পরিবেশবাদী সংগঠন ও বনবিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, সিনেমাটিতে বেশ কয়েকটি দৃশ্য রয়েছে যা ২০১২ সালের আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন৷ তাছাড়া এমন দৃশ্য সাধারণ মানুষকে পাখি শিকার, খাঁচায় পোষা ও হত্যা করার ক্ষেত্রে উৎসাহিত করবে৷ বিপরীতে বলা হচ্ছে, কাঁটাবনে কিংবা চিড়িয়াখানায় বন্যপ্রাণী আটকে রাখলেও বনবিভাগ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না৷ কেউ কেউ বলছেন, যেখানে গার্ডার পরে পাঁচজন মারা যাওয়ার ঘটনায় মামলা হয়েছে পাঁচ কোটি টাকার সেখানে একটা শালিক পাখির জন্য ২০ কোটির টাকার মামলা হয়রানি আর ভাইরাল হওয়ার প্রবণতা ছাড়া আর কিছু নয়৷ এমন বিরোধপূর্ণ বক্তব্য থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার, বাংলাদেশে বন্যপ্রাণী অধিকারের থেকে শুরু করে মানুষের অধিকার, সব ধরনের অধিকারই একটি কেতাবি বিষয়৷ ব্যক্তি, সংঘটন, সমাজ ও রাষ্ট্র সকলেই নিজ নিজ সুবিধামতো কখনও এর পক্ষে কখনও এর বিপক্ষে সোচ্চার হয়৷ বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় ভাগে মৌলিক অধিকারের যে বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত আছে, যেমন আইনের দৃষ্টিতে সমতা, সমানাধিকার, আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার—এসবের বাস্তব চিত্রও প্রায় একই রকম৷ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর অধিকার কবিতায় বনের ওপর অধিকার নিয়ে বকুল, পলাশ, গোলাপ আর কচুর মধ্যকার যে দ্বন্দ্ব ফুটিয়ে তুলেছেন সেটির সাথে বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা মিলে যায়৷ ‘অধিকার বেশি কার বনের উপর, সেই তর্কে বেলা হল, বাজিল দুপর/বকুল কহিল, শুন বান্ধব-সকল, গন্ধে আমি সর্ব বন করেছি দখল/ পলাশ কহিল শুনি মস্তক নাড়িয়া, বর্ণে আমি দিগ্বিদিক রেখেছি কাড়িয়া/ গোলাপ রাঙিয়া উঠি করিল জবাব, গন্ধে ও শোভায় বনে আমারি প্রভাব/ কচু কহে, গন্ধ শোভা নিয়ে খাও ধুয়ে, হেথা আমি অধিকার গাড়িয়াছি ভুঁয়ে/ মাটির ভিতরে তার দখল প্রচুর, প্রত্যক্ষ প্রমাণে জিত হইল কচুর'৷
বাংলাদেশ স্বতঃস্ফূর্তভাবে আটটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে৷ এর অর্থ হলো কোনো প্রকার বৈষম্য ছাড়াই প্রত্যেক ব্যক্তির নাগরিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক অথবা রাজনৈতিক অধিকার রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে৷ কিন্তু বাস্তবে কি তা হচ্ছে? বিশেষ বিশেষ দিবসে শ্রমিকের অধিকার, নারী ও শিশুদের অধিকার, আদিবাসীদের অধিকার, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার, বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষদের অধিকার নিয়ে সভা-সেমিনার, সামাজিক মাধ্যম ও সংবাদমাধ্যমে সরগরম আলোচনা দেখি৷ তারপর যে লাউ সেই কদুর মতো অবস্থা৷ বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলার আসামি ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে, আদিবাসী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা ভূমি থেকে প্রতিনিয়ত বাস্তুচ্যূত হচ্ছেন৷ এখনও এদেশের রাস্তাঘাট, যানবাহনে বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষের ন্যূনতম অধিকারের স্বীকৃতির রূপায়ন দেখা যায় না৷ মে দিবস চলে গেলেই আমরা শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরির কথা ভুলে যাই৷
সাধারণভাবে অধিকার হলো এমন কতগুলো শর্ত যা ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য অপরিহার্য৷ কারণ এ শর্তগুলো পূরণ করা গেলে সামাজিক কল্যাণ নিশ্চিত করা যায়৷ এদিক থেকে অধিকার হলো আইনগতভাবে সীমিত সুযোগ-সুবিধা৷ এ কারণে রাষ্ট্র ও সমাজ কর্তৃক আরোপিত সীমাবদ্ধতার মধ্যেই অধিকার ভোগ করতে হয়৷ সেজন্য জনগণের অধিকার নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র আইন তৈরি করে৷ কিন্তু বিশ্বে এমন কোনো দেশ বা সমাজ পাওয়া যাবে না যেখানে শুধু আইন দিয়ে অধিকার নিশ্চিত করা গেছে৷ যেমন আমাদের দেশের ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের কথা বলা যায়৷ শুধু আইন প্রয়োগ করে পণ্যের ভেজাল রোধ বা ক্রেতা ঠকানো বন্ধ করা যে সম্ভব নয় সেটি প্রমাণিত হয়ে গেছে৷ এর জন্য দরকার নিজেদের অধিকার সম্পর্কে ভোক্তাদের সচেতনতা৷ অর্থাৎ জনগণ আইন ও অধিকার সম্পর্কে অবহিত না থাকলে এর সুফল থেকে বঞ্চিত হয়৷ কারণ অধিকার নিরংকুশ নয়, অধিকার ভোগ করতে হলে কর্তব্য সম্পাদন করতে হয়৷ অধিকার ও কর্তব্যের মধ্যকার সম্পর্কটি সচেনতার মাধ্যমেই বাস্তবায়ন করা সম্ভব৷
