অস্ট্রেলিয়ার শরণার্থীনীতি
১ আগস্ট ২০১৪ভারত মহাসাগরের বিশালত্ব যেন আর শেষ হতে চায় না৷ শ্রীলংকা থেকে অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছতে প্রায় দুই সপ্তাহ লেগে যায়৷ মাঝে মাঝে সাইক্লোন ও কয়েক মিটার উঁচু ঢেউ-এর ধাক্কা সামলাতে হয়৷ তবুও শ্রীলংকা থেকে আসা ‘নৌকা-শরণার্থী'রা এই ঝুঁকি নিয়ে থাকেন৷ পুরনো মরচে ধরা মাছ ধরার মোটরবোটে করে পাড়ি দেন দীর্ঘ পথ৷
দেশত্যাগের তাড়না তামিল জনগোষ্ঠীর
লন্ডনের ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ অ্যালান কিনান এই প্রসঙ্গে বলেন, শ্রীলংকার তামিল জনগোষ্ঠীর লোকজন স্বাধীনতার অভাবে দিশাহারা হয়ে এই ঝুঁকি নেন৷ সিংহলি মিলিটারিরা মানবাধিকার রক্ষার ব্যাপারে মোটেও ভ্রূক্ষেপ করে না৷ শ্রীলংকায় গৃহযুদ্ধের পাঁচ বছর পর এখনও তামিল ও সিংহলি জনগোষ্ঠীর মধ্যে বৈরিতা দূর হয়নি৷ অন্যদিকে সিংহলি জনগোষ্ঠীর অনেকে অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার আশায় দেশ ত্যাগ করেন৷ দুই গ্রুপেরই লক্ষ্য এক: ৬০০০ কিলেমিটার দূরের দেশ, অস্ট্রেলিয়া৷ দেশটি যেন নিরাপত্তা, প্রাচুর্য, বিশালত্ব ও উন্নত জীবনের হাতছানি দেয়৷ যেখানে কলম্বোর কোনো বস্তিতে এক কামরার কুঁড়েঘরে তিনজন মানুষ বাস করেন, সেখানে অস্ট্রেলিয়ায় এক বর্গকিলোমিটারে বাস করেন তিনজন৷
দ্বার রুদ্ধ করতে চায় অস্ট্রেলিয়া
এই বিশালত্ব সত্ত্বেও অস্ট্রেলিয়ার রক্ষণশীল সরকার দেশটির দ্বার রুদ্ধ করে রাখতে চায়৷ ‘স্টপ দ্য বোটস' বা ‘নৌকা থামাও' স্লোগান তুলে ‘লিবারেল পার্টি অব অস্ট্রেলিয়া'র রক্ষণশীল রাজনীতিবিদ টনি অ্যাবোট গত সংসদীয় নির্বাচনে জয়ী হন৷ নয় মাস ধরে দায়িত্ব পালন করছে এই সরকার৷ গত সাত মাসে একটিও শরণার্থী নৌকা অস্ট্রেলিয়ার উপকূলে পৌঁছাতে পারেনি৷
সরকারি আর্থিক সহায়তায় চলা অস্ট্রেলিয়ার মানবাধিকার কমিশনের প্রধান জিলিয়ান ট্রিগস মন্তব্য করেন, ‘‘রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীরা উঁচু মাত্রায় রাজনৈতিক বিষয়ে পরিণত হয়েছেন৷ অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি দিতে গিয়ে কমপক্ষে ১,২০০ শরণার্থীর মৃত্যু হয়েছে৷ নতুন সরকার দেখাতে চায়, নৌকাগুলি আগেই থামিয়ে দিলে মাঝ সমুদ্রে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব৷''
কিছুদিন আগে উপকূলরক্ষা বাহিনী অস্ট্রেলিয়ার কয়েকশ কিলোমিটার দূরে ৪১ জন মানুষ বোঝাই একটি নৌকা থামিয়ে দেয়৷ শরণার্থীরা রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করলে ভিডিও-র মাধ্যমে তাদের সাক্ষাত্কার নেওয়ার পর তা প্রত্যাখ্যান করা হয়৷ এরপর তাঁদের শ্রীলংকার নৌবাহিনীর হাতে সঁপে দেওয়া হয়৷
সমালোচনার মুখে এই প্রক্রিয়া
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও ইউএন রিফিউজি এজেন্সির কঠোর সমালোচনার মুখে পড়ে এই প্রক্রিয়া৷ এরফলে কিছুটা ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে৷ কয়েক দিন আগে ১৫৩ জন মানুষসহ দ্বিতীয় আরেকটি নৌকা উপকূলরক্ষা বাহিনী আটক করে এবং শ্রীলংকা কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করতে উদ্যত হয়৷ কিন্তু সাহায্যসংস্থাগুলির অভিযোগ পরীক্ষা করে দেখার জন্য উচ্চ আদালত এই প্রক্রিয়া আপাতত স্থগিত করেছে৷
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল শরণার্থীদের ভিডিওর মাধ্যমে জিজ্ঞাসাবাদ করার প্রক্রিয়াকে কঠোর সমালোচনা করে৷ এতে করে সুবিচার পাওয়ার সমস্ত সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়৷ চারটি প্রশ্ন করেই তাদের প্রত্যাখ্যান করা হয়৷
অস্ট্রেলীয় সরকার শ্রীলংকার মানবতা হানিকর কার্যকলাপকে মোটেও আমল দিচ্ছে না৷ শ্রীলংকার আইন অনুযায়ী অবৈধভাবে দেশ ত্যাগ করা দণ্ডনীয় অপরাধ৷ এতে দুই বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে৷ বিভিন্ন রিপোর্ট থেকে জানা গেছে, দেশে পাঠিয়ে দেওয়ার পর অনেক শরণার্থীকে নির্যাতনের সম্মুখীন হতে হয়েছে৷
নেটওয়ার্ক গড়া হয়েছে
আশেপাশের দেশগুলির সঙ্গে শরণার্থী বিষয়ক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে অস্ট্রেলিয়া৷ এর আওতায় পাপুয়া নিউগিনি ও নাউরুতে শরণার্থী শিবির স্থাপন করা হয়েছে৷ পরিকল্পনা করা হচ্ছে সেসব দেশেই তাঁদের স্থায়ীভাবে রাখার৷ অ্যাবোট-এর পূর্ববর্তী সরকারের সময় অস্ট্রেলিয়ায় আসার আগে ঐসব দেশেই শরণার্থীদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হতো৷ অ্যাবোট সরকার এই পদ্ধতিও বাতিল করে দিয়েছে৷
ঐসব দেশেই শরণার্থীদের রাখার ব্যবস্থা করছে বর্তমান সরকার৷ এই ক্ষেত্রে যুক্তি দেওয়া হচ্ছে, ‘‘ঐসব দেশে তো নির্যাতন করা হয় না৷'' এই যুক্তি খণ্ডন করে জিলিয়ান ট্রিগস জানান, সেসব দেশে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীদের জ্ঞিজ্ঞাসাবাদ করার মতো তেমন কোনো কাঠামো বা ব্যবস্থাপনাই গড়ে ওঠেনি৷ এইসব যুক্তিতে কর্ণপাত না করে ক্যানবেরা সরকার ১,০০০ কিলোমিটার দূরের কম্বোডিয়াতেও শরণার্থী আশ্রয়শিবির স্থাপন করার চুক্তি সম্পাদন করেছে সম্প্রতি৷
কেউ যদি একবার অবৈধভাবে অস্ট্রেলিয়ায় ঢুকতে গিয়ে ধরা পড়ে ভবিষ্যতে তার আর দেশটিতে স্থায়ীভাবে থাকার অনুমোদন পাওয়ার সম্ভাবনা নেই৷ সাময়িকভাবে কিছুদিন থাকার অনুমোদন পেতে পারেন সেই ব্যক্তি৷ এছাড়া আইনি সহায়তা ও বিমার সুযোগ সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হন তিনি৷ ছোটখাট ত্রুটিতেই বহিষ্কৃত হওয়ার ঝুঁকি থাকে৷
প্রত্যাবর্তনকারীদের জন্য অর্থ
ক্যানবেরা সরকার এখন আরো এক ধাপ এগিয়ে গেছে৷ ২০১৪ সালের জুনে তথাকথিত ‘প্রত্যাবর্তনকারী-অর্থ' নামে একটি নীতিমালা চালু করেছে সরকার৷ কেউ তার রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনার আবেদন প্রত্যাহার করে নিলে, তাকে তিন হাজার থেকে ১০,০০০ মার্কিন ডলার দেওয়ার প্রলোভন দেখানো হয়৷
উল্লেখ্য, ২০১২ সালের জুলাই থেকে ২০১৩ সালের জুন পর্যন্ত ২৫,০০০ শরণার্থী অস্ট্রেলিয়ায় রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনার আবেদন করেছেন৷ তাঁদের অধিকাংশই এসেছেন ইরান, আফগানিস্তান ও শ্রীলংকা থেকে৷