাড়াব৷ কিন্তু যারা পেরেও করছে না, অনীহা প্রকাশ করছেন, তাদেরকে আমরা একটুও ছাড় দেব না,'' প্রতিশ্রুতি দেন তিনি৷
অস্বস্তি অ্যার্কড ঘিরে
অ্যাকর্ড আর অ্যালায়েন্সের মেয়াদ শেষ হওয়ায় তাদের অধীনে থাকা কারখানার ভবিষ্যৎ তদারকির দায়িত্বও পড়ছে আরসিসি-র উপরে৷ প্রতিষ্ঠানটি যেখানে ছোট কারখানাগুলোরই চাপ নিতে পারছে না সেখানে কয়েক হাজার বৃহৎ কারখানার দায়িত্ব কতটা নিতে পারবে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন মোয়াজ্জেম৷
এরইমধ্যে অ্যাকর্ডও এমন অভিযোগ কোরে ২০২১ সাল পর্যন্ত তাদের মেয়াদ বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে৷ যার বিরোধিতা করে আসছিল সরকার ও বিজিএমইএ৷ বিষয়টি এখন গড়িয়েছে আদালতে৷ ১৯ মে পর্যন্ত তাদের কাজ চালিয়ে সময় দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট৷ এর মধ্যে অ্যাকর্ডের সাথে আলোচনা করে সমস্যার সমাধান করবেন বলে ডয়চে ভেলেকে জানান রুবানা৷ তিনি অ্যাকর্ডের অফিসে বিজিএমইএর একটি সেল বসানোর প্রস্তাব দিয়েছেন৷ ‘‘ডায়লগের অভাবে আমরা অনেক জায়গায় আটকে গেছি৷ আমরা বারবার অ্যাকর্ডের বিরুদ্ধে কথা বলি, অ্যাকর্ড আমাদের বিরুদ্ধে কথা বলে৷ আমি এই কনফ্লিকটিং জায়গা থেকে বেরিয়ে আসতে চাই,'' বলেন তিনি৷
বাংলাদেশে অ্যাকর্ড যে সংস্কার কাজ করেছে তাতে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে রুবানা বলেন, ‘‘আমরা যদি তাদের একটি ছাড়পত্র দেই যে আপনারা খুব ভালো কাজ করেছেন তাহলে অন্য দেশগুলোতেও তারা একই প্র্যাকটিসগুলো শুরু করতে পারেন৷''
‘শ্রমিকদের জীবনমানের উন্নতি হয়নি'
তৈরি পোশাক খাতের কারখানার কর্মপরিবেশের নিরাপত্তায় কিছুটা পরিবর্তন আসলেও শ্রমিকদের জীবন মানের পরিবর্তন হয়নি বলে দাবি করেছেন গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার৷ তিনি অভিযোগ করেন, শ্রমিকদের জন্য ঘোষিত মজুরি বাজার দরের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়৷ আর মজুরি বাড়ানোর পরে শ্রমিকদের উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রাও বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে৷
গেল বছরের ডিসেম্বর আর চলতি বছরে জানুয়ারিতে শ্রমিকরা নতুন মজুরি কাঠামোর বিরুদ্ধে অসন্তোষ জানিয়ে বিক্ষোভ করেছেন রাজপথে৷ পুলিশের সাথে সংঘর্ষে এক শ্রমিকের মৃত্যুও হয় সেসময়৷ এতে বাংলাদেশের পোশাক খাত আরেকবার ভাবর্মূতি সংকটে পড়ে৷
শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলন যৌক্তিক ছিল উল্লেখ করে জলি তালুকদার বলেন, ট্রেড ইউনিয়নের চর্চা নেই বলেই মালিকপক্ষের সাথে শ্রমিকদের দরকষাকষির জায়গা থাকে না৷ তার অভিযোগ, ২০০৬ সালের পরে ৭০টির উপরে কারখানায় ট্রেইড ইউনিয়ন নিবন্ধনের আবেদন করা হলেও তার সবগুলোই প্রত্যাখ্যান করেছে সরকার৷ ‘গণতান্ত্রিক পরিবেশ থাকলে মালিক, সরকার এবং শ্রমিক জন্যেও সেটা ভালো৷ সেটা নাই বলেই অনেক ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়,'' বলেন তিনি৷
মালিক শ্রমিক সম্পর্কের জায়গাটিতে আরো উন্নতি প্রয়োজন বলে মনে করেন রুবানাও৷ ‘‘এই জায়গাটিতে আমাদের স্বচ্ছতা ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করতে হবে আসলে,'' বলেন তিনি৷ এ জন্য তিনি কারখানার মিড লেভেল ম্যানেজমেন্টে সংস্কার আনার উপর জোর দিচ্ছেন৷
রুবানা নিজে বাংলাদেশের পোশাক খাতের অন্যতম বৃহৎ একটি শিল্প প্রতিষ্ঠান মোহাম্মদী গ্রুপের নেতৃত্ব আছেন৷ তাঁর কারখানার শ্রমিকদের সন্তানরা বিনা বেতনে পড়াশোনার সুযোগ পায়৷ উচ্চশিক্ষায় আগ্রহী শ্রমিকদের তিনি বৃত্তি দেন৷ তারা পড়াশোনার সুযোগ পান এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইম্যান-এ৷ এ সময় কাজ না করলেও নিয়মিত বেতন পান শ্রমিকরা৷ বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির দশজন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন৷ রুবানা জানান আরো ১০টি কারখানা এখন তাদের অনুসরণ করছে৷ বিশ্ববিদ্যালয়টির ৬০০ শিক্ষার্থীর মধ্যে গার্মেন্টস কর্মীর সংখ্যা দাড়িয়েছে দেড়শ' জনে৷
রুবানা বলেন, ‘‘আমি শ্রমিকদের বন্ধু হতে চাই৷ আমরা যদি শুধু ওদের অবস্থানটা বুঝি, তাহলেই অনেক কিছু সহজ হয়ে যায়৷ আমাদের সহমর্মিতা বাড়াতে হবে,'' বিজিএমইএ-তে নিজের নেতৃত্বের মেয়াদে সেই জায়গাটি নিয়েই কাজ করার প্রতিশ্রুতি রুবানা হকের৷