সমস্যা হলো অনাদিকাল থেকে আমরা বলে আসছি, যে কোনো সমস্যা সমাধানে দরকার সামাজিক সচেতনতা৷ কিন্তু এই সচেতনতা যে কী বস্তু তা কখনো খোলাসা করা হয় না৷ সামাজিক সচেতনতা হলো সমাজের যে কোনো সমস্যা মোকাবিলায় মানুষের কর্মসূচি, ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা এবং সর্বোপরি নিজের ও সমাজের মানুষের অধিকার-কর্তব্য সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা৷ যে কোনো অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে সমস্যা ও সমাধানের পথকে আমরা সামাজিক ও সামগ্রিকভাবে দেখি না৷ অথচ অধিকার সমাজ নিরপেক্ষ নয়, বরং এটি সমাজভিত্তিক৷ কারণ অধিকার হলো সমাজ জীবনের সেসব অবস্থা যা ছাড়া মানুষ তার সর্বোৎকৃষ্ট সত্তার সন্ধান লাভ করতে পারে না৷
শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থানসহ সবগুলো অধিকার বাংলাদেশে এখন বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পরিচালিত হচ্ছে৷ যার যত টাকা তার সন্তানেরা তত বেশি নামিদামি স্কুলে পড়বে, যার যত প্রতিপত্তি তিনি তত ভাল হাসপাতালে চিকিৎসা পাচ্ছেন৷ অথচ এগুলো নাগরিকের মৌলিক অধিকার এবং সকলের সমানভাবে এসব সুযোগ লাভের অধিকার আছে৷ আর এই অধিকারের নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের৷ জনসচেতনতা নেই বলে রাষ্ট্র দিনের পর দিন শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বৈষম্য জিইয়ে রাখার পরও প্রশ্নের মুখোমুখি হয় না৷ জনসচেতনতার অভাবে অধিকার বলতে শুধু অর্থনৈতিক ও সামাজিক আচরণকেই বোঝানো হয়৷ মানুষের ভাত-কাপড়ের ব্যবস্থা হলেই রাষ্ট্রের দায়িত্ব শেষ বলে মনে করা হয়৷ যদি নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার না থাকে, তাহলে মর্যাদাপূর্ণ জীবন যাপন করা যায় না৷ দরিদ্র থেকে মুক্তি যেমন অবশ্যই দরকার, তেমনি প্রয়োজন নিজের অধিকার সম্পর্কে প্রশ্ন করার মানসিকতা৷ চার্লস ডিকেন্স তার অলিভার টুইয়িস্ট উপন্যাসে এক এতিম বালকের জীবনের করুণ কাহিনি বর্ণনা করেছিলেন৷ পরে এটি নিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে আলোচনা হয়৷ যার ফলশ্রুতিতে ১৮৩৮ সালে দরিদ্রদের সুরক্ষার জন্য আইন হয়৷ কিন্তু এই আইন দরিদ্রদের সুরক্ষা দিতে পারেনি যতদিন বৃটিশেরা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়নি৷
অধিকার একটি গতিশীল ধারণা৷ সামাজিক পরিবর্তনের সাথে সাথে অধিকারের প্রকৃতি ও বিস্তৃতির পরিবর্তন ঘটে৷ সামাজিক সচেতনতাই পারে এই গতিশীলতা ও পরিবর্তন সম্পর্কে মানুষকে সজাগ করতে৷ সামাজিক সচেতনতার অভাবে গতিশীলতা ও পরিবর্তন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না হওয়ার কারণেই এখনও কারো কারো কাছে চিড়িয়াখানা পশুপালনের সাথে সিনেমায় বন্যপ্রাণী হত্যা দৃশ্য প্রচারের বিষয়টি তুলনীয় হয়৷
সামাজিক সচেতনতা আপনা আপনি তৈরি হয় না৷ এর জন্য কিছু নিয়ামক দরকার হয়৷ শিক্ষা, সংস্কৃতি, জ্ঞান, পারিপার্শ্বিক ভাবনাচিন্তা, মূল্যবোধ ইত্যাদি সামাজিক সচেতনতার মূল প্রভাবক হিসাবে সর্বজন স্বীকৃত৷ সামাজিক সচেতনতা গড়ে উঠে আত্মসচেতনতার মাধ্যমে৷ নিজের ভালোমন্দ বিবেচনায় মানুষ যখন সচেষ্ট হয় তখনই সে সামাজিক নানাবিধ সমস্যার ব্যাপারে সচেতন হবার অনুপ্রেরণা পায়৷ রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, আত্মসচেতন মানুষ নিজের ক্ষতি করতে পারে, কিন্তু নিজেকে হেয় করতে পারে না৷ সে বিচার করতে পারে, ক্ষমা করতে পারে, মতবিরোধের বাধা ভেদ করেও যেখানে যেটুকু ভালো আছে সে তা দেখতে পায়৷