‘অন্ধকারের’ কাছে পরাজয়
২৬ মে ২০১৭ভাস্কর্যটির নির্মাতা মৃণাল হক সংবাদ মাধ্যমের কাছে দাবি করেছেন, ন্যায় বিচারের প্রতীক এই ভাস্কর্য অপসারণে তাঁকে বাধ্য করা হয়েছে৷ মধ্যরাতে কান্না আর বেদনায় ন্যুব্জ শিল্পী মৃণাল হক যখন কিছু লোক নিয়ে ভাস্কর্য সরানোর কাজ করছিলেন, তখন তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এই ভাস্কর্যটি আমার সন্তানের মতো৷ আমরা যেমন ছেলে-মেয়েদের বড় করি, আমার ভাস্কর্যও আমি সেরকম পরম যত্নে তৈরি করি৷ আমি আমার সন্তান হারানোর বেদনা অনুভব করছি৷ তাই আমি কাঁদছি৷’’
তিনি বলেন, ‘‘এর মধ্য দিয়ে অন্ধকারের কাছে পরাজয় স্বীকার করা হলো৷ এরপর ওরা অপরাজেয় বাংলা, রাজু ভাস্কর্য, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য অপসারণের দাবি তুলবে৷ এর আগে ওরা আমার লালন ভাস্কর্যসহ আরো কয়েকটি ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলেছে৷’’ মৃণাল হক বলেন, ‘‘যারা আমাকে দিয়ে ভাস্কর্যটি বানিয়েছিলেন, তারাই সরিয়ে ফেলতে বাধ্য করেছেন৷ আমাকে অনেক চাপ ও হুমকি দেয়া হয়েছে৷ আমি কোনো গ্রিক দেবীর ভাস্কর্য তৈরি করিনি৷ ন্যায় বিচারের প্রতীক হিসেবে শাড়ি পড়া এক বাঙালি নারীর ভাস্কর্য বানিয়েছিলাম৷’’ তিনি মনে করেন, ‘‘এই ভাস্কর্য সরানো আমাদের সাংস্কৃতির ওপর আঘাত, অপমান৷ আমরা যদি এদেশে একটা ভাস্কর্যও রাখতে না পারি, তাহলে কোথায় গিয়ে দাঁড়াব?’’
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম অবশ্য দাবি করেছেন, ‘‘সুপ্রিমকোর্ট কর্তৃপক্ষই এই ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলেছে৷ প্রধান বিচারপতি আমাকে ডেকে ভাস্কর্য সরানোর ব্যাপারে মতামত জানতে চাইলে আমি অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে সরানোর পক্ষে মত দেই৷ সেখানে আরো কয়েকজন ছিলেন৷’’
ভাস্কর্য সরানোর কাজ চলাকালে রাতেই সুপ্রিমকোর্টের প্রধান গেটের সামনে অবস্থান নেয় ছাত্র ইউনিয়নসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতা কর্মীরা৷ তাঁরা ভাস্কর্য না সরানোর দাবিতে সেখানে অবস্থান নেন৷ এক পর্যায়ে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান ফটক সরিয়ে ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করে বিক্ষোভকারীরা৷ তাঁরা শ্লোগান দেন, ‘রাজাকারের আস্তানা, ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’, ‘মৌলবাদের আস্তানা, ভেঙে দাও জ্বালিয়ে দাও’, ‘বীর বাঙালির হাতিয়ার, গর্জে উঠুক আরেকবার’, ‘মুক্তিযুদ্ধের হাতিয়ার, গর্জে উঠুক আরেকবার’ ‘শেখ হাসিনা সরকার মৌলবাদের পাহারাদার’, ‘যে সরকার ভাস্কর্য সরায়, সেই সরকার চাই না’, ‘একাত্তরের বাংলায় হেফাজতের ঠাঁই নাই’৷
উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য আরিফ নূর বলেন, ‘‘আমরা রক্ত দিয়ে যে স্বাধীনতা অর্জন করেছি, আজকের এ ঘটনা স্বাধীনতার সঙ্গে প্রতারণা৷ হেফাজতের কথা শুনে তারা এ প্রতারণার কাজ করছে৷’’
প্রতিবাদ, বিক্ষোভ স্থল থেকে রাতে ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেন ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি লিটন নন্দী৷ তিনি বলেন, ‘‘এই সরকার মৌলবাদী হেফাজতের সঙ্গে আপোশ করেছে৷ তারা প্রথমে ভাস্কর্যটিকে ঈদের নামাজের সময় বোরকা পরিয়ে রাখার মতো হাস্যকর সিদ্ধান্ত নেয়৷ এরপর অপসারণ করলো৷ কিন্তু আমরা বাংলাদেশকে আফগানিস্তান বানাতে দেব না৷ অন্ধকারের কাছে পরাজিত হবো না৷ আমরা লড়াই করব৷’’ তিনি বলেন, ‘‘তারা আলোতে ভয় পায়, তাই রাতের আঁধারে এ কাজ করছে৷’’
ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলার ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিশিষ্টজন ছাড়াও সাধারণ মানুষ তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন৷ ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আলী রিয়াজ ফেসবুকে লিখেছেন, ‘‘ঢাকায় জিপিওর সামনে স্থাপিত বর্ষা নিক্ষেপের ভাস্কর্যটি রাতের অন্ধকারে সকলের অগোচরে সরিয়ে ফেলার ঘটনার কথা কি কারও মনে আছে? সেটা কোন সালের ঘটনা? কিংবা মনে করতে পারেন, বিমানবন্দরের সামনে থেকে বাউলের ভাস্কর্য সরানোর ঘটনা? সেটাই বা কবে ঘটেছিল? সেই সময়ে কে কী বলেছিলেন? মনে করতে না পারলে অসুবিধা নেই, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে৷ মূল চরিত্রের বদল হয় মাত্র৷ আর হ্যাঁ, পুনরাবৃত্তির ইতিহাস হচ্ছে প্রহসন৷ সেই প্রহসনের সাক্ষী হয়ে থাকা কম ভাগ্যের কথা নয়৷ প্রহসনের নায়ক-নায়িকারাও ‘শিল্পী’, কিংবা পুতুল নাচের উপাদান৷’’
উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর তানজিনা ইমাম লিখেছেন, ‘‘সুপ্রিম কোর্টের ভাস্কর্য সরানোর কাজ চলছে৷ আমরা নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছি! এ আপোশের চড়া দাম দিতে হবে জাতিকে৷ দুঃখ- এ ঘটনাটি মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী রাজনৈতিক দলটির হাত ধরে ঘটলো৷ কাদের হাতে হাত মেলালেন বঙ্গবন্ধুর উত্তরসূরী! আমাদের উত্তরসূরীদের কাছে কী কৈফিয়ত দেব এ আপোশের? শুধু ভোটের হিসাবে মাথা বিকালাম! শেষরক্ষাও কি হবে? অঙ্গীকার কি পেয়েছেন? ক'দিন পরে যখন স্মৃতিসৌধ, শহীদ মিনার, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙার বায়না ধরবে আজকের সখারা, তখন সামলাতে পারবেন তো!’’
সাংবাদিক মঞ্জুরুল আলম পান্না লিখেছেন, ‘‘অপরাজেয় বাংলা তৈরি হও, তোমাকেও রাখা হবে জাদুঘরে৷ আর ‘অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ’ শব্দগুলো? সে তো হয়েছে রূপকথার ঘুম পাড়ানীয়া গান সেই ক...বে!! সাম্প্রদায়িকতার বিষদাঁতে তটস্থ বিচার বিভাগ-সরকার-রাষ্ট্র৷
ছিঃ সরকার, ছিঃ!! তুমি নাকি ‘জয় বাংলা’ বলো? সাহস থাকে তো প্রকাশ্যে উচ্চারণ করো-- ‘জয় হেফাজত’, ‘জামায়াতে ইসলামি জিন্দাবাদ’.........!!’’
আর ছাত্র ইউনিয়ন নেতা লিটন নন্দী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন তারা অপরাজেয় বাংলা, শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধ ভাঙার দাবি তুলবে৷’’
এদিকে সুপ্রিমকার্টের সামনে থেকে ভাস্কর্যটি সরিয়ে কোর্টের অ্যানেক্স ভবনের সামনে প্রতিস্থাপনের কথা থাকলেও তা হয়নি৷ ভাস্কর্যটি সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেকে অপসারণের পর শুক্রবার ভোররাত পাঁচটার দিকে একটি পিকআপ ভ্যানে করে হাইকোর্টের অ্যানেক্স ভবনের ভেতর পানির পাম্পের পাশে নিয়ে ফেলে রাখা হয়৷
গত বছরের শেষ দিকে সুপ্রিম কোর্টের সামনে ন্যায় বিচারের প্রতীক হিসেবে গ্রিক দেবী থেমিসের আদলে ভাস্কর্যটি স্থাপন করা হয়৷ ফেব্রুয়ারিতে মুখ খোলে হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ আহমদ শফী৷ এক বিবৃতিতে তিনি সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে ভাস্কর্যটি অপসারণের দাবি জানান৷
এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের ইসলামি মৌলবাদী গোষ্ঠী ভাস্কর্যটি সরানোর দাবিতে আন্দোলন করছিল৷ হেফাজতের ঘোষণা ছিল, অপসারণ করা না হলে শাপলা চত্বরে আবারও সমাবেশ করবে তারা৷ গত ১১ এপ্রিল গণভবনে কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসের সরকারি স্বীকৃতি ঘোষণার রাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই প্রশ্ন তোলেন গ্রিক দেবীর ভাস্কর্য নিয়ে৷ সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে এই গ্রিক দেবী থাকা উচিত না বলেও মন্তব্য করেন তিনি৷ পরবর্তীতে আরও কয়েকবার প্রশ্ন তোলেন ভাস্কর্যের বাস্তবতা নিয়ে৷ তার প্রশ্ন, গ্রিক দেবীর গায়ে শাড়ি কেন?
এই ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলায় এরইমধ্যে সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছে হেফাজতে ইসলাম৷ হেফাজতে ইসলামের সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী তাঁর কথা রেখেছেন৷ তিনি আমাদের বলেছিলেন, আমি নিজেও মূর্তি পছন্দ করি না৷ ওটা সরিয়ে ফেলা হবে৷ তাই হাইকোর্টের সামনে মূর্তি সরিয়ে ফেলায় আমরা প্রধানমন্ত্রীতে ধন্যবাদ জানাই৷’’
প্রিয় পাঠক, আপনি কিছু বলতে চাইলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে...